সিঙ্গাপুর চাঙ্গি বিমানবন্দরে বহুল প্রতীক্ষিত জুয়েল কমপ্লেক্সের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হলো। চার বছরের নির্মাণ কাজ শেষে বুধবার (১৭ এপ্রিল) যাত্রীদের জন্য এর দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। বহুমাত্রিক ব্যবহারের উপযোগী এই ভবন চাঙ্গি বিমানবন্দরের চারটি টার্মিনালের প্রথম তিনটিকে সংযুক্ত করেছে। এ খবরে বিভিন্ন দেশের ভ্রমণকারীদের মতো স্থানীয়রা উচ্ছ্বসিত।
১ লাখ ৩৫ হাজার ৭০০ বর্গমিটার জায়গার ওপর গড়ে তোলা জুয়েলের বহির্ভাগ দেখতে ডোনাট আকৃতির। কমপ্লেক্সটির পুরোটাই স্টিলের ফ্রেমে কাচ দিয়ে ঘেরা। এর ডিজাইনার ইসরায়েলি-কানাডিয়ান স্থপতি মোশে সাফদি। এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১২৫ কোটি মার্কিন ডলার, অর্থাৎ ১০ হাজার ৫৫৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
জুয়েল চাঙ্গি বিমানবন্দর মোট ১০ তলা। এর মধ্যে পাঁচতলা বেজমেন্টে। এখানকার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ভবনের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা ১৩০ ফুট (৪০ মিটার) উঁচু ‘রেইন ভরটেক্স’। এটাই বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা ইনডোর ঝরনা। এখানে এলে যাত্রীদের মনে হবে আকাশ থেকে বুঝি জল গড়িয়ে পড়ছে! রাতে এটি আলোকিত হয়ে উঠছে নানান রঙের বাতিতে। এছাড়া বোনাস হিসেবে আছে সাউন্ড শো।
সতেজ ফরেস্ট ভ্যালিতে রয়েছে হাজারও গাছ আর বিভিন্ন উদ্ভিদ। সিঙ্গাপুরে সবচেয়ে বৃহত্তম ইনডোর গাছগাছালির সংগ্রহশালার মধ্যে এটি অন্যতম। সেখানে ল্যান্ডস্কেপ হিসেবে রয়েছে ২ লাখ ৩৫ হাজার বর্গফুট জায়গা।
জুয়েলে ২৮০টি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের বিভিন্ন পণ্য আর খাবার ও পানীয়র দোকান রয়েছে। এ তালিকায় উল্লেখযোগ্য আমেরিকান বার্গার চেইন শেক শ্যাক, যুক্তরাজ্যের লবস্টার অ্যান্ড বার্গার ও জাপানের বাইরে বিশ্বের প্রথম পোকেমন সেন্টার। ফলে এটি চমৎকার বিপণি বিতান ভাবলে ভুল হবে না।
চাঙ্গি বিমানবন্দরের নতুন সংযোজন ভ্রমণকারীদের একাধিক চাহিদা মেটাবে। ১, ২ ও ৩ নম্বর টার্মিনালকে সংযুক্ত করেছে এটি। এই তিনটি টার্মিনালের যাত্রীরা দ্রুত চেক-ইন সেবা ও ব্যাগেজ স্টোরেজের সুবিধা পাবেন। তাদের থাকার জন্য রয়েছে ১৩০ কক্ষের ‘ইওটেলেয়ার সিঙ্গাপুর চাঙ্গি বিমানবন্দর হোটেল’। এতে রয়েছে ১৩০টি রুম। এগুলোর প্রতিটি কমপক্ষে চার ঘণ্টার জন্য ভাড়া নেওয়া যাবে। এছাড়া আছে চাঙ্গি লাউঞ্জ। ৪ নম্বর টার্মিনালের যাত্রীদের অবশ্য শাটল বাস ধরতে হবে।
জুয়েলে ফ্রি ওয়াইফাই সুবিধা ছাড়াও ১২ ঘণ্টার জন্য বিনামূল্যে পাওয়ার ব্যাংক ধার নেওয়া যাবে। সময় কাটানোর জন্য রয়েছে ১১টি আইম্যাক্স সিনেমা হল। চার তলা জুড়ে হাজারও গাছ আর বিভিন্ন উদ্ভিদে পরিপূর্ণ শিসেইডো ফরেস্ট ভ্যালিতে চাইলে হাঁটতে পারবেন ভ্রমণপিপাসুরা। সিঙ্গাপুরে সবচেয়ে বৃহত্তম ইনডোর গাছগাছালির সংগ্রহশালার মধ্যে এটি অন্যতম। সেখানে ল্যান্ডস্কেপ হিসেবে রয়েছে ২ লাখ ৩৫ হাজার বর্গফুটেরও বেশি জায়গা। সবই ভরটেক্স ঝরনার চারপাশে।
