X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১
ট্রাভেলগ

ভরা বর্ষায় বাঘবিয়ান ও নাপিত্তাছড়া ঝরনা

রিয়াসাদ সানভী
২৮ জুলাই ২০১৮, ২০:১৫আপডেট : ২৮ জুলাই ২০১৮, ২১:২১

বাঁয়ে বাঘবিয়ান, ডানে নাপিত্তাছড়া ঝরনা (ছবি: শামীমা মিতু) রাতের শেষ সময়। মিরসরাইয়ের নয়দুয়ারী বাজার। বৃষ্টি না থাকলে এ অঞ্চলের ঝরনাগুলোর বিশেষ একটা পাত্তা থাকে না। ঢাকা ছাড়ার সময় দেখে এসেছি পরিষ্কার আকাশ। আগের কয়েকদিনে প্রকৃতির একঘেঁয়েমিপনায় বর্ষাকাল যে চলছে, তা বোঝা ছিল মুশকিল। আশঙ্কা নিয়েই রওনা দিয়েছিলাম। মধ্যরাতের পর কুমিল্লার সীমানা পেরোতেই বাসের জানালা গলে ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা লাগলো। সঙ্গে বৃষ্টির বড় বড় সিঁদুরে ফোঁটা।

খুব ভোরে যখন নয়দুয়ারী বাজারে নামলাম, ততক্ষণে পুরো মিরসরাই এলাকা বৃষ্টিতে কাকভেজা। চোখ চকচক করে উঠলো। আমরা এমন কয়েকটি ঝরনার খোঁজে চলেছি, যার পথ অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী অনেকে হয়তো জানেন। কিন্তু বেশিরভাগেরই তা অজানা। বেশ কয়েকদিন আবহাওয়া বৃষ্টিহীন থাকায় আশঙ্কা ছিল— ঝরনাকে হয়তো তার যৌবনারূপে দেখা নাও যেতে পারে। কিন্তু সেই আশঙ্কাকে ধুয়ে দিলো বৃষ্টি।

নয়দুয়ারী এলাকা তখনও ঘুমে আচ্ছন্ন। এই বৃষ্টিমাখা আদুরে ভোরে কেইবা বিছানা ছেড়ে উঠতে চায়! আমরা নেহাতই অপরিচিত এ জায়গায়। স্থানীয় কাউকে সঙ্গে নেওয়ার উপায় নেই। সহায় বলতে কয়েকদিন আগে ঘুরে যাওয়া এক বন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া রোডম্যাপের একটুকরো কাগজ। সেটুকু সম্বল করেই টিপরাখুমের পথ ধরলাম।

বৃষ্টি-কাদায় মাখামাখি গ্রামীণপথ পেরিয়ে, ধানক্ষেত পেছনে ফেলে পূর্বদিকে চোখ মেলে তাকাতে দেখি সবুজ পাহাড়ের সারি। মীরসরাইয়ে এসে কেউ যদি পাহাড়ে যেতে চান তাহলে পূর্বদিকে সোজা হাঁটা দিলেই চলবে। আমরাও চলেছি সেদিকেই। টিপরাখুম গেলে গাইড হিসেবে কাউকে পাওয়া যেতে পারে— এমন আশা মনের ভেতর রেখেছি। বৃষ্টি কিছুটা ধরে এসেছে। ঝরনার একটি ব্যাপার লক্ষণীয়। বৃষ্টি হোক না হোক, আকাশ মেঘলা থাকলেই জলপতন গতি পায়। ভোরের হাওয়া গায়ে মাখতে মাখতে পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের কোলে ডানা মেলে থাকা টিপরাখুম। মূলত ত্রিপুরা আদিবাসীদের বসবাস সেখানে। এজন্যই জায়গাটির এমন নাম। অবশ্য আশেপাশের বেশ কয়েকটি ঘরে বাঙালিরাও থাকে।

এ পথ ধরেই উঠে যেতে হবে নাপিত্তাছড়া ঝরনার দিকে (ছবি: শামীমা মিতু) ‘মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি’র মতো আমরা পেয়ে গেলাম শাহাদতকে। আমাদের নিয়ে যেতে রাজি হলেন তিনি। বিনিময়ে কিছু টাকা দিতে হবে। পাহাড় থেকে ঝিরি নেমে এসে লোকালয়ের দিকে গেছে। টিপরাখুম থেকে সেই ঝিরি ধরে এগোতে লাগলাম আমরা। ঝিরিতে অসংখ্য ছোট-বড় পাথর। কিন্তু চড়াই-উতরাই না থাকায় চলতে অসুবিধা হচ্ছিল না। মিনিট বিশ-পঁচিশেক হেঁটেই দেখা পাওয়া গেলো দিনের প্রথম বিস্ময়ের। পাথরের মসৃণ দেয়াল নেমে এসেছে ঝিরি পথে। সেটি বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলধারা। শাহাদত বললেন, ‘এর নাম ছোট নাপিত্তাছড়া ঝরনা। ঘণ্টাখানেক আগে বৃষ্টি হলেও কেন জানি না জলধারা জোরালো নয়। ভরা বর্ষায় এ রূপ আরও চোখধাঁধানো হওয়ার কথা।’

এরপরের গন্তব্য বান্দরখুম। ছোট নাপিত্তাছড়া ঝরনা পেরিয়ে যেতে হবে সেখানে। এবার কিন্তু খাড়া পাহাড় বাইতে হবে। আমরা এই পথই বেছে নিলাম। বৃষ্টি তখন আবার চেপে এসেছে। নাপিত্তাছড়া ঝরনার উৎসমুখের পাশেই পাহাড় উঠে গেছে আকাশমুখী হয়ে। পিচ্ছিল সেই পথ মনে কিছুটা ভয় ধরালেও অ্যাডভেঞ্চারের ঘ্রাণ পেয়ে সাহস হলো। পাহাড়ে খাড়াভাবে উঠতে সঙ্গীরা পটু না হলেও হাল ছাড়লো না। উঠে চললো। সামনেই বান্দরখুম। ওপরে উঠে এ এলাকার আকাশরেখার দেখা মিললো। ভরা বর্ষা মৌসুম, সবুজে পুরোপুরি সবুজময় চারপাশ। এ দৃশ্য মুগ্ধ করে সবসময়।

আমরা একটি পথও পেয়ে গেলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম এ পথেই এগোবো। এবার ট্রেইল ধরে এগোতে লাগলাম। যদিও দশ মিনিটের মধ্যেই আবার নামতে হলো ঝিরিতে। এ পথে খুব ঝক্কি পোহাতে হয়। অনেক মানুষের চলাচলের কারণে কাদা হয়ে গেছে প্যাঁচপ্যাঁচে। এ ধরনের ট্রেইলে একদিনে বেশি মানুষ যাতায়াত না করা ভালো। প্রকৃতিরও নিজস্ব সহ্যক্ষমতা বলে কিছু আছে।

বান্দরখুম ঝরনার ছবি ফেসবুকের সুবাদে আগেই দেখা ছিল। প্রথম দেখাতেই তার রূপ শিহরণ জাগিয়েছে। সেই উত্তেজনা বাকিটা পথ আচ্ছন্ন করে রাখায় দূরত্বটা কষ্টের কারণ হয়নি। ঝিরিতে বেশ পানি। পায়ের পাতা ছাড়িয়ে সেই স্রোত মাঝে মধ্যে উঠে আসছে হাঁটু পর্যন্ত। পিচ্ছিল পাথর সমস্যা করছিল খানিকটা। বেশ বড় কয়েকটি পাথর পেরোতেই খানিক দূরে গাছের ফাঁকে চোখে পড়লো বান্দরখুম ঝরনার ওপরের অংশ। মুহূর্তে আমাদের মধ্যে উঠলো সমবেত চিৎকার। অনিন্দ্য সুন্দর কিছুর সামনে দাঁড়ালে বুঝি এটা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। সামনে আকাশের পানে উঠে যাওয়া দুই পাহাড়ের বুক চিরে নেমে এসেছে ঝরনাধারা। নেমে আবার নিচের পাথরে পড়ে ভাগ হয়ে গেছে তিনটি ধারায়। পানি বেশি হলে অবশ্য এসব ভাগাভাগির প্রশ্ন নেই।

চোখের সামনে যা দেখছি তার সৌন্দর্যের তারিফ না করলে সুন্দরের প্রতি অসম্মান দেখানো হবে। ঝরনাধারার সামনে বিভিন্ন পাথরে বসে আমরা ততক্ষণে ধ্যানী একেকজন। অসাধারণ এ ঝরনাধারার বৈচিত্র্য। বৃষ্টি থেমে গেছে। মেঘ সরে ততক্ষণে দেখা দিয়েছে রোদের রেখা। কী আশ্চর্য! নরম রোদের আঁচ জলের গায়ে পড়ে যেন রঙধনুর মতো উদ্ভাসিত হলো।

বৃষ্টিধোয়া পাথুরে চড়াই (ছবি: শামীমা মিতু) ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার ঘরে। এরই মধ্যে দুটি ঝরনা দেখা সারা। বিস্ময়ের বাকি আছে তখনও। গাইড শাহাদত জানালেন, কাছাকাছি আছে আরেকটি ঝরনা। এর উচ্চতা নাকি আরও বেশি। একসময় এ পাহাড়ি এলাকায় বাঘের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল। মানুষের উপদ্রবে বাঘ পালিয়েছে। মুখে মুখে এখনও শোনা যায় সেসব গল্প। বাঘবিয়ান ঝরনার নামটি নিশ্চয়ই রাজকীয় এ প্রাণীর কোনও শাবক জন্মের উপাখ্যান থেকে আসা।

