X
বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫
৪ আষাঢ় ১৪৩২

ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের সাত দশকের শত্রুতার দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাস

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
১৮ জুন ২০২৫, ২২:১৪আপডেট : ১৮ জুন ২০২৫, ২২:১৪

যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সম্পর্ক দশকের পর দশক ধরে অমীমাংসিত সংঘাতের মধ্যে দিয়ে গেছে। ১৯৫৩ সালে আমেরিকার সহায়তায় ইরানের গণতন্ত্রপন্থি প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেকের পতনের পর থেকে এই সম্পর্কের অবনতি শুরু। এরপর দীর্ঘদিন ইরানের শাহের স্বৈরশাসনকে সমর্থন দিয়েছে ওয়াশিংটন। ওই সময় নিরাপত্তা বাহিনী ইরানি নাগরিকদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। 

১৯৭৯ সালে তেহরানে আমেরিকার দূতাবাস দখল ও ৫২ কূটনীতিকে জিম্মি করার ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি হয়। এরপর থেকে ইরানকে ‘সন্ত্রাসের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষক’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। 

১৯৫৩: মোসাদ্দেক সরকার উৎখাতে সিআইএ ভূমিকা

১৯৫১ সালে ইরানের পার্লামেন্ট মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে। তিনি জাতীয় স্বার্থে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত অ্যাংলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নেন। এতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ক্ষুব্ধ হয়। যুক্তরাষ্ট্র আশঙ্কা করছিল, ইরান হয়তো সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাববলয়ে চলে যাবে।

এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ ও ব্রিটিশ এমআই৬-এর যৌথ অভিযান ‘অপারেশন অ্যাজাক্স’-এর মাধ্যমে মোসাদ্দেক সরকারকে উৎখাত করা হয় এবং পশ্চিমাপন্থি শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে পুনর্বহাল করা হয়। এই ঘটনা ইরানিদের মনে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষোভের জন্ম দেয়।

১৯৭৯: ইসলামি বিপ্লব, মার্কিন দূতাবাস দখল ও সম্পর্ক ছিন্ন

২৫ বছরের শাহ শাসনের পর ইরানের জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। আর্থ-সামাজিক বৈষম্য, দমন-পীড়ন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিপ্লব ঘটে। ১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে শাহ দেশ ত্যাগ করেন। ফেব্রুয়ারিতে আয়াতুল্লাহ খোমেনি নির্বাসন শেষে দেশে ফেরেন এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়।

তবে এই বিপ্লব যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে বড় আঘাত হানে অক্টোবরে। যখন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার শাহকে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি দেন। ৪ নভেম্বর তেহরানে মার্কিন দূতাবাস দখল করে ৫২ কূটনীতিককে জিম্মি করে ছাত্ররা। ৪৪৪ দিন পর, ১৯৮১ সালের ২০ জানুয়ারি তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। এর আগে ১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে।

১৯৮০-৮৮: ইরান-ইরাক যুদ্ধ ও যুক্তরাষ্ট্রের নীরব সমর্থন

ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ১৯৮০ সালে ইরানে আক্রমণ করেন। যুক্তরাষ্ট্র তখন সরাসরি হস্তক্ষেপ না করলেও, ইরানবিরোধী অবস্থান নেয়। ইরাকের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের ঘটনা জানলেও তা উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধ শেষে প্রায় ৬ লাখ মানুষ নিহত হয়।

১৯৮১-৮৬: গোপনে অস্ত্র বিক্রি ও ইরান-কনট্রা কেলেঙ্কারি

যুদ্ধের সময় ইরান অস্ত্র সংকটে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও গোপনে অস্ত্র বিক্রি করে। সেই অর্থ মধ্য আমেরিকার নিকারাগুয়ায় কনট্রা বিদ্রোহীদের সহায়তায় ব্যবহার করা হয়। বিষয়টি ফাঁস হলে দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে।

১৯৮৮: ইরানি যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত

১৯৮৮ সালের ৮ জুলাই পারস্য উপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর জাহাজ ইউএসএস ভিনসেন্স একটি ইরানি যাত্রীবাহী বিমানকে ভুল করে যুদ্ধবিমান ভেবে ভূপাতিত করে। এতে ২৯০ জন নিহত হন। যুক্তরাষ্ট্র একে ‘দুঃখজনক দুর্ঘটনা’ বললেও ইরানে বিষয়টি ইচ্ছাকৃত আখ্যা দেওয়া হয়।

১৯৯৭-৯৮: পুনর্মিলনের ক্ষীণ প্রচেষ্টা

১৯৯৭ সালে সংস্কারপন্থি মোহাম্মদ খাতামি ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন যোগাযোগের প্রয়াস নেন। খাতামি সিএনএন-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ‘মার্কিন জনগণের প্রতি শ্রদ্ধা’ জানান এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের আহ্বান জানান। কিন্তু সর্বোচ্চ নেতা খামেনি এতে সম্মতি না দেওয়ায় প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