চাঙ্গি বিমানবন্দর গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এয়ারপোর্ট অপারেশন্স ম্যানেজমেন্ট) জেসন গোহ বলেন, ‘যখন বৃষ্টি হবে, সেই পানিও ভরটেক্স ঝরনায় যুক্ত থাকবে। আমরা জলপ্রবাহের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করবো। ভরটেক্সের নিচে বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য ট্যাংক রাখা হয়েছে যেন আমরা তা ব্যবহার করতে পারি। বৃষ্টির পানি অতিরিক্ত হয়ে গেলে ফরেস্ট ভ্যালির গাছগাছালির জন্য তা কাজে লাগানো হবে।’
জুয়েলের মাঝখানে চাঙ্গি বিমানবন্দরের ১, ২ ও ৩ নম্বর টার্মিনালকে সংযুক্ত রাখতে রয়েছে একটি স্কাইট্রেন। এতে চড়ে ভরটেক্স পেরোনোর সময়টা নয়নাভিরাম লাগে। টপ ফ্লোরে ১৪ হাজার বর্গমিটারের ক্যানোপি পার্কে আছে খেলার মাঠ, থিমযুক্ত বাগান, হাঁটাচলার পথ ও রেস্তোরাঁ। পার্কে এ বছরের মাঝামাঝি চালু হবে ৫০ মিটারের ক্যানোপি ব্রিজ (ওয়াকিং নেট), স্কাই নেটস (২৫০ মিটারের বাউন্সিং নেট), ক্যানোপি মেজেস ও ডিসকভারি স্লাইডস। এর মধ্যে দুটি মেজের নকশা করেছেন বিখ্যাত ডিজাইনার আড্রিয়ান ফিশার।
‘সিটি ইন অ্যা গার্ডেন’ হিসেবে সিঙ্গাপুরের খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। তাই বাগানের আমেজ রেখে সাজানো হয়েছে জুয়েল। স্থানীয়দের জন্যও এখানে আছে বিশেষ ব্যবস্থা। উড়োজাহাজে চড়া কিংবা প্রিয়জনকে অভ্যর্থনা জানানোর তুলনায় বেশিরভাগ মানুষই বিমানবন্দরে শুধুই বেড়াতে যাওয়া আনন্দদায়ক মনে করেন না। তবে চাঙ্গির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। সিঙ্গাপুরের মূল শহর থেকে আধঘণ্টারও কম দূরত্বে এই বিমানবন্দরে খাওয়া কিংবা সিনেমা উপভোগের জন্য যাওয়া যাবে অনায়াসে। বিয়ের ছবি তোলার জন্য জায়গাটি জুতসই বলে মনে করে চাঙ্গি বিমানবন্দর গ্রুপ। তাদের প্রত্যাশা, ছুটির দিনে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে জুয়েল হয়ে উঠবে জনপ্রিয় স্পট।
বিশ্বের ব্যস্ততম বিমানবন্দরগুলোর তালিকায় চাঙ্গি বিমানবন্দর সপ্তম। এর চারটি টার্মিনালে ২০১৮ সালে রেকর্ডসংখ্যক ৬ কোটি ৫৬ লাখ যাত্রী আসা-যাওয়া করেছে। এতে ১০০টি এয়ারলাইনস ফ্লাইট কার্যক্রম চালায়। ফলে প্রতি ৮০ সেকেন্ড পরপরই উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণ করে। বিশ্বের ৪০০ শহরে যাতায়াতের বড় হাব এটাই। যাত্রীর চাপ ক্রমে বেড়ে চলায় ৫ নম্বর টার্মিনাল তৈরির পরিকল্পনা করেছে চাঙ্গি বিমানবন্দর গ্রুপ। এটি আগের চারটি টার্মিনালের মোট আয়তনের সমান হবে! ২০৩০ সালে নতুন ভবন চালু হতে পারে। এ বছরের শেষ প্রান্তে ২ নম্বর টার্মিনাল বর্ধনের কাজ শুরু হবে।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্য ভিত্তিক এভিয়েশন শিল্প সমালোচক প্রতিষ্ঠান স্কাইট্র্যাক্সের জরিপে বিশ্বের সেরা বিমানবন্দর নির্বাচিত হয় চাঙ্গি। টানা সপ্তমবারের মতো এই স্বীকৃতি পেলো এটি। স্কাইট্র্যাক্স ওয়ার্ল্ড এয়ারপোর্ট অ্যাওয়ার্ডসে গত ২০ বছরে সব মিলিয়ে ১০ বার সম্মানটি পেলো চাঙ্গি বিমানবন্দর। জুয়েলের সুবাদে চাঙ্গি টানা আট বছরের মতো বিশ্বের সেরা বিমানবন্দর হয়ে গেলে অস্বাভাবিক লাগবে না!
সূত্র: সিএনএন
আরও পড়ুন-
চাঙ্গি বিমানবন্দরে ১০ হাজার ৪৮০ কোটি ৭৫ লাখ টাকার ঝরনা ও বনাঞ্চল
সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি সপ্তমবারের মতো বিশ্বের সেরা বিমানবন্দর নির্বাচিত