ঝিরি ধরে আবারও শুরু করলাম হাঁটা। তবে এ পথের একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য নজরে এলো। ফেলে আসা ঝিরিপথে প্রচুর পাথর থাকলেও বাঘবিয়ান ঝরনায় যেতে চোখে পড়লো মসৃণ ঝিরি পথ। যেন শান বাঁধানো পথে বয়ে চলেছে জলধারা। সূর্যের আলোর প্রতিবিম্বে চিকচিক করছে। খুব বেশি সময় লাগলো না যেতে।

বাঘবিয়ানের সামনে দাঁড়িয়ে আরেকবার বিস্মিত হওয়ার পালা। এখানে জলধারার জোর বান্দরখুমের চেয়ে কম। কিন্তু বিশাল দুই পাথুরে দেয়ালের মাঝ দিয়ে নেমে আসা এ ঝরনাধারা অন্যরকম অনুভূতি সৃষ্টি করে। সামনে আর যাওয়ার কোনও পথ নেই। অসীম নীরবতার মাঝে অবিশ্রান্ত ঝিঁঝির ডাক ধ্যানমগ্ন হওয়ার জুতসই জায়গা। বুনো ঘ্রাণ ছড়িয়ে থাকা স্যাঁতস্যাঁতে এ পরিবেশে একটু স্থির হয়ে বসলে ভালো। আমাদের এসব বোঝায় কে! শুরু হলো হইচই। ঝরনার সৌন্দর্য, সঙ্গে চকোলেট বার ও বিস্কুটে ক্লান্তি ভুললাম কেবল। পাথরে পিছলে এক সহযাত্রী খানিক আহত হওয়ায় টিপরাখুমে ফিরতে পথ ধরতে হলো। শাহদাতকে বিদায় দিয়ে রেললাইন পেরিয়ে ধরলাম গ্রামের পথ।

ঝরনার আহ্বানে এগোচ্ছেন পর্যটকরা (ছবি: শামীমা মিতু) পরামর্শ
এসব ঝরনায় যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় এখন অর্থাৎ বর্ষাকালে। ঢাকা থেকে যারা যেতে চান তারা আগের দিন রাতের বাসে রওনা দিলে ভোরে পৌঁছে যাবেন মিরসরাই বাজারে। চট্টগ্রামমুখী যে কোনও বাসে যাওয়া যায়। চট্টগ্রামে যেকোনও বাস মহাসড়কের পাশেই নয়দুয়ারী বাজার হয়েই যায়। সেখান থেকে সোজা রাস্তা চলে গেছে টিপরাখুম। কোনও কিছু ভাবার প্রয়োজন নেই। হেঁটে সময় লাগবে ৪৫ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা। সেখান থেকে গাইড নিয়ে নাপিত্তাছড়া ট্রেইলে।

একদিনে জনপ্রতি খরচ হবে ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। তবে একটি ব্যাপারে খুব সাবধান থাকতে হবে। সেখানকার কুপিকাটা কুমে পড়ে বেশ কয়েকজনের মৃত্যু ও আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তাই ট্রেইলে চলতে সাবধানতার মার নেই। আর অবশ্যই ময়লা-আবর্জনা ফেলবেন না। চাইলে পাশের বড় তাকিয়ার খৈয়াছড়া ঝরনা দেখা সম্ভব একদিনে।

/জেএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
এক্স সিরামিকসের চিফ ব্র্যান্ড অফিসার শান্ত
এক্স সিরামিকসের চিফ ব্র্যান্ড অফিসার শান্ত
‘প্রচণ্ড গরমে গায়ের চামড়া যেন পোড়াচ্ছিল'
‘প্রচণ্ড গরমে গায়ের চামড়া যেন পোড়াচ্ছিল'
রেসিপি: চিকেন কিমা পুরি
রেসিপি: চিকেন কিমা পুরি
লাঙ্গলবন্দে স্নানোৎসবে এসে ব্রহ্মপুত্রে ডুবে শিশুর মৃত্যু
লাঙ্গলবন্দে স্নানোৎসবে এসে ব্রহ্মপুত্রে ডুবে শিশুর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদির ‘ঈদের চিঠি’ ও ভারতে রেকর্ড পর্যটক
শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদির ‘ঈদের চিঠি’ ও ভারতে রেকর্ড পর্যটক
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ঘরে বসে আয়ের প্রলোভন: সবাই সব জেনেও ‘চুপ’
ডাবের পানি খাওয়ার ১৫ উপকারিতা
ডাবের পানি খাওয়ার ১৫ উপকারিতা
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১৩ জনের
ফরিদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো ১৩ জনের
‘মাঠে আমার শরীর কেউ স্পর্শ করতে পারেনি’
‘মাঠে আমার শরীর কেউ স্পর্শ করতে পারেনি’