X
শনিবার, ১৭ মে ২০২৫
৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

নীলফামারীর দর্শনীয় পাঁচটি স্থান

তৈয়ব আলী সরকার, নীলফামারী
২৫ আগস্ট ২০১৮, ১৬:৫০আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০১৮, ১৬:৫০

নীলফামারীতে দর্শনীয় স্থানের যেন অভাব নেই! এর মধ্যে পাঁচটি স্থাপনা সারাদেশে জনপ্রিয়। এগুলো হলো নীল সাগর, তিস্তা ব্যারাজ, নীলকুঠির, চিনি মসজিদ ও কুন্দুপুকুর মাজার। এগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। জেলায় ছোটবড় সব বয়সীদের ঘুরে দেখার মতো আরও আছে ভিমের মায়ের চুলা, পাল রাজার বাড়ি, হরিশ্চন্দ্র রাজার বাড়ি, দেশের সর্ববৃহৎ সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা। নীলসাগর ভ্রমণের জন্য সবাইকে সাদর আমন্ত্রন জানিয়েছে নীলফামারী জেলা প্রশাসন।

নীলসাগর দীঘির প্রবেশমুখ নীলসাগর
সমুদ্র নয়, তবে সমুদ্রের নামের সঙ্গে মিল রেখে ১৯৮০ সালে নামকরণ হয়েছে ‘নীলসাগর’। এর আয়তন ৯৩.৯০ একর। তবে গভীরতা আজও কেউই নির্ধারণ করতে পারেনি। ধারণা করা হয়, সারাবছর ৮০ থেকে ৮৫ ফুট পানি থাকে এখানে। সাগরপাড়ে আছে বৃক্ষরাজি তরুলতা, সুউচ্চ পাড় বেষ্টিত বেত বন ও গুল্মলতা। শীতের দিনে অতিথি পাখির কলতানে মুখর হয়ে ওঠে এই এলাকা।

জনশ্রুতি আছে, ২০০ বছর আগে বিরাট রাজার গরুকে পানি দিতে দীঘিটি খনন করা হয়েছিল। হিন্দু সম্প্রদায়ের মহাভারতে বর্ণিত বিরাট রাজা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে নিহত হলে তাকে এর পাড়ে সমাহিত করা হয়। আবার অনেকের ধারণা, ওই রাজার একমাত্র মেয়ে বিন্নাবতীর স্নানের জন্য দীঘিটি খনন করা হয়। তার নামানুসারে এর নামকরণ হয় ‘বিন্নাদীঘি’।

নীলসাগর রেস্টহাউস ১৯৮০ সালে এই দীঘি আধুনিকায়ন করেন নীলফামারীর তৎকালীন জেলা প্রশাসক আব্দুল জব্বার। সংস্কার কাজের উদ্বোধনকালে তিনি এর নাম দেন ‘নীলসাগর’। এই স্থানের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, পত্রিকা, যানবাহন, এমনকি নীলফামারী-ঢাকাগামী আন্তঃনগর ট্রেনের নামকরণ হয়েছে।

বিনোদন কেন্দ্রটি জেলা শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে নীলফামারী-দেবীগঞ্জ-পঞ্চগড় পাকা সড়কের পাশে অবস্থিত। জেলা শহর থেকে ভ্যান, অটোরিকশা, বাস, মাইক্রোবাস, ট্রেনে যোগাযোগের সুব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া আকাশপথে সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে বাস বা ট্রেনে আসা যায়।

বর্তমানে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় এখানে মাছ ও অতিথি পাখির অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হয়েছে। শিশুদের জন্য রয়েছে বিনোদনের ব্যবস্থা। পর্যটকদের জন্য আবাসিক সুবিধাসহ বিভিন্ন ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া নীলফামারী মিউজিয়ামের কাজ নির্মাণাধীন রয়েছে। এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।

তিস্তা ব্যারাজ তিস্তা ব্যারাজ
প্রতিদিন বিপুল দর্শনার্থীর সমাগমে মুখর হয়ে ওঠে এই এলাকা। ব্যারাজটি একনজর দেখার জন্য কুড়িগ্রাম, রংপুর, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও বগুড়া জেলার ভ্রমণপিপাসুরা প্রতিদিন ভিড় করে। বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী তিস্তা। এটি ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর বাংলাদেশে এসে তিস্তা ব্র‏হ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

তিস্তা নদীর মোট দৈর্ঘ্য ৩১৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১১৫ কিলোমিটার বাংলাদেশ ভূখণ্ডে লালমনিরহাট জেলায় অবস্থিত। আর দর্শনীয় ব্যারাজটি তিস্তা সেচ প্রকল্পের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত বৃহত্তম সেচ প্রকল্প। নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৫ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর উত্তরাঞ্চলের খরাপীড়িত এলাকা হওয়ায় ১৯৩৭ সালে তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। তবে এর মূল পরিকল্পনা করা হয় ১৯৫৩ সালে।

বুড়ি তিস্তা নদীটি আগে তিস্তা নদীর মূলধারা ছিল। কিন্ত কালক্রমে তিস্তার গতিপথ পরিবর্তন হলে এটি শাখা নদীতে পরিণত হয় ও নাম ধারণ করে বুড়ি তিস্তা নদী। এটি ডিমলা উপজেলা বালাপাড়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। নদীটি গঙ্গাচড়া উপজেলায় গিয়ে পুনরায় তিস্তা নদীতে মিলিত হয়েছে।

নীলকুঠির
কৃষক বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, তেঁভাগা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ নীলফামারীর ইতিহাসে গৌরবময় কিছু অধ্যায়। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে মৌজা নটখানায় নীলচাষের একটি বৃহৎ খামার ছিল। ১৮৪৭-৪৮ খ্রিস্টাব্দে নীলচাষে লোকসান হওয়ায় কৃষকরা মুখ ফিরিয়ে নেয়। এতে নেমে আসে নিরহ কৃষকদের ওপর নিপীড়ন, নির্যাতন ও অত্যাচার। ১৮৫৯-৬০ সালে কৃষকদের ব্যাপক আন্দোলনের ফলে নীলচাষ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তখন এলাকা ছেড়ে নীলকরেরা পালিয়ে যায়। সেই নীলখামার থেকে নীলখামারী আর বর্তমানে নীলফামারী নামের সার্থকতা লাভ করে। তাই জেলাবাসীর মুখে মুখে বহমান- ‘নীলখামারের নীলখামারী-নীল বিদ্রোহে আজ নীলফামারী।’

এ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তা, বুড়িখোড়া নদী, বুড়ি তিস্তা, ইছামতি, চাঁড়ালকাটা, সর্বমঙ্গলা, যমুনাশ্বরী, সালকী, কুমলাইসহ অনেক নদ-নদী। ইতিহাস থেকে জানা যায়, জেলা শহরের উপকেন্দ্রে সর্বমঙ্গলা নদীর তীরে শাখা ও মাছা নামক দুটি বন্দর ছিল। সেগুলো থেকে নীলকরদের মালামাল আমদানি ও রফতানি হতো। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ মে জেলার ডিমলার বাগডোগরায় মহকুমার প্রথম কার্যক্রম শুরু হয়। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মে স্থানান্তর করে বর্তমান জেলা প্রশাসকের বাসভবন সংলগ্ন সুউচ্চ টিনের ভবনটিকে মহকুমা দফতর স্থাপন করা হয়। সেই সময় ২১৪ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে নীলফামারী সদর থানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। কালের বিবর্তনে মহকুমা শহরে ১৯৬৮ সালে স্থাপিত করা হয় টাউন কমিটি। ১৯৮৩ সালে মহকুমা থেকে জেলায় রূপান্তরিত হয় নীলফামারী।

জানা যায়, দুই শতাধিক বছর পূর্বে এই অঞ্চলে নীল চাষের খামার স্থাপন করেন ইংরেজরা। এখানকার উর্বর মাটি নীল চাষের উপযোগী হওয়ায় দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় এ জেলায় অসংখ্য নীলকুঠি ও নীল খামার গড়ে ওঠে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই দুরাকুটি, ডিমলা, কিশোরগঞ্জ, টেঙ্গনমারী, রামনগর, বাঙালি পাড়া বিভিন্ন স্থানে নীলকুঠি স্থাপিত হয়। সেই সময় বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের মধ্যে নীলফামারীতেই বেশি পরিমাণে শস্য উৎপাদিত হতো। উর্বর মাটির গুণে নীলকরদের ব্যাপক আগমন ঘটে এ অঞ্চলে।

ঈদ ও পূজার ছুটিসহ প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে নীলকরদের নীলকুঠি দেখার জন্য দর্শনার্থীরা ভিড় করে। এখনও নীলগাছের ছবি তোলার জন্য নীলফামারী সার্কিট হাউস চত্বরে আসে অনেকে।

চিনি মসজিদ চিনি মসজিদ
ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যের এক অপার সমন্বয় ঘটেছে সৈয়দপুরের গোলাহাটের চিনি মসজিদে। তিনটি বড় গম্বুজ ও ৩২টি মিনারের এই মসজিদ উজ্জ্বল পাথরে আবৃত। চীনামাটির টুকরো দিয়ে আঁকা এর বিভিন্ন ফুল ও গাছের নকশা সবার নজর কাড়ে। ১৮৬৮ সালে নীলফামারী সৈয়দপুর উপজেলার গোলাহাট এলাকায় স্থাপিত হয় চিনি মসজিদ। শুরুতে এটি ছিল দোতলা টিনের ঘর। ১৯২০ সালে হাজী হাফেজ আব্দুল করিম এ মসজিদ পাকা করার উদ্যোগ নেন। ১৯৬৫ সালে এর দ্বিতীয় অংশ পাকা করা হয়। ভারত থেকে আনা ২৪৩টি শংকর ও মর্মর পাথর ব্যবহৃত হয়েছে এতে। পাশেই রয়েছে শত বছরের পুরনো গির্জা । ধারণা করা হয়, এটি উত্তরাঞ্চলের প্রথম ও প্রাচীনতম গির্জা। আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ব্রিটিশদের নির্মিত নয়নাভিরাম লাল ইটের গির্জাটি।

কুন্দুপুকুর মাজার
নীলফামারী শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে কুন্দুপকুর ইউনিয়নে অবস্থিত কুন্দুপুকুর মাজার। এ এলাকায় ইসলাম প্রচার করতে আসা সুফি হযরত মীর মহিউদ্দিন চিশতির (র.) মাজার এটি। ৩০ একর জমি জুড়ে রয়েছে মাজার ও মাজার সংলগ্ন পুকুর। প্রতি বছরের ৫ মাঘ থেকে তিন দিন ওরশ অনুষ্ঠিত হয় এখানে। জনশ্রুতি আছে, ওই পুকুরের পানি পান করলে মানুষ বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি পায়। এজন্য সারাবছর বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখানে ফিরনি এনে তোবারক হিসেবে দেয়।

/জেএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মেঘনায় আবারও মরছে মাছ, কারণ অনুসন্ধান করবে পরিবেশ অধিদফতর
মেঘনায় আবারও মরছে মাছ, কারণ অনুসন্ধান করবে পরিবেশ অধিদফতর
মাগুরায় আলোচিত শিশু ধর্ষণ-হত্যা মামলায় হিটু শেখের মৃত্যুদণ্ড
মাগুরায় আলোচিত শিশু ধর্ষণ-হত্যা মামলায় হিটু শেখের মৃত্যুদণ্ড
শাহজালালের মাজারে ওরসে অশ্লীলতা বন্ধে কঠোর থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী: পুলিশ
শাহজালালের মাজারে ওরসে অশ্লীলতা বন্ধে কঠোর থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী: পুলিশ
রাশিয়ার ওপর চাপ বজায় রাখতে আহ্বান ইউক্রেনের
রাশিয়ার ওপর চাপ বজায় রাখতে আহ্বান ইউক্রেনের
সর্বাধিক পঠিত
চার দশক পর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রেসিডেন্ট পদে লড়বে বাংলাদেশ
চার দশক পর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রেসিডেন্ট পদে লড়বে বাংলাদেশ
বেবিচকের মেম্বার সিকিউরিটিকে বাহিনীতে প্রত্যাবর্তনের আদেশ
বেবিচকের মেম্বার সিকিউরিটিকে বাহিনীতে প্রত্যাবর্তনের আদেশ
গুলিস্তানে জুলাই যোদ্ধাদের সঙ্গে এনসিপি’র যুবশক্তির নেতাদের হট্টগোল
গুলিস্তানে জুলাই যোদ্ধাদের সঙ্গে এনসিপি’র যুবশক্তির নেতাদের হট্টগোল
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ উদ্বেগজনক: দ্য ডন
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ উদ্বেগজনক: দ্য ডন
কক্সবাজার থেকে উড্ডয়নের পর খুলে পড়লো বিমানের চাকা
কক্সবাজার থেকে উড্ডয়নের পর খুলে পড়লো বিমানের চাকা