মাইগ্রেশন পলিসি ইন্সটিটিউটের হিসাব অনুযায়ী, আমেরিকায় থাকা ১ কোটি ১০ লাখেরও বেশি অবৈধ/অনথিভূক্ত অভিবাসীর মধ্যে অপরাধের রেকর্ড রয়েছে মাত্র ৮ লাখ ২০ হাজার মানুষের। এদের মধ্যে 'গুরুতর অপরাধী' ৩ লাখ। অথচ নির্বাচিত হওয়ার পর সিবিএস টেলিভিশনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ডোনাল্ড ট্রাম্প গুরুতর অপরাধে জড়িত ২০ থেকে ৩০ লাখ অভিবাসীকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। এখন ট্রাম্প ঘোষিত ২০ থেকে ৩০ লাখ অভিবাসীকে তাড়িয়ে দিতে বাকী ১৭ থেকে ২৭ লাখ গুরুতর অপরাধী কোথায় পাওয়া যাবে? এই প্রশ্নের আংশিক উত্তর পাওয়া যায় ওবামা প্রশাসনের অভিবাসন নীতির দিকে দৃষ্টি ফেরালে।
নথিবদ্ধ প্রমাণ অনুযায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার দুই মেয়াদের প্রথম ছয় বছরে ২৫ লাখ অভিবাসীকে তাড়িয়েছিলেন। ট্রাম্পের মতো তিনিও কেবল গুরুতর অপরাধীদের বিতাড়িত করার কথা বলে নিরাপরাধ বহু সংখ্যক অভিবাসীকে তাড়িয়েছিলেন।
নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম একান্ত সাক্ষাৎকারে কঠোর অভিবাসন পরিকল্পনা তুলে ধরেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ১২ নভেম্বর (রবিবার) সিবিএস টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘যেসব অবৈধ অভিবাসীর ক্রিমিনাল রেকর্ড রয়েছে, যারা অপরাধী চক্রের সদস্য, মাদক কারবারি; এদের সংখ্যা সম্ভবত ২০ লাখ, ৩০ লাখও হতে পারে, আমরা তাদের দেশ থেকে বের করে দেব অথবা কারারুদ্ধ করব।’
এর কয়েক ঘণ্টার মাথায় প্রভাবশালী রিপাবলিকান ও প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার পল রায়ান সিএনএন-কে বলেন,লাখ লাখ অবৈধ অভিবাসীকে গণহারে নির্বাসনে পাঠানো ট্রাম্পের অগ্রাধিকার হতে পারে না। তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের ফোকাস নয়; অভিবাসন ইস্যুর চেয়ে বরং এর আগে আমাদের সীমান্ত সুরক্ষার বিষয়ে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে হবে। আমরা বলপূর্বক লোকজনকে নির্বাসনে পাঠানোর পরিকল্পনা করছি না। ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন কোনও পরিকল্পনা করছেন না।’ একইদিনে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা রিপাবলিকান কেভিন ম্যাকার্থিও অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর চেয়ে সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ম্যাকার্থি বলেন, ‘একটি সাধারণ বিষয়ের ওপর সবাই গুরুত্ব দিচ্ছেন। তা হলো – সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অনুপ্রবেশকারীদের প্রতি ট্রাম্প ব্যবস্থা নেবেন।’
অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা দলনিরপেক্ষ সংগঠন মাইগ্রেশন পলিসি ইন্সটিটিউট। এর পরিচালক মুজাফফর চিশতী। তার সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, বৈধ কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের মধ্যে ৮ লাখ ২০ হাজার মানুষ অপরাধমূলক কাজে জড়িত রয়েছেন। এদের মধ্যে গুরুতর অপরাধে জড়িত মাত্র ৩ লাখ অভিবাসী।
তারপরও ট্রাম্প কী করে ৩০ লাখ গুরুতর অপরাধীর কথা বলেন? মুজাফফর চিশতী দাবি করেন, ট্রাম্প যখন ২০ লাখ অবৈধ অভিবাসীর অপরাধী হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন, তখন তিনি এ সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়েই বলেছেন। চিশতী জানান, ফেডারেল তথ্য অনুযায়ী, অপরাধী তৎঁপরতায় জড়িত থাকার অভিযোগে ১৯ লাখ অভিবাসী বহিষ্কারের আওতায় রয়েছেন। তবে সেখানে বৈধ-অবৈধ দুই ধারার অভিবাসীই রয়েছেন। ট্রাম্প তাহলে ৩০ লাখ অভিবাসী তাড়াতে চাইলেন কী করে? উত্তর খুঁজতে গিয়ে ওবামা প্রশাসনের অভিবাসন নীতির দিকে দৃষ্টি ফেরাতে হয়।
যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই অনথিভূক্ত অভিবাসীদের একটা বড় অংশকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বারাক ওবামা তার দুই শাসনামলের প্রথম ছয় বছরে ২৫ লাখ অভিবাসীকে তাড়িয়েছেন। তিনিও ট্রাম্পের মতোই একই সুর তুলেছিলেন। বলেছিলেন অপরাধী, সংঘবদ্ধ চক্র, এবং আমেরিকান সম্প্রদায়কে আঘাতকারী যারা, সেই তাদের বিতাড়িত করবেন। তবে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর এক অনুসন্ধান বলছে, তাড়িয়ে দেওয়া ২৫ লাখ অভিবাসীর দুই তৃতীয়াংশের বিরুদ্ধেই তেমন কোনও গুরুতর অপরাধের রেকর্ড ছিল না। আর ইউএস ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টম ম্যানেজমেন্ট আইসিই’র নথি বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখিয়েছেন, ২০১৪ সালে তাড়িয়ে দেওয়া অভিবাসীদের ৪৩.৫ শতাংশের বিরুদ্ধে কোনও অপরাধের রেকর্ডই নেই। মাত্র ৬.৭৩ শতাংশ আইনের চোখে দোষী বলে প্রমাণ মিলেছে।
আসলে ট্রাম্পের পক্ষে গুরুতর অপরাধ, কিংবা ক্রিমিনাল রেকর্ডধারী ৩০ লাখ অভিবাসীকে খুজেঁ পাওয়াই সম্ভব নয়। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এখন তিনি যদি লক্ষ্য অনুযায়ী সত্যিই ওই সংখ্যক অভিবাসীকে দেশছাড়া করতে চান, তাহলে তাহলে শুধু অপরাধ নয় অন্যান্য কারণেও অভিবাসীদের তাড়াতে হবে। অভিবাসন সীমিত পর্যায়েও নামিয়ে আনতে হবে। ট্রাম্প প্রশাসন তবে কি করে যে মার্কিন ইতিহাসের কঠোরতম অভিবাসন নীতি গ্রহণ করতে যাচ্ছে, তা পরিস্কার হয়ে যায় যখন তার ঘনিষ্ঠতম উপদেষ্টা অনেকটা পরস্কিার করেই বলেন যে খুব বেশি সময় তারা নিতে চান না এই কাজে। অভিবাসী তাড়াতে গিয়ে নিরাপরাধদেরও নাও ছাড়া হতে পারে। বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, অস্থায়ী ভিসাধারী কিংবা গ্রীনকার্ডধারীরাও ট্রাম্পের অভিবাসননীতির বলি হতে পারেন।
মার্কিন মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের অভিবাসন বিষয়ক গবেষক গ্রেস মেং। তিনি গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘আমাদের মনে রাখা দরকার, ওবামা সক্রিয়ভাবে বিপুল সংখ্যক অভিবাসী তাড়ানোর চেষ্টা করেছেন এবং তিকনি এমনকী দুই শাসনামল মিলে তিনি আড়াই মিলিয়ন অভিবাসীকে তাড়াতেও সমর্থ হয়েছেন।’ সে কারণে ২০ থেকে ৩০ লাখ অভিবাসী তাড়ানোর পরিকল্পনাতা এখনই হোক আর দ্রুততার সঙ্গেই করা হোক, তাহলে আমাদের বিকল্প একটা বৈধ উপায় বের করতে হবে। আমরা যেটাকে বৈধ পথ বলছি, সেই পথটা আসলে বৈধ নয়।‘
তথ্য-প্রাপ্তির স্বাধীনতা আইনের মধ্য দিয়ে ইউএস ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টম ম্যানেজমেন্ট আইসিই’র নথি বিশ্লেষণ করছেন লওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। প্রথমবারের মতো তারাই জানাতে সক্ষম হয়, ২০১৪ ডালে যে অভিবাসীদের বিতাড়িত করা হয়েছে তাদের মাত্র ৬.৭৩ শতাংশ আইনের চোখে দোষী বলে প্রমাণ মিলেছে। এদের ৪৩.৫ শতাংশের বিরুদ্ধে কোনও অপরাধের রেককর্ড নেই। তো সেখান থেকে ট্রাম্পের ৩০ লাখ সংখ্যাটা ভীতিকর বটে।
ফ্রেমিং ইমিগ্র্যান্ট নামের এক বইয়ের লেখক ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অভিবাসনবিষয়ক গবেষক কার্তিক কামকৃষ্ণ। ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘কেবল অনথিভূক্ত অভিবাসরীরা নয়। এখানে আসা মানুষদের মধ্যে যারা গ্রিন কার্ডধারী অথবা যাদের অস্থায় ভিসা আছে, তাদেরও লক্ষ্যবস্তু করা হবে। যদি তারা সামান্যতম কোনও অপরাধও করে তখনই তাদের বিতাড়নের চেষ্টা করা হবে।‘
ট্রাম্পের উপদেষ্টারা এখন স্বীকার করছেন, ৩০ লাখ অভিবাসীকে তাড়াতে গেলে তাদের পরিকল্পনা বিস্তৃত করতে হবে। কেবল দোষী সাব্যস্ত হওয়া অভিবাসী নয়, অপরাধের সঙ্গে সামান্যতম সংশ্লিষ্টতা থাকলেই বিতাড়িত করা হবে। এমনকী কোনও অপরাধ ছাড়াই কেবল অবৈধ পুনঃঅন্তভূক্তির জন্যও তারা অভিবাসীদের বের করে দেবেন।
/বিএ/