২০০২: শয়তানের অক্ষ ও পারমাণবিক সংকট

জর্জ ডব্লিউ বুশ ২০০২ সালের ভাষণে ইরানকে ‘অ্যাক্সিস অব ইভিল’-এর অংশ হিসেবে আখ্যা দেন। একই বছর ইরানের গোপন পারমাণবিক কার্যক্রম ফাঁস হয়। এরপর শুরু হয় আন্তর্জাতিক উদ্বেগ। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল যৌথভাবে ‘স্টাক্সনেট’ নামক সাইবার ভাইরাসের মাধ্যমে নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনাকে লক্ষ্য করে।

২০০৩ ও ২০০৫: ইরানের পুনঃসংলাপ প্রস্তাব, কিন্তু প্রত্যাখ্যান

২০০৩ সালে ইরান সুইজারল্যান্ডের মাধ্যমে চারটি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চায়, যার মধ্যে ছিল পারমাণবিক কর্মসূচি ও সন্ত্রাসবাদ। কিন্তু বুশ প্রশাসন আগ্রহ দেখায়নি। ২০০৫ সালে মাহমুদ আহমাদিনেজাদ প্রেসিডেন্ট হয়ে এই প্রচেষ্টা থামিয়ে দেন।

২০১৫: পারমাণবিক চুক্তি ও যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়া

ওবামা প্রশাসনের নেতৃত্বে ২০১৫ সালে ইরান ও বিশ্ব শক্তিগুলোর মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক পারমাণবিক চুক্তি – জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন। এতে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কমাতে সম্মত হয় এবং বিনিময়ে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়। তবে ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ান।

২০২০: কাসেম সোলায়মানি হত্যাকাণ্ড

২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি ইরানের কুদস বাহিনীর প্রধান জেনারেল কাসেম সোলায়মানিকে মার্কিন ড্রোন হামলায় হত্যা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্থাপনাগুলোর ওপর হামলার পরিকল্পনা করছিলেন। ইরান প্রতিশোধ হিসেবে ইরাকে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়।

২০২৩: হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ ও ইরান

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েলের পাল্টা আঘাত ইরানের আঞ্চলিক মিত্রদের ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিশেষত হামাস ও হিজবুল্লাহর ওপর প্রভাব পড়ে। ইরান সরাসরি জড়িত না থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে।

২০২৫: ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে পারমাণবিক চুক্তির সম্ভাবনা ও বাধা

দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে নতুন পারমাণবিক চুক্তির উদ্যোগ নেন এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু স্টিভ উইটকফকে মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ দেন। এপ্রিল থেকে আলোচনা শুরু হলেও ১৩ জুন ইসরায়েলের বিমান হামলার পর হোয়াইট হাউজ এখন অবস্থান পুনর্বিবেচনা করছে।

সূত্র: দ্য কনভারসেশন

/এএ/
সম্পর্কিত
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি কে, কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
‘বাড়ির ছবি’ শেয়ার করে কেন তেহরান ছাড়ছেন ইরানিরা?
ইরানে আমি হামলা করতে পারি, নাও করতে পারি: ট্রাম্প
সর্বশেষ খবর
বাসায় ফিরেছেন খালেদা জিয়া
বাসায় ফিরেছেন খালেদা জিয়া
ক্লাব বিশ্বকাপের দ্রুততম গোলের পর ম্যানসিটির শুভ সূচনা
ক্লাব বিশ্বকাপের দ্রুততম গোলের পর ম্যানসিটির শুভ সূচনা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের নাম পুনর্বহালের দাবি
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের নাম পুনর্বহালের দাবি
নিষেধাজ্ঞার পর নিষেধাজ্ঞা, তবু থামছে না যমুনা-সচিবালয়কেন্দ্রিক আন্দোলন
নিষেধাজ্ঞার পর নিষেধাজ্ঞা, তবু থামছে না যমুনা-সচিবালয়কেন্দ্রিক আন্দোলন
সর্বাধিক পঠিত
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে হট্টগোল
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে হট্টগোল
আরও একমাসের ছুটিতে ২ বিচারপতি
আরও একমাসের ছুটিতে ২ বিচারপতি
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত নিয়ে রাশিয়ার লাভ-লোকসানের সমীকরণ
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত নিয়ে রাশিয়ার লাভ-লোকসানের সমীকরণ
‘অঞ্জলি লহ মোর’ ভাস্কর্য ভাঙা নিয়ে সমালোচনার ঝড়
‘অঞ্জলি লহ মোর’ ভাস্কর্য ভাঙা নিয়ে সমালোচনার ঝড়
আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে সশস্ত্র রোহিঙ্গারা: ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদন
আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে সশস্ত্র রোহিঙ্গারা: ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদন