X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

কোন পথে ভারতের অর্থনীতি?

মিছবাহ পাটওয়ারী
২২ ডিসেম্বর ২০২১, ২১:৪৫আপডেট : ২২ ডিসেম্বর ২০২১, ২২:১১

একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের বেশিরভাগ সময় ধরে ভারতের অর্থনীতি পুরো দুনিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। দেশটির দ্রুত বর্ধনশীল মুক্তবাজার গণতন্ত্র হয়ে ওঠার বিষয়টি ঈর্ষণীয়ভাবে দেখছিল অন্যরা। আপাতদৃষ্টিতে একটি গরিব দেশ থেকে সেখানে উচ্চ প্রযুক্তির বিস্তার ঘটেছে। একটি মধ্যবিত্ত সমাজ তৈরি হয়েছে। রয়েছে ইনফোসিস, টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস ও উইপ্রোর মতো তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি। যা দেশটিকে হয়তো একটি বৈশ্বিক খেলোয়াড় তথা একটি অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত করতে পারতো।

২০০৮ সালে দুনিয়াজুড়ে দেখা দেয় অর্থনৈতিক মন্দা। এতে ভারতের দীর্ঘ তিন দশকের কাঠামোগত রূপান্তর ধাক্কা খায়। দীর্ঘদিনের দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কারণে এই ধাক্কাটি ছিল জটিল। সর্বশেষ করোনা মহামারির তাণ্ডবে আপাতদৃষ্টিতে বিশ্বের অর্থনৈতিক মানচিত্র থেকে যেন হাওয়া ভারত।

২০২১ সালে এসে ফের দৃশ্যপটে হাজির ভারত। দেশটি আবারও এগিয়ে যাচ্ছে বলে নিশ্চিত হয়ে সেখানকার স্টক মার্কেটে বিদেশি বিনিয়োগ এটিকে ঊর্ধ্বমুখী করে তোলে। ভারতের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিভা, গতিশীল উদ্যোক্তা এবং বাজারের সম্ভাবনার বিবেচনায় ডিজিটাল প্রযুক্তির স্টার্টআপগুলোতে অর্থ ঢালে বিনিয়োগকারীরা।

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও ইতোমধ্যে ভারতের দিকে তাকাতে শুরু করেছে। কারণ, তারা চীন থেকে বেরিয়ে তাদের উৎপাদনে বৈচিত্র্য আনতে চায়। সর্বোপরি ভারতের বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজার, ইংরেজি ভাষাভাষী ও দক্ষ পরিচালকদের সরব উপস্থিতি, অল্প বয়সী, স্বল্প-দক্ষ বিপুল সংখ্যক কর্মী ইত্যাদির জন্য দেশটিকে শ্রম-নিবিড় রফতানি পণ্য উৎপাদনের জন্য যথোপযুক্ত বলে মনে করা হয়।

ভারতের হারানো দশক

এই সহস্রাব্দের সূচনার পরের বছরগুলোতে ভারতীয় সংস্থাগুলো ক্রমাগত দ্রুত প্রবৃদ্ধির আশায় প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু মন্দার সময় সুদের হার বেড়ে যায় এবং বিনিময় হার ভেঙে পড়ে। তখন অনেক বড় কোম্পানি তাদের ঋণ পরিশোধ করা কঠিন বলে মনে করেছিল। কোম্পানিগুলো খেলাপি হতে শুরু করে। এর জের গিয়ে পড়ে ব্যাংকগুলোর ওপর। তাদের সম্পদের ১০ শতাংশেরও বেশি নন-পারফর্মিং লোনে পরিণত হয়।

সংকট মোকাবিলায় সরকার একের পর এক উদ্যোগ নিতে শুরু করে। ধীরে ধীরে ঋণের সমস্যা কেটেছে। কিন্তু এখনও অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে আগ্রহী নয়। অর্থনীতিও তার আগের গতিশীলতা পুনরুদ্ধার করতে পারেনি।

প্রবৃদ্ধি মন্থর হওয়ায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যান্য সূচকেরও অবনতি হয়েছে। ১৯৪৮ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে। ক্ষুদ্র উৎপাদন খাত সামগ্রিক জিডিপির মাত্র ১৩ শতাংশে নেমেছে।

কয়েক দশকের উন্নতির পর শিশু স্বাস্থ্যের অগ্রগতি, যেমন বিকাশ বাধাগ্রস্ত, ডায়রিয়া ও তীব্র শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতা হ্রাসের মতো বিষয়গুলো স্থবির হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয় নিয়ে হাজির হয়েছে কোভিড-১৯। ২০২০ সালে মহামারি ছড়িয়ে পড়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতেও। প্রধান প্রধান উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পারফরম্যান্স ছিল সবচেয়ে খারাপ। দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বড় উদ্যোগগুলো ধাক্কা সামাল দিতে পারলেও ছোট ও মাঝারি আকারের ব্যবসাগুলো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ২০১৬ সালের আলোচিত মুদ্রা নিষেধাজ্ঞা অর্থপ্রবাহ থেকে ৮৬ শতাংশ নগদ অর্থ সরিয়ে নেয়। ২০১৭ সালে 'গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স' বা জিএসটি নামে নতুন কর ব্যবসার ক্ষেত্রে বড় ধরনের আঘাত করে। এটি বিশেষ করে ছোট কোম্পানিগুলোকে কঠিন আঘাত করেছে। ২০২০ সালে বিক্রি হওয়া গাড়ির সংখ্যা ছিল ২০১২ সালের মতো।

২০২১ সালের গোড়ার দিকে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিপর্যয় নিয়ে আসে। কোভিড থেকে যারা জীবিত ফিরেছেন তাদের মধ্যে অনেককেই প্রচুর চিকিৎসা ব্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। শিশুদের ১৮ মাস ধরে স্কুলের বাইরে রাখা হয়েছিল। অর্থাৎ এটি প্রজন্ম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়েছে।

এক দশকের স্থবিরতার পাশাপাশি কোভিডের ধ্বংসযজ্ঞ ভারতীয়দের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। ২০২১ সালের জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভোক্তা আস্থা সূচক রেকর্ড পরিমাণ নিচে নেমে আসে। এক সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের ৭৫ শতাংশ জানান, তাদের বিশ্বাস অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে।

ভারত কি ঘুরে দাঁড়িয়েছে?

এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে নিঃসন্দেহে ভারত সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক সাফল্যের ‘হার্ডওয়্যার’ নির্মাণে চিত্তাকর্ষক অগ্রগতি করেছে। দেশটিতে ভৌত ও ডিজিটাল পরিকাঠামো রয়েছে। মৌলিক পণ্য সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে। রয়েছে দক্ষ প্রকৌশলী ও উদ্যোক্তাদের শক্তিশালী ভিত্তি। তবু দেশটি তার ‘সফ্টওয়্যার’ ঠিক করার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, যেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কাঠামো দরকার, যার অধীনে দেশীয় উদ্যোক্তা ও বিদেশি সংস্থাগুলোকে কাজ করতে হবে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ভারতে হঠাৎ নীতি পরিবর্তন। কিছু নির্দিষ্ট সংস্থার পক্ষে নিয়ম বদলানো হয়। ফলে দেশীয় উদ্যোক্তা ও বিদেশি কোম্পানিগুলো ভারতের দ্রুত অগ্রসরমান হার্ডওয়্যারকে কাজে লাগাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নয়। ভারতের পুনরুত্থান এবং দেশটি চীনের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে কিনা তা নির্ভর করবে দিল্লি নীতিগত দীর্ঘস্থায়ী ত্রুটিগুলো কাটিয়ে উঠতে পারে কিনা সেটির ওপর।

মহামারির ধকল কাটিয়ে উঠতে পারলে আগামী বছরটি ভারতের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হয়ে ধরা দিতে পারে। দেশটির জিডিপি ইতোমধ্যে তার প্রাক-মহামারি পর্যায় ফিরে পেয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২২ সালে ভারতের প্রবৃদ্ধি হবে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ, যা চীনের তুলনায় প্রায় তিন শতাংশ বেশি।

যেখানে ঝুঁকি

ভারতীয় অর্থনীতির সম্ভাব্যতা অর্জনের জন্য সরকারের নীতিতে একটি সুস্পষ্ট নতুন পদ্ধতির প্রয়োজন হবে। শিল্প নীতিকে অবশ্যই বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলে বৃহত্তর একীকরণের দিকে ঢেলে সাজাতে হবে। সর্বোপরি, নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া উন্নত করতে হবে, যাতে সরকার একটি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা ও বজায় রাখতে পারে যেখানে উৎপাদন ও রফতানি বিকাশ লাভ করতে পারে। তবে এমন কিছু ঘটার ইঙ্গিত খুব কম।

ভারত যদি তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে মৌলিকভাবে উন্নত করতে না পারে এবং তার নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় আস্থা তৈরি করতে না পারে তাহলে দেশীয় উদ্যোক্তা ও বিদেশি সংস্থাগুলো দেশটির অর্থনৈতিক গতিপথ পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় সাহসী বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে না।

আরও ঝুঁকি আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী ও উদারনীতির প্রতি সরকারের ক্রমবর্ধমান অবলম্বন সামাজিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি, সেই সঙ্গে বিচার বিভাগ, মিডিয়া ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর অখণ্ডতাকে প্রভাবিত করতে পারে। গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে ক্ষুণ্ন করে এমন প্রবণতার অর্থনৈতিক মূল্য দিতে হতে পারে, যা সরকারের প্রতি নাগরিক ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করতে পারে এবং কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্যগুলোর মধ্যে নতুন উত্তেজনা তৈরি করতে পারে। হিমালয়ে চীনের সম্প্রসারণবাদী কার্যকলাপ এবং পাকিস্তান-সমর্থিত তালেবানের আফগানিস্তান দখলের কারণে পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে ভারতের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জও নাটকীয়ভাবে বেড়েছে।

এই জটিলতাগুলোর প্রভাব বেশি হলে ভারতের অর্থনীতিতে আবারও একটি হতাশাজনক দশক আসতে পারে। অবশ্যই, কিছু পরিমাণে প্রবৃদ্ধি, কিছু খাত এবং জনসংখ্যার একটি অংশের সমৃদ্ধি হতে পারে। কিন্তু বৃহত্তর অর্থে কোটি কোটি ভারতীয়ের জীবনমান উন্নত ও রূপান্তর করতে এবং বিশ্বকে ফিরে আসার বার্তা দেওয়া নাগালের বাইরে থেকে যাবে। এমনটি হলে, মোদি সরকারের বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূর্বসূরিদের মতোই অধরা থেকে যাবে। ফরেন অ্যাফেয়ার্স অবলম্বনে।

/এএ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
লোকসভা নির্বাচনপ্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
লোকসভা নির্বাচন: মণিপুরে ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষ
সর্বশেষ খবর
প্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
লোকসভা নির্বাচনপ্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
ইসরায়েলি বিমান কীভাবে এল বাংলাদেশে, প্রশ্ন নুরের
ইসরায়েলি বিমান কীভাবে এল বাংলাদেশে, প্রশ্ন নুরের
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
সর্বাধিক পঠিত
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা   
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা