X
বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪
২৫ বৈশাখ ১৪৩১
বাংলা ট্রিবিউনের বিশ্লেষণ

দক্ষিণ এশিয়ায় চীনা কূটনীতি: আঞ্চলিক গণমাধ্যমে ব্রিকস

আশীষ বিশ্বাস, কলকাতা
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ০২:৫৪আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ০২:৫৯
image

ব্রিকস সম্মেলন এবং দোকলাম নিয়ে বিতর্কের পর আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং সংকটপূর্ণ সীমান্ত ইস্যুতে জনসাধারণের কাছে চীনের বিরুদ্ধে জয়ের গর্ব জাহির করছিলেন ভারতীয় রাজনীতিকরা। কিন্তু দৃশ্যত দক্ষিণ এশিয়ায় আসলে বেইজিং-ই বিজয়ী।

দক্ষিণ এশিয়ায় চীনা কূটনীতি: আঞ্চলিক গণমাধ্যমে ব্রিকস

উভয়ের জন্য সবচেয়ে বড় বার্তাটি হচ্ছে, চীন দক্ষিণ এশিয়ায় তার কূটনৈতিক গতি নির্ধারণ করবে। ভারতসহ অন্য দেশগুলো যেন শুধু একটি প্রতিক্রিয়াশীল উপায়ে কাজ করতে পারে। তারা হয়তো চীনের প্রশংসা কমিয়ে দেবে অথবা পরিস্থিতি অনুযায়ী এটি সামলে নেবে। এটা পুরোপুরি নির্ভর করবে চীনা রণকৌশল কিভাবে তাদের স্বার্থকে প্রভাবিত করে।

দোকলাম ইস্যু নিয়ে উত্তেজনার সময় দেখা গেছে, জনগণের মতামতের জোয়ার-ভাটা জাতীয়তাবাদী ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রতিফলিত হয়। সেখানে সমানুপাতে উষ্ণ ক্রোধ এবং ‘বুনো উল্লাস’ দৃশ্যমান হয়।

প্রথমে হিমালয় পর্বতমালার সেনাদের প্রত্যাহার করা হয়। এরপর ব্রিকসের যৌথ ঘোষণায় পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর কর্মকাণ্ডের জন্য তাদের ওপর আক্রমণ করে চীন। এর বিপরীতে ভারতের পররাষ্ট্র নীতির ব্যাপারে মান্দারিনদের প্রতিক্রিয়া ও আচরণ ছিল বেশ সংযত ও সতর্ক।

সাবেক কূটনীতিক এম. কে. ভদ্রকুমার-এর মতে, ব্রিকসের পর ভারতের জয়ধ্বনি হাস্যকর। যখন চীনের দিক থেকে এ ধরনের কোনও পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করা হয়নি তখন দোকলাম থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের ভালো কারণ ছিল। ভারতে সেনা ও সামরিক সরঞ্জামের ভরসার জবাবে চীনারা শুধু অনুরূপ ব্যবস্থাই নিয়েছে-এমন নয়। এমনকি তারা ভারতীয় অবস্থানকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে উন্নত মানের দুটি মিসাইল প্রতিস্থাপন করে। এতে করে ভারতের যে কোনও বিমান অ্যাকশন নিবৃত্ত করতে সক্ষম হবে বেইজিং।

ভারতের অর্থনীতিতে ‘বিরূপ প্রভাব’ ফেলেছে ২০১৬ সালের মুদ্রা বাতিলের সিদ্ধান্ত। ওই সিদ্ধান্তের পর ইতোমধ্যেই সর্বনিম্ন ত্রৈমাসিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছয় শতাংশের নিচে ঠেকেছে। ফলে এটা অনুভূত হয়েছে যে, চীনের বিরুদ্ধে উচ্চবাচ্য করার জন্য এটা সর্বোৎকৃষ্ট সময় নয়।

ভারত এখনও চীনের কাছ থেকে উভয় ইস্যুতে তার অবস্থানের ব্যাপারে প্রত্যাশিত শক্তিশালী সমর্থনকে শেষ করে দিচ্ছে। এ দুই ইস্যু হচ্ছে দোকলাম এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা। কিন্তু দিল্লির প্রতিক্রিয়া যদি চমকপ্রদ হতো তাহলে সেটা পাকিস্তানে বিভ্রান্তি ও বিদ্বেষ ছড়াতো। সেটাই হতো একটা চমক! এমনকি এটা চীনেও  বিভ্রান্ত তৈরি করতো।

