আত্মহত্যা ও আত্মঘাতী হামলা ইসলাম সমর্থন করে না বলে জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট আলেমরা। তাদের মতে, নিজেকে মানব বোমা বানিয়ে উড়িয়ে দেওয়া বৈধ নয়। মসজিদ তো নয়ই, গির্জা, মন্দির ও প্যাগোডাসহ অমুসলিমদের উপাসনালয়েও হামলা করা ইসলামে নিষিদ্ধ। জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী কোনও কর্মকাণ্ডই ইসলাম অনুমোদন করে না। এমনকি আত্মঘাতীদের জানাজা পড়তেও ইসলামে নিষেধ রয়েছে। এ সব কর্মকাণ্ড কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবেই ইসলাম গণ্য করে ইসলাম। এরই আলোকে দেশে শীর্ষ আলেমরা জঙ্গিবিরোধী ফতোয়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।আর ফতোয়ায় থাকছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির প্রবণতা কখনও বেহেস্ত যাওয়ার পথ হতে পারে না। এটা জাহান্নামের পথ। আত্মঘাতী হামলার মাধ্যমে নিজে মরে ও অন্যকে মেরে কখনও শহীদদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া যাবে না। বেহেস্তে যেতে হলে অবিলম্বে তওবা করে শান্তি ও হিদায়াতের পথে ফিরে আসতে হবে। শিগগিরই সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দেশের খ্যাতিমান লক্ষাধিক আলেমের কাছ থেকে এমন ফতোয়াই আসছে। ফতোয়া কমিটির প্রধান, ওলামা মাশায়েখ সংহতি পরিষদের চেয়ারম্যান ও শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ বাংলা ট্রিবিউনকে এই তথ্য জানান।
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দেওয়া ফতোয়ায় কী থাকছে—জানতে চাইলে মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দেশের প্রখ্যাত ও বিজ্ঞ মুফতি, মুহাদ্দিস ও মুফাচ্ছিরদের কাছে ১১টি প্রশ্ন রাখা হয়েছে। সে সব প্রশ্নের ভিত্তিতে তারা এর জবাব দেবেন। পাশাপাশি ফতোয়ায় স্বাক্ষর দেবেন। এরপরই আগামী ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ফতোয়াটি ঘোষণা করা হবে।
মাসউদ বলেন, দেশের আলেমদের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছে—বর্তমানে ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী গোটা পৃথিবীতে ইসলামের নামে আতঙ্ক ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করে চলেছে। তারা নির্বিচারে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে নিরপরাধ ও অসহায় নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ ও শিশুদের হত্যা করছে। এমনকি মসজিদসহ ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোয় নামাজ ও প্রার্থনারত মানুষদের হত্যা করছে। আত্মঘাতী বোমা মেরে নিজেকে উড়িয়ে দিচ্ছে। পরে তার মৃত্যুকে শহিদি মৃত্যু বলে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। এ সব হিংস্র পন্থাকে তারা জান্নাত লাভের পথ বলে বিবেচনা করছেন। এটা তারা কিভাবে দেখছেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্নগুলো হচ্ছে—শান্তির ধর্ম ইসলাম এ ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করে কিনা। নবী-রাসূল বিশেষ করে আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সা.) কী হিংস্র ও বর্বরতার পথ অবলম্বন করে ইসলাম কায়েম করেছেন? ইসলামে জিহাদ আর এ ধরনের সন্ত্রাস কি একই জিনিস কিনা? সন্ত্রাস সৃষ্টির পথ কি বেহেস্ত লাভের পথ নাকি জাহান্নামের পথ? আত্মঘাতী সন্ত্রাসীর মৃত্যু কি শহীদি বলে গণ্য হবে? ইসলামের দৃষ্টিতে গণহারে হত্যা কি বৈধ? নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ইসলাম কি সমর্থন করে? যেখানে শত্রু হলেও ঘুমন্ত ও নিরস্ত্র কোনও মানুষকে হত্যা করা যাবে না, সেখানে এবাদতরত মানুষকে হত্যা করা কি ধরনের অপরাধ? মন্দির ও গির্জাসহ অমুসলিমদের উপসানালয়গুলোয় হামলা করা কি বৈধ? সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা ইসলামের দৃষ্টিতে সব মানুষের কর্তব্য কিনা?
