আইসিসি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের জন্য প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডে গিয়ে এমনিতেই রোমাঞ্চিত ছিলাম। দুটো শহর ঘুরে ব্রিস্টলে গিয়ে তা যেন ভিন্নমাত্রা পেলো। নতুন শহর, নতুন হোটেল; এ কারণে কিছুটা দুশ্চিন্তা তো ছিলই। তবে সবকিছু নিমিষেই সমাধান করে দেন একজন। তিনি শোয়েব কবির। লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। স্টেডিয়াম থেকে হাটা দূরত্বে আমাদের সাংবাদিকদের সাতজনের একটি দলের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট বুকিং করে দিলেন। শুধু তাই নয়, বাস স্টপেজ থেকে হোটেলে পৌঁছানোর জন্য ব্রিস্টলে বসবাসরত ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম ভাইকেও আমাদের দেখভাল করতে বলে রাখলেন।
কার্ডিফ থেকে বাসে ব্রিস্টলের উদ্দেশে ৯ জুন সকালে রওনা দেই আমরা। লন্ডন যদি ইতিহাস, ঐতিহ্য, আভিজাত্য, আধুনিকতার সর্বোচ্চ নিদর্শন হয়; তাহলে ব্রিস্টল হচ্ছে পাহাড় আর নদীর শহর। নাগরিক কোলাহল থেকে দূরে ছিমছাম, পরিপাটি, সাজানো-গোছানো ছোট্ট একটি শহরে মন জুড়িয়ে যায়। রোমাঞ্চকর সাসপেনশন ব্রিজ, ভারতীয় সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়ের সমাধি আর সাবেক ইংরেজ অধিনায়ক ডব্লিউ জি গ্রেসের স্মৃতিধন্য ডাউনএন্ড।
বাসে বসে দু’পাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখছি। রাস্তার দুই দিকে দাঁড়িয়ে থাকা গাছপালা, ঝোপঝাড়ে বাতাসের মৃদু দোলা চমৎকার লাগলো। বাসচালক বাছাইকৃত সুন্দর সুন্দর গান বাজিয়ে সবাইকে আনন্দে রাখলেন। কার্ডিফ থেকে ব্রিস্টল বিরতিহীনভাবে পৌঁছালাম। ভীরু মনে নতুন শহরে পা রেখেছিলাম, সেটা আরও বেড়ে গেলো বৃষ্টির কারণে! প্রায় আধঘন্টার বৃষ্টিতে বাসস্টপের এককোণে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা। আমাদের আসার কথা কামরুল ভাই জানতেন। তিনি দ্রুত আমাদের জন্য দুটি গাড়ি পাঠালেন। সেগুলোতে চেপে বুকিং দেওয়া নির্ধারিত অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছালাম। ঘরটা বেশ ছিমছাম আর সাজানো গোছানো। এককথায় সুন্দর অ্যাপার্টমেন্ট।
মধ্যবয়সী এক নারী এসে দরজা খুলে দিলেন। প্রথমে পুরো বাড়ি ঘুরিয়ে দেখালেন। এরপর কিছু চাবি হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘আগামী কিছুদিন এই বাড়ির মালিক তোমরা!’ নিক নামের এই ভদ্রমহিলা বাড়িটি কেয়ারটেকার। নিচতলার বাথরুমটা বেশ আকর্ষণীয়। এর চারদিক বই-পুস্তকে টাসা। বাথরুমে বসে সময় কাটাতে বই পড়ার সুবর্ণ সুযোগ পাওয়া যাবে বুঝলাম!
হোটেলে ব্যাগ-লাগেজ রাখতেই কামরুল ভাই চলে এলেন। তাকে দেখে অচেনা শহর নিয়ে জড়ো হওয়া ভয় নিমিষেই উড়ে গেলো। তিনি বললেন, ‘চলেন আপনাদের সুন্দর একটি জায়গায় নিয়ে যাই।’ তার কথা অনুযায়ী আমরা দুটো গাড়িতে চেপে বসলাম। দু’পাশে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে করতেই পৌঁছে গেলাম ক্লিফটন সাসপেনশন ব্রিজের কাছে।
শহর থেকে প্রায় ২০ মিনিটের রাস্তা। ব্রিস্টলের উঁচু-নিচু ও আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে সেখানে পৌঁছালাম আমরা। অ্যাভন নদীর দুই প্রান্তে ভারি লোহার পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সেতুটি। ১৮৬৪ সালে এটি গড়ে তোলা হয়। এর ডিজাইনার ছিলেন উইলিয়াম হেনরি বারলো ও জন হোকশো।
সানপেনশন ব্রিজের দৈর্ঘ্য ৪১২ মিটার। নদীর পানি থেকে উচ্চতা ১০১ মিটার বা ৩৩১ ফুট। ইংল্যান্ডের প্রাচীনতম আধুনিক সেতু এটি। প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শত শত পর্যটক এই সুউচ্চ সেতু দেখতে আসেন। পর্যটনের পাশাপাশি বৈশ্বিক ক্রীড়া আলোচনায় ব্রিজটি চিরস্মরণীয়। ২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিকের মশাল নিয়ে পথচলার শুরুটা হয়েছিল এখান থেকে। তাছাড়া নিরাপদে ওপর থেকে নিচে লাফিয়ে পড়া বাঙ্গি জাম্পের শুরুটাও এখানেই, ১৯৭৯ সালে। মূলত বাঙ্গি জাম্পই সাসপেনশন ব্রিজকে এনে দিয়েছে বিশেষ পরিচিতি। সেতুর চারদিক অপূর্ব। ছায়াঘেরা পথ। তাকালে ভয় লাগে। নিচ দিয়ে ছুটে যাওয়া গাড়ি ও ভবনগুলো খুব ছোট দেখা যায়।
চারপাশে চোখ রাখতেই কাটতে লাগলো বিষণ্ণতা ও ক্লান্তি। একপাশে পাহাড় ও জঙ্গল, অন্য প্রান্তে ঝুলন্ত সেতু। ব্রিজের আগে বাঁ-পাশ দিয়ে একটা রাস্তা গেছে। ওদিকে গাড়ি পার্ক করে সন্ধ্যা নামার আগে ব্রিজের ওপর গেলাম আমরা। তাই কৃত্রিম আলোর শহর উপভোগ করতে পেরেছিলাম। ওপরে নীল আকাশ, নিচে ধরণীতে এমন বিস্ময়কর ব্রিজ! সেখানে সবাই বেশকিছু ছবি তুললাম। কেউবা ক্যামেরাবন্দি করলেন চারদিকের মনোরম দৃশ্যগুলো।
৩১ ফুট চওড়া এই সেতুতে যানবাহনের জন্য দুটি লেন আর পথচারী পারাপারের জন্য দুটি লেন রয়েছে। কেউ ভুল করে হাঁটার লেন রেখে রাস্তা পেরোতে চাইলে জরিমানা গুনতে হয়। কোনও গাড়ি সেতুতে উঠলে টোল দিতে হয় মাত্র ১ পাউন্ড!
এখানে ঘুরতে আসা ভ্রমণপ্রেমীদের সার্বক্ষণিক নজরে রাখেন নিরাপত্তাকর্মীরা। কারণ এই সেতু থেকে লাফ দিয়ে মোট ১২৯ জন আত্মহত্যা করেছিল। যদিও সেই সংখ্যা এখন কমে এসেছে। পুরো ব্রিজে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকেন স্বেচ্ছাসেবকরা। কারও গতিবিধি সন্দেহজনক হলে তড়িঘড়ি ব্রিজ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় তাকে। আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে অনেকে আসে বলেই বাড়তি নজরদারি করেন নিরাপত্তাকর্মীরা। এখন অবশ্য সাসপেনশন ব্রিজে এসে কেউ চাইলেই আত্মহত্যা করতে পারবেন না। ১৯৯৪ সালে উচুঁ নিরাপত্তাবেষ্টনী দিয়ে সেতুটি নিরাপদ করা হয়েছে।
সানপেনশন ব্রিজে যেমন আত্মহত্যার মর্মান্তিক কাহিনি আছে, একইভাবে প্রাণে বেঁচে যাওয়ার অদ্ভুত এক গল্পও রয়েছে। সারাহ এন হেনলি নামের ২২ বছরের এক তরুণী আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। ব্রিজের যে পাশে পাহাড় অর্থাৎ সুইসাইড পয়েন্ট থেকে লাফও দিয়েছিলেন। কিন্তু অলৌকিকভাবে বেঁচে যান তিনি। তার পরা স্কার্ট প্যারাস্যুট হিসেবে কাজ করেছিল তখন। ওপর থেকে নিচে কাদার মধ্যে পড়েছিলেন সারাহ। শোনা যায়, এরপর ৮০ বছর বেঁচেছিলেন তিনি।
সেতুটিকে কেন্দ্র করে এমন সব লোমহর্ষক গল্প ও শোকগাঁথা লেখা আছে। অথচ এটি ব্রিস্টলের প্রধান দর্শনীয় স্থান! ব্রিস্টলে এসে সাসপেনশন ব্রিজের সৌন্দর্যে অবগাহন না করা বোকামির পর্যায়ে পড়ে! আমাদের দলে থাকা ইয়াসিন রাব্বি যেমন বলছিলেন, ‘আমার জীবনে এত সুন্দর দৃশ্য হয়তো আর দেখা হবে না।’ আমাদের আরেক ভাই আরিফুর রহমান বাবুর কণ্ঠেও একই উচ্ছ্বাস।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচ কাভার করতে ব্রিস্টলে চারদিন থাকতে হয়েছিল। শহরের এককোণে নির্জন, ভৌতিক অ্যাপার্টমেন্টের পাশে সন্ধ্যার পর কেমন যেন লাগতো। আশেপাশে কোনও মানুষের শব্দ শোনা যেতো না। মাঝরাতে শুধু পাওয়া যায় কাঠের মেঝেতে মচমচ করে হাঁটার আওয়াজ! কখনও কখনও ওয়াশরুম থেকে ভেসে এসেছে পানি পড়ার টুপটাপ শব্দ।
একদিন স্থানীয় একজনকে বিষয়টি জানাতেই হো হো করে হাসলেন। তিনি নিজে থেকেই বললেন, এখানে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা খুবই কম। স্বাভাবিকভাবেই আপনার কাছে ভীষণ নির্জন মনে হবে এ শহর। নির্জনতা মানেই কিন্তু ভৌতিক ব্যাপার নয়। কারণ ভৌতিক কিছু ঘটেনি এখানে। আমার অবশ্য বিশ্বাস হয়নি।
অপঘাতে কারও মৃত্যু হলে সেই মৃত আত্মা নাকি মুক্তি পায় না। অতৃপ্ত আত্মা হিসেবে সেই স্থানের আশপাশে ঘুরে বেড়ায় সেটি। ভূত-প্রেত হয়ে বারবার সামনে আসে। কখনও সুস্থ সবলকে দিয়ে ভুল করায়। কখনও নিজ থেকে মেরে ফেলে! কল্পলোকে আছে এমন অনেক গল্প। সব গল্পের রেশ বছরের পর বছর থাকে না। অনেক গল্প অবশ্য যুগ যুগ ধরে চলে। কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা তা যাচাই করতে চেয়েও অনেকে পারেননি। আবার পেরেছেনও অনেকে। এমনই এক ‘সুইসাইড পয়েন্ট’ ব্রিস্টলের ক্লিফটন সাসপেনসন ব্রিজ। বলা হয়, অতৃপ্ত অশরীরী আত্মারা এখানে ঘোরাফেরা করে। হয়তো এমন ভাবনাগুলোই মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে।
ছবি: লেখক