প্রথমত চীনা প্রতিক্রিয়া নিতে বিশ্লেষকরা দুটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন: একজন পর্যবেক্ষক মনে করেন যে, আঞ্চলিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর চ্যালেঞ্জের বিষয়ে ব্রিকস ঘোষণায় উল্লেখ থাকায় এ নিয়ে বেইজিং ও ইসলামাবাদের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হবে। যদিও একজন পশ্চিমা বিশ্লেষকের মতামত ছিল আরও কাঠখোট্টা। তার মতে, ব্রিকস সম্মেলনে পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী দলগুলোর নিন্দার মাধ্যমে চীন ভারতের একটি হাড় বা অস্থি চিবিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছে।

চীনারা যখন এটা নিশ্চিত করেছে যে, হিমালয় অঞ্চলে তার মৌলিক উদ্দেশ্যের সঙ্গে কোনও আপোষ করা হয়নি তখন তারা সম্ভবত দিল্লিকে মুখোমুখি দাঁড় করাতে আগ্রহী ছিল। এমন কোনও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়নি যে, সড়ক নির্মাণ অব্যাহত থাকবে না অথবা চীনা সেনারা ফিরে যাবে।

দক্ষিণ এশিয়ায় চীনা কূটনীতি: আঞ্চলিক গণমাধ্যমে ব্রিকস

ব্রিকস ঘোষণায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন একজন চীনা বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদ। তার মতে, ‘দৃশ্যত এটা একটা অদ্ভূত সিদ্ধান্ত।’ তিনি মূলত পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী দলগুলোর নাম উল্লেখ করার বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেন।

কলকাতাভিত্তিক একজন বিশ্লেষক বলেন, ‘দৃশ্যত চীনা নীতিগুলো কখনও কখনও খুব জটিল বলে মনে হয়। এমনকি এটা কখনও চীনাদের জন্যও। তবে নিশ্চিতভাবেই এটা খুব স্বাভাবিক কোনও ঘটনা নয়।

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে এখনও পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনও বিস্তারিত সরকারি ব্যাখ্যা হাজির করা হয়নি। এর একমাত্র সম্ভাব্য উপসংহার হতে পারে চীনা প্রেসিডন্ট শি জিনপিং-এর হাতে আঞ্চলিক সম্প্রীতির ওপর চাপ বাড়ানোর মতো ভালো কারণ রয়েছে।

ওই বিশ্লেষক বলেন, ব্রিকসের ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টিও চীনের উপরই বর্তায়। এজন্য এই জোটে থাকা আরেক বড় দেশ ভারতকে অসন্তুষ্ট করতে চাইবে না তারা। এখন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আসন্ন কংগ্রেস আরও ভালোভাবে সামাল দিতে পারবেন তিনি।

দিল্লির বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞরাই প্রাথমিকভাবে বোঝার চেষ্টা করেছেন দোকলামের দুই মাসের উত্তেজনায় চীনকে কিভাবে ‘চোখ রাঙিয়েছে’ ভারত। এই স্থানটি দুই দেশের জন্যই কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিলো, রাস্তা নির্মাণের কাজটি চীন স্থগিত করায় ভারত সাফল্য পেয়েছে। ব্রিকসের সাম্প্রতিক ঘোষণায় ধারণা অন্যরকম হয়েছে। বিস্তারিত জানার পর পরিস্থিতি পাল্টে গেছে।

জৈয়শই মোহাম্মাদ, লস্কর-ই তৈয়বা ও হাক্কানি নেটওয়ার্কের মতো পাকিস্তানি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে চীন।

চীন-ভারত সীমান্ত নিয়ে ১৯৬২ সালের ঘটনার পর ভারতের রাজনৈতিক ও প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা অনেক সাবধান হয়ে গেছেন। সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াতের জানান, শত্রুপক্ষকে মোকাবেলা করার অবস্থান থেকে ভারত সরে আসেনি। আর দোকলাম নিয়ে চীনের আগ্রাসী অবস্থান আবারও হতে পারে বলে আশঙ্কা তার।

ভারতের একজন গণমাধ্যম বিশ্লেষক জানান, ভারতের প্রতি চীনের বন্ধুত্বপূর্ণ অবস্থানের দাবির পরও ব্যবসায়ীরা চিন্তিত। দোকলাম নিয়ে চীনের অবস্থান তাদের ভাবিয়ে তুলেছে। তাদের কাছে মনে হয়েছে, চীন কখনোই ভারতের বন্ধু ছিলো না। বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, চীনা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কাজ করা ভারতীয় ব্যবসায়ীরা তাদের শর্তগুলো আবারও পর্যালোচনা করে দেখছে।

পাকিস্তান থেকে অনুমিতই প্রতিক্রিয়াই এসেছে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী খাজা আসিফ এই বিষয় নিয়ে নতুন কোনও মন্তব্য করেননি। সন্ত্রাসী মোকাবেলায় পাকিস্তানের দুর্বল ভূমিকার কারণে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। ওই বিশ্লেষক জানান, যতদিন পাকিস্তান এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ না নিতে পারবে ততদিন এমন কূটনৈতিক চাপ ও অস্বস্তির মুখোমুখি হতে হবে তাদের।  

খাজা আসিফও দেশটির অন্য মন্ত্রীর মতো কথা বলেছেন। ব্রিকসের ঘোষণার বিরোধীতা করে মন্ত্রী দস্তগীর বলেন, পাকিস্তান অনেকদিন সন্ত্রাসীদের মোকাবেলা করছে এবং ইতোমধ্যে চড়া মূল্য দিয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় চীনা কূটনীতি: আঞ্চলিক গণমাধ্যমে ব্রিকস

পাকিস্তানের প্রভাবশালী পত্রিকা ডনের একটি সম্পদকীয়তের দস্তগীরের বক্তব্যের সমর্থন করা হয়নি। তারা জানায়, ব্রিকসের এই ঘোষণাকে সহজে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। বলা হয়, ‘পাকিস্তানের সন্ত্রাসী মোকাবেলার পদ্ধতি আরও আধুনিক, সময়োপযোগী ও কার্যকরী করা উচিত।’

ডন জানায়, জঙ্গি নির্মূলে পাকিস্তান তাড়াহুড়ো করে পদক্ষেপ নেয়। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকে না। প্রায়ই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয় এবং  পরবর্তী কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। তারা কি করছে সেই নজরদারিও থাকে না। সরকারকে অবশ্যই এই বিষয়ে আরও কঠোর হয়ে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা উচিত বলে জানায় ডন। আসিফও জনগণের কাছে একই আহ্বান জানিয়েছেন। পাকিস্তানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার

 

ভারতীয় পর্যবেক্ষররা মনে করেন ডন ও আসিফের বক্তব্য স্বাগত জানানোর মতো। কিন্তু তাদের পূর্বের অভিজ্ঞতা ভালো না। পাকিস্তানের নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে।

পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন, ব্রিকসের ঘোষণায় খুব বেশি পরিবর্তন আসবে না। এটা খুব তাড়াতাড়িই সবাই ভুলে যাবে। 

/এমএইচ/এমপি
সম্পর্কিত
অর্থনীতি চাঙা করতে গাঁজা চাষে ঝুঁকছে পাকিস্তান
এই বর্ষায় নির্ধারিত হবে মিয়ানমার জান্তা ও বিদ্রোহীদের পরিণতি?
লাদাখ সীমান্তে বিরোধচীনের সঙ্গে আলোচনায় আশাবাদী রাজনাথ সিং
সর্বশেষ খবর
মঙ্গোলিয়ার দাবাড়ুকে হারিয়ে ফাহাদের মুখে হাসি
মঙ্গোলিয়ার দাবাড়ুকে হারিয়ে ফাহাদের মুখে হাসি
চেয়ারম্যান হলেন ৯ এমপির স্বজন, হেরেছেন দুজন
চেয়ারম্যান হলেন ৯ এমপির স্বজন, হেরেছেন দুজন
পিছিয়ে পড়েও জোসেলুর জোড়া গোলে ফাইনালে রিয়াল
চ্যাম্পিয়নস লিগপিছিয়ে পড়েও জোসেলুর জোড়া গোলে ফাইনালে রিয়াল
চেয়ারম্যান হলেন এমপির ছেলে ও ভাই
চেয়ারম্যান হলেন এমপির ছেলে ও ভাই
সর্বাধিক পঠিত
শনিবারে স্কুল খোলা: আন্দোলন করলে বাতিল হতে পারে এমপিও
শনিবারে স্কুল খোলা: আন্দোলন করলে বাতিল হতে পারে এমপিও
‘চুন্নু স্বৈরাচারের দোসর’, বললেন ব্যারিস্টার সুমন
‘চুন্নু স্বৈরাচারের দোসর’, বললেন ব্যারিস্টার সুমন
এক লাফে ডলারের দাম বাড়লো ৭ টাকা
এক লাফে ডলারের দাম বাড়লো ৭ টাকা
ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর ইস্যুতে ন্যাটোকে রাশিয়ার সতর্কতা
ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর ইস্যুতে ন্যাটোকে রাশিয়ার সতর্কতা
ইউক্রেনে পাঠালে ফরাসি সেনাদের নিশানা করার হুমকি রাশিয়ার
ইউক্রেনে পাঠালে ফরাসি সেনাদের নিশানা করার হুমকি রাশিয়ার