মাওলানা মাসউদ জানান, অভিজ্ঞ আলেমদের পরামর্শ নিয়েই এসব প্রশ্ন তৈরি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে জেলায় জেলায় কমিটি গঠন করে সারাদেশের আলেমদের কাছে এসব প্রশ্ন পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, ইসলাম কখনও সন্ত্রাস সমর্থন করে না। হিংসা, হানাহানি, সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ নির্মূল করার জন্যই এই মহান ধর্মের আবির্ভাব। শুধু মানুষ নয়, সব প্রাণি ও জীব-জন্তুর নিরাপত্তাও নিশ্চিত করেছে ইসলাম। একটি গাছের পাতাও অনর্থক কাটা ও ছেঁড়া ইসলাম সমর্থন করে না। একটি হাদিসে আছে, আল্লাহর রাসুল (সা.) প্রেম ও ভালোবাসা পরায়ণতাকে সর্বোত্তম গুণ বলে ব্যক্ত করেছেন। কোরআনে রাসুলুল্লাহকে (সা.) দুনিয়ার জন্য রহমত ও করুণা বলে অভিহিত করা হয়। তাকে সকল মানুষের কল্যাণের জন্য আবির্ভূত বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ওহুদের ময়দানে রাসুলুল্লাহ (সা.) নির্মমভাবে ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার পর কেউ কেউ অমুসলিমদের বিরুদ্ধে অভিশাপ ও বদদোয়া দেওয়ার জন্য তাকে অনুরোধ করেছিলেন বলে জানা যায়। এ অবস্থায়ও তিনি বলেছিলেন, আমাকে লা-নতকারী এবং অভিশাপদাতা রূপে পাঠানো হয়নি। আমি তো রহমত ও করুণারূপেই প্রেরিত হয়েছি। তায়েফে নির্যাতনের সময়েও তিনি তাদের হেদায়েত ও কল্যাণ কামনা করেছেন।
মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ বলেন, দেহের যদি কোনও অংশে পচন ধরে সেজন্য গোটা দেহকে নিরাপদ রাখার জন্য যেমন অপারেশনের প্রয়োজন হয়, তেমনি গোটা মানবজাতিকে রক্ষার জন্য সন্ত্রাস ও আতঙ্ক থেকে বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনে সশস্ত্র সংগ্রাম বা কিতালের অনুমোদন রয়েছে। তবে, তার সঙ্গে অনেক শর্ত যুক্ত রয়েছে। এক্ষেত্রে কোনও বাড়াবাড়ি বা সীমা লঙ্ঘন পবিত্র কোরআনে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ফতোয়ায় আরও যা থাকছে
জনমনে সন্ত্রাস ও আতঙ্ক সৃষ্টি করা হারাম ও নিষিদ্ধ। এটি কখনও বেহেস্ত যাওয়ার পথ হতে পারে না। এটা জাহান্নামের পথ। যারা ইসলামের নামে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন, তাদের যদি বেহেস্ত লাভ করতে হয়, তাহলে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের নামে জাহান্নামের পথ থেকে অবিলম্বে তওবা করে শান্তি ও হেদায়েতের পথে ফিরে আসতে হবে।
আত্মহত্যা ও আত্মঘাত ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। নিজেকে মানব বোমা বানিয়ে উড়িয়ে দেওয়া কখনও বৈধ নয়। নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে এক ব্যক্তি যুদ্ধে আহত হয়ে আত্মহত্যা করলে নবীজি (সা.) তাকে জাহান্নামী বলে ঘোষণা দেন। অন্যকোনও অপরাধ করে যদি কেউ মারা যান, তাহলে তার জানাজা পড়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু আত্মহত্যাকারীর জানাজা পড়তেও নিষেধ করা হয়েছে। সুতরাং এ ধরনের তাণ্ডব কখনও সমর্থনযোগ্য নয়। আত্মহত্যা করে যে মৃত্যুবরণ করবে সে কখনও মহান শহীদদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে না। তার মৃত্যু শহীদি মৃত্যু বলে গণ্য হবে না।
ফতোয়ায় আরও বলা হচ্ছে- ইসলামে নিরপরাধ মানুষকে গণহারে হত্যা করাও বৈধ নয়। এমনকি সন্দেহের বশবর্তী হয়েও কাউকে হত্যা করা নিষেধ। আপনাকে সন্ত্রাসী সন্দেহ করে গুলি করলাম এটাও হারাম।
যারা সশস্ত্র যুদ্ধে শরিক নন, যেমন শিশু নারী বৃদ্ধ, দুর্বল ও নিরীহ মানুষকে হত্যা করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এমনকি যুদ্ধ চলাকালীন সময়েও তাদের হত্যা করা বৈধ নয়। কিতাল বা সশস্ত্র যুদ্ধের উদ্দেশ্যে যখন মুসলিম দল বের হতেন, তখনও নবী (সা.) এ ব্যাপারে তাদের সতর্ক থাকতে কঠোরভাবে নির্দেশ দিতেন। আর যেকোনও অবস্থায় খুন করা অপরাধ। এবাদত বা প্রার্থনারত অবস্থায় কাউকে হত্যা করা এর চেয়েও জঘন্য ও মারাত্মক অপরাধ। আর এসব ক্ষেত্রে যারা অপরাধী বলে সাব্যস্ত হবেন, তাদের ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, রাষ্ট্রের সেসব প্রচলিত আইনে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রত্যেকরই নিজ নিজ শক্তি অনুযায়ী সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে প্রতিরোধ করা অবশ্যই কর্তব্য। হাদিসে আছে, তোমরা খারাপ কাজ দেখলে শক্তি থাকলে হাতে প্রতিরোধ করো (এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ)। তা যদি না থাকে তাহলে কথা দিয়ে তাদের বুঝাও (এটা হলো আলেম ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কাজ)। আর সেটাও যদি না পারো তাহলে তাকে মনে মনে ঘৃণা করো (এটা সবার জন্য)।
ফতোয়ায় বলা হচ্ছে, কোরআন মজিদে সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে নিষেধ করা হয়েছে। কোরআনের একটি আয়াতে বলা হয়েছে, সন্ত্রাস ও আতঙ্ক সৃষ্টি করো না। সন্ত্রাস ও আতঙ্ক সৃষ্টি করা মুনাফিকদের কাজ। কোরআনের ভাষায় একটি মানুষের প্রাণ রক্ষা করার অর্থ হচ্ছে গোটা মানবজাতির প্রাণ রক্ষা করা। পক্ষান্তরে একজন মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা আর গোটা মানবজাতিকে হত্যা করার নামান্তর। অন্য একটি হাদিসে বলা হয়েছে- মুসলিম হলো সে, যার ক্ষতি থেকে সকল মানুষ নিরাপদ থাকবে। সুতরাং ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর সঙ্গে সন্ত্রাসকে যুক্ত করা চরম মুনাফেকি ও মিথ্যাচার বলে গণ্য হবে। সন্ত্রাসীরা কখনও ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বন্ধু নয়। এরা সুস্পষ্ট শত্রু। তাদের বিষয়ে সতর্ক থাকা সবার কর্তব্য।
নবী ও রাসূল (সা.) ইসলাম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কস্মিনকালেও সন্ত্রাস ও বর্বরতার পথ অবলম্বন করেননি বলে ফতোয়ায় উল্লেখ করে বলা হচ্ছে, ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথ হলো দাওয়াত, মহব্বত ও প্রেমের পথ। আল্লাহর রাসূল (সা.) ও তাঁর অনুসারী সাহাবিরা প্রেম ও খেদমতের মাধ্যমে মানুষকে কল্যাণ ও হেদায়েতের প্রতি দাওয়াত দিয়েছিলেন। রাসূল (সা.) এর গোটা জীবন এর সাক্ষী। আল্লাহর রাসূল (সা.) এর কাছে একবার সাহাবিরা জানতে চেয়েছিলেন, মন্দ পন্থা অবলম্বন করে কখনও কি কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করা যায়? তিনি সুস্পষ্ট জবাব দিয়েছিলেন, না। মন্দ ও অন্যায় পন্থা অবলম্বন করে কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
জিহাদ ও সন্ত্রাস এক জিনিস নয়। জিহাদ হলো আল্লাহর একটি অন্যতম নির্দেশ। পক্ষান্তরে সন্ত্রাস হলো হারাম ও অবৈধ। জিহাদ হলো নিজের, পরিবার ও সমাজের শান্তি নিরাপত্তা ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার জন্য নিরন্তন প্রয়াস চালিয়ে যাওয়া। জিহাদ অর্থ পরিশ্রম করা। খারাপ প্রবৃত্তিগুলো সংশোধন করে সৎগুণাবলীর মানুষরূপে গড়ে তোলা সবচেয়ে বড় জিহাদ বলে হাদিসে ব্যক্ত করা হয়েছে। আল্লাহর সন্তুষ্টি, হেদায়েত ও কল্যাণের শুদ্ধ নিয়ত যদি না থাকে সেটা কখনও জিহাদ বলে গণ্য হয় না।
/এএইচ/ এমএনএইচ/