রংপুরের পীরগঞ্জের বোরহান উদ্দিন (ছদ্মনাম) ৭ বছর ধরে হাইড্রোসিলে ভুগছিলেন। অণ্ডথলি ভারী হওয়ায় অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন। সামাজিকভাবেও ছিলেন হেয় প্রতিপন্ন। কোথাও যেতে পারতেন না, কারও সামনে আসতে পারতেন না। এমনকি প্যান্টও পরতে পারতেন না। ‘এনশিওরিং হেলথ ইকুইটি অ্যান্ড ইকোনমিক পার্টিসিপেশন ফর ক্রনিক লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস পেশেন্টস থ্রু সার্জিক্যাল ইন্টারভেনশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থায়নে ও আইসিডিডিআরবি’র সহায়তায় হাইড্রোসিল অপারেশনের পর তিনি এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন। আর তার জীবনে এসেছে পরিবর্তন।
ফাইলেরিয়াসিস একটি পরজীবীঘটিত রোগ। এই রোগ কিউলেক্স মশার কামড়ের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। আক্রান্ত অঙ্গ ফুলে যাওয়া এবং পরবর্তীতে ঘন ঘন জ্বর হওয়া—এই রোগের প্রধান উপসর্গ। যা আক্রান্ত ব্যক্তির দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন মাত্রার অক্ষমতার কারণ হতে পারে। ফাইলেরিয়াসিসে আক্রান্ত পুরুষ রোগীর অণ্ডথলি ফুলে যেতে পারে, যা হাইড্রোসিল নামে পরিচিত।
আইসিসিডিআর,বি সমীক্ষা করে জানতে পারে দেশের উত্তরাঞ্চলের ১০টি এন্ডেমিক জেলায় প্রায় ২৫ হাজার সন্দেহভাজন হাইড্রোসিলের রোগী রয়েছেন, যারা সামাজিক ভ্রান্ত ধারণার কারণে স্বাস্থ্যসেবা চাইতে লজ্জা বোধ করেন। এই ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠী অত্যন্ত নিম্ন আয়ের মানুষ যার কারণে হাইড্রোসিল সার্জারির খরচ বহন করতে পারে না। ফলে তারা চিকিৎসাসেবার বাইরে থেকে যায়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সমানভাবে অংশ নিতে পারে না।
২০২২ সাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় আইসিডিডিআর,বি হাইড্রোসিলে আক্রান্ত ২০৩ জন রোগীকে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অস্ত্রোপচার সহায়তা প্রদান করেছে। এর মধ্যে ১৪৫ জন রোগীকে রংপুর এবং ৫৮ জনকে কুড়িগ্রাম জেলায় অপারেশন করা হয়। এর আগে ২০২০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে অফিসের সহায়তায় আইসিডিডিআর,বি ৮৩৮ জন হাইড্রোসিল রোগীকে হাইড্রোসিল অপারেশনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সাহায্য করেছিল।
আইসিডিডিআর,বি-র গবেষকরা একটি ফলাফল মূল্যায়ন কার্যক্রমও পরিচালনা করেছেন। ফলাফলে দেখা যায়, অপারেশন এই রোগীদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অংশগ্রহণের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে।
রংপুরের আমির হোসেন (ছদ্মনাম) ১০-১২ বছর ধরে এই রোগে ভুগছিলেন। তিনি বলেন, বেসরকারিভাবে ২০-২২ হাজার টাকা দিয়ে অপারেশন করার মতো সামর্থ্য আমার ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক সহায়তার কারণে আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, উপজেলা হাসপাতালের সাড়ে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকার এই অপারেশন করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে তারা।
এই প্রকল্প আইসিডিডিআর,বি’র নিউট্রিশন অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল সার্ভিসেস ডিভিশনের রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর ডা. শমিক মারুফের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। তিনি বলেন, পুরুষের ক্ষেত্রে এই রোগ হলে তাকে বলা হয় হাইড্রোসিল। এই ধরনের রোগীর শুরুতে উপসর্গ থাকতেও পারে নাও থাকতে পারে। শুরুতে দেখা যায় জ্বর আসছে আর যাচ্ছে। এটাকে একিউট স্টেজ বলা হয়। এখন এই একিউট স্টেজ এক মাস দুই মাস থাকতে পারে। একসময় জ্বর আসা বন্ধ হয়ে যাবে, তখন সে চলে যায় ক্রনিক ফেইজে। এটি হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি। তখন দুটি জিনিস হতে পারে। এক- লিম্ফাডেমা। প্রাপ্তবয়স্ক ফাইলেরিয়া পরজীবী মারা গেলে সেটি আমাদের লিম্ফেটিক ফ্লুইডের চ্যানেলকে ক্ষতিগ্রস্থ করে এবং চ্যানেল বন্ধ হয়ে ফুলে যায়।
তিনি আরও বলেন, যদি সেটি হাতে হয় হাত ফুলবে, পায়ে হলে পা ফুলবে। নারীদের ক্ষেত্রে স্তন ফুলে যায়, পুরুষের অণ্ডথলি ফুলে। হাতে হলে হাত তো কেটে ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না। হাতে পায়ে তাই অপারেশন করে খুব একটা লাভ হয় না, স্থায়ীভাবে ক্ষতি হয়ে যায়। হাইড্রোসিল যেখানে হয় সেটি শরীর থেকে আলাদা একটি জায়গায় হচ্ছে। আলাদা হওয়ার কারণে পানি যেখানে জমে কেটে সেটি আলাদা করে নিয়ে আসা যায়। তারপর সেলাই করে দিলে সেই ফোলা আর থাকছে না।