ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির কার্যকর হওয়ার ফলে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে তুরস্ক। তবে যুদ্ধ যেন আবার শুরু না হয়, তা নিশ্চিত করতে দেশটির প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান বুধবারও চালিয়ে গেছেন ধারাবাহিক কূটনৈতিক তৎপরতা। যুদ্ধ নতুন করে শুরু হলে দেশটির অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা নীতিতে গুরুতর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি এ খবর জানিয়েছে।
যুদ্ধবিরতির ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ন্যাটো সম্মেলনের ফাঁকে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন এরদোয়ান। ১০ দিনের ব্যবধানে এটি ছিল দুই নেতার তৃতীয় বৈঠক।
এরদোয়ান এ সময় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান এবং মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গেও ফোনে কথা বলেন।
তবে ওয়াশিংটনভিত্তিক মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক গনুল তোল বলেন, তুরস্ক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছে। কিন্তু ইরান বা ইসরায়েল কেউই আঙ্কারাকে বিশ্বাসযোগ্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দেখে না।
গাজায় ইসরায়েলি হামলার পর তুরস্ক-ইসরায়েল সম্পর্ক বিপর্যস্ত। আর ইরান মনে করে, তুরস্ক ন্যাটোর অংশ হিসেবে কুরেজিক ঘাঁটিতে যে স্ট্র্যাটেজিক রাডার বসিয়েছে, তা দিয়ে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ শনাক্ত করা সম্ভব এবং সেই তথ্য ইসরায়েলকে দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে।
তুরস্ক অবশ্য এই অভিযোগ ‘পুরোপুরি ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু ইরানি সামরিক কর্মকর্তারা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, যদি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হয়, এই রাডার ঘাঁটি প্রথম লক্ষ্যবস্তু হতে পারে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওস জানিয়েছে, গত সপ্তাহে এরদোয়ান ইস্তাম্বুলে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সরাসরি বৈঠকের আয়োজন করতে চেয়েছিলেন। তবে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি প্রাণনাশের আশঙ্কায় গোপন আশ্রয়ে থাকায় বৈঠকটি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
ইসরায়েলি সামরিক সক্ষমতার বহুদূর বিস্তার দেখে তুরস্ক নিজেদের প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি জোরদার করেছে। এরদোয়ান দেশটির প্রতিরক্ষা শিল্পকে মধ্য ও দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমরা সব ধরনের পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।
তুরস্কের জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হলো, ইরান যেন ইরাক বা সিরিয়ার মতো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে না পড়ে। ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির সোনার জাগাপতাই বলেন, তেহরানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে সীমান্তে সন্ত্রাসবাদ, অস্ত্রপাচার ও শরণার্থী সংকটের মতো বড় ঝুঁকি তৈরি হবে।
সিরিয়া ও ইরাকে অস্থিরতা তৈরি হওয়ার পর ইসলামিক স্টেট (আইএস) ও পিকেকে’র মতো গোষ্ঠীগুলো সেই শূন্যতাকে কাজে লাগিয়ে তুরস্কে হামলা চালিয়েছিল। যা আঙ্কারার জন্য দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের শাসন ব্যবস্থা যদি ধসে পড়ে, তখন দেশটির বিপুল জনগণ প্রতিবেশী তুরস্কে পালিয়ে আসতে পারে। এরদোয়ান শুক্রবার জার্মান চ্যান্সেলরকে বলেছেন, এই সংঘাত শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, ইউরোপেও অভিবাসন সংকট সৃষ্টি করতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত তুর্কি সীমান্তে নতুন কোনও শরণার্থীর ঢল দেখা যায়নি।
গনুল তোল বলেন, ইরানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে কুর্দিস্তান ফ্রি লাইফ পার্টি (পিজেএকে) আবার সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে, যা তুরস্কের দশকব্যাপী কুর্দি বিদ্রোহ মোকাবিলার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে।
গত মাসে কুর্দি সশস্ত্র সংগঠন পিকেকে নিরস্ত্র হওয়ার ঘোষণা দিলেও এর ইরানি অংশ পিজেএকে সেই প্রক্রিয়ায় যোগ দেয়নি।
তুরস্কের সংকটে থাকা অর্থনীতি আগে থেকেই উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভুগছে। যুদ্ধের কারণে জ্বালানির দাম আরও বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
বিশেষ করে হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে জ্বালানি পরিবহন বাধাগ্রস্ত হবে। যা তুরস্কের জন্য চরম উদ্বেগের বিষয়। ইরান-ইসরায়েল সংঘাত চলাকালে তেলমূল্য ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল, যা সোমবার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে।