২০২২ সালের জুলাই মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং শ্রীলঙ্কার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জাতীয় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ইউনিট (এনডিসিইউ) এবং শ্রীলঙ্কার বৃহত্তম সুশীল সমাজ সংস্থা ‘সর্বোদয়া শ্রমদান আন্দোলন’ সামাজিক সম্পৃক্ততার মাধ্যমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। সর্বোদয়া শ্রমদান আন্দোলন জনগণকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে একটি বিশেষ কর্মসূচি হাতে নেয়। কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করার সেই উদ্যোগ সফল হয়েছিল ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে। এর ফলে দেশটির ১২টি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে মশার প্রজনন স্থান হ্রাস এবং মশামুক্ত পরিবেশ কীভাবে তৈরি ও টেকসই করা যায়, সে সম্পর্কে জনসাধারণের জ্ঞান বৃদ্ধি পেয়েছে। কমিউনিটিভিত্তিক এই উদ্যোগ ভবিষ্যতে অব্যাহত ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের মাধ্যমে অগ্রগতি বজায় রাখতে সহায়ক হবে বলে আশা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শ্রীলঙ্কা এবং দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা জেলাগুলোতে কমিউনিটি সম্পৃক্ততার কারণে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা প্রায় ৬০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল এবং বড় প্রাদুর্ভাবগুলো রোধ করেছিল।
বাংলাদেশে বেশ কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুর বড় প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। রোগটি আগে মৌসুমি হলেও বর্তমানে সারা বছরই প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। সাধারণত বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতো, তবে এখন শীতকালেও ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৫ মে পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২ হাজার ৫৪৫ জন এবং মারা গেছেন ৩২ জন। এর মধ্যে গত জানুয়ারিতে ১ হাজার ৫৫ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৩৯ জন, মার্চে ৩১১ জন, এপ্রিলে ৫০৪ জন এবং মে মাসের ১৫ দিনে রোগী পাওয়া গেছে ৩৩৬ জন।
গত বছর এযাবৎকালের সর্বাধিক ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গুরোগী শনাক্ত হয়। তবে তখন রোগী বেশি ছিল মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। এ বছর জানুয়ারিতেই হাজারের বেশি রোগী পাওয়া গেছে, যা আগে কখনও পাওয়া যায়নি। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে রোগী পাওয়া যায় ১২৬ জন, ২০২১ সালের জানুয়ারিতে রোগী ছিল ৩২ জন।
বিগত দিনগুলোর তুলনায় চলতি বছর মৃত্যুও বেড়েছে। এ বছরের জানুয়ারিতে মারা গেছেন ১৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩ জন, মার্চে ৫ জন, এপ্রিলে ২ জন এবং মে মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত ৮ জন মারা গেছেন। গত বছরের জানুয়ারিতে মারা যান ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩ জন এবং মার্চে ও এপ্রিলে কোনও মৃত্যু ছিল না। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ডেঙ্গুতে কেউ মারা যাননি। তার আগে ২০২১ সালেও জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে এই রোগে মৃত্যুর কোনও ঘটনা ঘটেনি।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এমন পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক আন্দোলনের কথা বলছেন অনেকেই। অর্থাৎ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জনগণের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় সরকার বিভাগ কিংবা সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।
বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার লার্ভা পাওয়ায় জরিমানা আদায় করা হয়েছে বিভিন্ন বাসাবাড়ি থেকে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ এডিস মশার লার্ভা নিয়ে করা জরিপে দেখা গেছে, বিল্ডিংয়ের বেজমেন্টে ও ফ্লোরের মেঝেতে জমে থাকা পানিতে সবচেয়ে বেশি লার্ভা পাওয়া গেছে। এরপর সবচেয়ে বেশি লার্ভা পাওয়া গেছে প্লাস্টিকের বালতিতে। এছাড়া প্লাস্টিকের ড্রাম, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের বোতল, ফুলের টবের মতো জায়গায় এডিসের লার্ভা পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বাড়ির আনাচে-কানাচে সব জায়গায় অভিযান চালিয়ে লার্ভা ধ্বংস করা সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে সম্ভব না। সেই জনবলও করপোরেশনের নেই। তাই এখানে জনসম্পৃক্ততা তৈরি করতে হবে। মানুষকে সচেতন করতে হবে। তবে এও প্রশ্ন আছে—জনগণের সম্পৃক্ততা কতটুকু কাজে লাগবে।
২০০৩-০৪ সালজুড়ে অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক কম্বোডিয়ার ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেই গবেষণার ফলাফল ২০০৮ সালে প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, বাসাবাড়িতে এডিস মশা ও টেকসই ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রবিন্দু হলো—জনগণের অংশগ্রহণ ও কার্যকর স্বাস্থ্য শিক্ষা। যেকোনও ডেঙ্গু আক্রান্ত দেশে, বিশেষত স্বল্প সম্পদশালী দেশগুলোতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার একমাত্র কার্যকর এবং টেকসই উপায় হচ্ছে কমিউনিটিভিত্তিক কর্মসূচি এবং প্রজনন স্থানগুলো নির্মূলে স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ডেঙ্গু এখন এমন একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেটিকে সরকার বা সিটি করপোরেশন একা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। পৃথিবীর কোনও দেশই জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফল হয়নি।
তিনি আরও বলেন, সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব রাস্তাঘাট, উন্মুক্ত স্থান, সরকারি স্থাপনা, বাস টার্মিনালগুলোতে এডিস মশার প্রজনন বন্ধ ও নিয়ন্ত্রণ করা। আর নগরবাসীর দায়িত্ব তার বাড়ি ও আঙ্গিনায় এডিস মশার প্রজনন যেন না হয়, তা নিশ্চিত করা। আমরা গত বছরের ভয়ংকর ডেঙ্গু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি চাই না। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন কার্যক্রম শুরু করতে পারে। জনগণকেও যে যার অবস্থান থেকে নিজ নিজ বাড়ি ও বাড়ির আঙ্গিনায় এডিস মশার প্রজনন যেন না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে সঠিক কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় পরিচ্ছন্ন অভিযান চালাতে হবে। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর কিংবা জনপ্রতিনিধিদের এখানে সম্পৃক্ত করতে হবে। কাজটি প্রতিদিন করতে হবে, একদিন করেই বসে থাকলে হবে না। এই কাজটি জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া সম্ভব না। সিটি করপোরেশনের কাছে এত জনবল নেই। একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা দাঁড় করাতে হবে। সেটি মানুষকে সম্পৃক্ত করে করা সম্ভব। আমরা যদি সমন্বিতভাবে এগিয়ে যাই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য, তাহলে কাজটা ভালো হবে, আমরা এ ক্ষেত্রে সফল হবো।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সামাজিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে নগরবাসীকে সচেতন করার কার্যক্রম শুরু করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এই কার্যক্রমের আওতায় ডিএনসিসির কোনও এলাকার বাসাবাড়ি কিংবা কার্যালয়ে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে জেল-জরিমানার মতো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম। এছাড়া যেসব পরিত্যক্ত বস্তুতে এডিস মশার লার্ভা জমে, সেগুলো বিভিন্ন দামে কিনে নিচ্ছে ডিএনসিসি।
এদিকে ডেঙ্গু রোগীর বাড়িসহ আশপাশের এলাকায় সচেতনতা কার্যক্রম জোরদার করতে কাউন্সিলরদের আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার (১৬ মে) দুপুরে রাজধানীর গুলশান-২ নগর ভবনের হলরুমে ২৭তম করপোরেশন সভার আলোচনায় তিনি এ আহ্বান জানান।
ডিএনসিসি মেয়র বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগীর তালিকা অনুযায়ী, তাদের ঠিকানা সংগ্রহ করে রোগীর বাড়িসহ আশপাশের এলাকায় ব্যাপকভাবে সচেতনতা কার্যক্রম চালাতে হবে।’
কাউন্সিলরদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘আপনারা নিজ নিজ ওয়ার্ডের ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের বাড়িতে যাবেন, খোঁজ নেবেন। তাদের আশপাশের মানুষদের সচেতন করবেন।’
মেয়র আরও বলেন, ‘স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, রাজনীতিবিদ, ইমাম, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সবাইকে নিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে করণীয় সম্পর্কে মতবিনিময় সভা করতে হবে। সচেতনতামূলক র্যালি করতে হবে।’
আরও পড়ুন: