X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ও বাকশাল: যে কারণে বইটি পড়তে হবে

লীনা পারভীন
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৬:৩৩আপডেট : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৬:৩৩

না। এটি বইয়ের রিভিউ বা লেখকের প্রশংসামূলক লেখা নয়। আসলে আমার মতো যারা মুক্তিযুদ্ধ বা বঙ্গবন্ধুর শাসনামল দেখিনি, জন্মের পর যারা কেবল বঙ্গবন্ধু নয়, শুনেছিলাম শেখ মুজিবের নাম, যারা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তো পড়তেই পারিনি বরং বড় হয়ে উঠেছিলাম কিছু ভুলভাল ইতিহাস জেনে, তাদের জন্য সঠিক ঘটনা বা ইতিহাস জানার তথ্যসূত্রের বড় অভাব ছিল। পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা ছিল অত্যন্ত সাদামাটাভাবে, ঠিক যেমনটা লেখা ছিল তিতুমিরের বাঁশের কেল্লার ঘটনা। সেই ইতিহাস পড়ে আমরা কেউই বোঝার মতো জ্ঞান নিয়ে বড় হইনি যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টা কত বড় ছিল। কতটা ত্যাগের ছিল আর কতটা অর্জনের ছিল।

কোনও যুদ্ধই নেতা ছাড়া হয় না। আমরা বদরের যুদ্ধের কাহিনি পড়েছি। আমরা পানিপথের যুদ্ধের কাহিনি পড়েছি। তিতুমিরের বীরত্বের বিস্তর বর্ণনা পড়েছি। সব ঘটনাতেই কেউ না কেউ একজন নায়কের ভূমিকায় ছিলেন, যার নেতৃত্বে অর্জিত হয়েছিল ফলাফল। অথচ মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি ঘটনা কার নেতৃত্বে হয়েছিল সেটি জানতে পারিনি কোথাও। মনে হয়েছিল যেন হঠাৎ একদল মানুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাড়ায় পাড়ায় মারামারির মতো। আসলে তো তেমন ছিল না ঘটনাটা। পাকিস্তানের ২৫ বছরের শোষণ, যার শাসনের হাত থেকে বাঙালি মুক্তি চেয়েছিল। নিজের মতো করে নিজেদের ভূমিতে বাঁচতে চেয়েছিল। “স্বাধীনতা” শব্দটা অনেক অর্থ বহন করে। বাঙালি জাতি চেয়েছিল আত্মস্বীকৃতির স্বাধীনতা। আর সেই স্বাধীনতা চাওয়ার সাহসটা দিয়েছিলেন একজন ব্যক্তি, যার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি তাঁকে ভালোবেসে, আদর করে নাম দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু। অর্থাৎ, বাংলার বন্ধু। আর জাতির বন্ধু তো যে কেউ হতে পারে না। যিনি সবার ভালোমন্দের কথা বিবেচনা করেন, যিনি সবার বিপদে সবচেয়ে আগে এগিয়ে আসেন, যিনি নিজের স্বার্থকে পেছনে রেখে অন্যের জন্য এগিয়ে যাওয়ার সাহস রাখেন, তিনিই তো বন্ধু হতে পারেন।

তিনি সেই বন্ধুই তো ছিলেন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সাড়ে সাত কোটি মানুষের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি একার কাঁধে। ৭২ সালে তিনি পাকিস্তানের জেলে থেকে মুক্তি পেয়ে ফিরলেন। বাংলার বন্ধু স্বাধীন বাংলার মাটিতে প্রথম স্বাধীন নাগরিকের পরিচয়ে পা রাখলেন। কিন্তু সেই পা রাখা কি একদমই কণ্টকমুক্ত ছিল? তিনি কি এসেই আরামে নাক ডেকে ঘুমাতে পেরেছিলেন? তিনি কি দীর্ঘ কারাবাসের পরে ফিরে এসে পরিবার নিয়ে অবকাশে যেতে পেরেছিলেন? নাকি এসেই নেমে পড়েছিলেন ভাঙাচোরা দেশটিকে গড়ে তোলার কাজে? যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশে কত প্রকার চ্যালেঞ্জ থাকে সেটা কি আজকের দিনে বসে কারও পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব? একদমই সম্ভব না। কারণ, আমরা বসেই আছি আরামের একটি জায়গায়, যেখানে প্রশাসন থেকে ঘর সবকিছুর একটা কাঠামো তৈরি করা আছে। আর সেই তৈরির কাজটাই করতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে।

আমি এর কিছুই জানতাম না। জানার জন্য তথ্যসূত্র খুঁজছিলাম। পেয়ে গেলাম সুভাষ সিংহ রায় লিখিত একটি বই। ছোটবেলা থেকেই শুনেছি বঙ্গবন্ধু একনায়ক ছিলেন। একদলীয় শাসন গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন বলেই তাঁর এত শত্রু গড়ে উঠেছিল। ৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের যৌক্তিকতা খোঁজা হয় অনেকটা বাকশালের দোহাই দিয়ে।

এটা যে কত বড় একটা অপপ্রচার সেটাই বুঝতে পারলাম এই বইটি পড়ে। বাকশাল মানে হচ্ছে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। এই বাকশালের বিরুদ্ধে শুনতে শুনতে আমরা অভ্যস্ত। এখনও লোকের মুখে বাকশালের বিরুদ্ধে কথা শোনা যায়। শোনা যায় শেখ কামালের নামে অনেক প্রচারণা। কিন্তু প্রশ্ন করলে বোঝা যাবে যারা এসবের বিরুদ্ধে বা এসব প্রচারণার অংশ হয়ে কথা বলেন তাদের প্রায় ৯৯ ভাগ না জেনেই কথা বলছে। এই যে শুরুতেই বলেছি আমার মতো যারা প্রজন্ম আছে তাদের কাছে মুখের গল্পই ছিল একমাত্র তথ্যসূত্র। ছিল না কোনও পাঠ্য, না ছিলও কোনও গ্রন্থ। এই বইটিতে লেখক অত্যন্ত চমৎকারভাবেই বাকশালের পুরো বিষয়টি তুলে ধরেছেন। বাকশালের মূলনীতি ছিল মূলত বিভক্ত জাতিকে একটি সুতায় বেঁধে রাখা। বঙ্গবন্ধু যখন দেখলেন স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে দেশে অরাজকতা শুরু হলো। দেশি ও আন্তর্জাতিক পুরোনো শত্রুরা তাদের খেলা বন্ধ না করে বরং অভ্যন্তরীণ শত্রুদের দিয়ে পরোক্ষভাবে দেশে অস্থিরতা শুরু করে দিলো, তখন তিনি সঠিকভাবেই বুঝেছিলেন যে এই জাতিকে এক জায়গায় রাখতে হলে দরকার জাতীয় ঐকমত্যের সরকার। একটি সদ্য স্বাধীন দেশে এ তো বিভক্তি মানেই হচ্ছে দলাদলি ও কোন্দল। তাই তিনি বাকশালের মাধ্যমে ঘোষণা করলেন প্রশাসন, আইন ও বিচার বিভাগের মতো দেশের তিনটি প্রধান কাঠামোর রূপরেখা।

এই বইটি না পড়লে আমি জানতেই পারতাম না যে বাকশাল ছিল একটি সাময়িক চিকিৎসাপত্র। অর্থাৎ, আপৎকালীন একটি শাসন ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে সবাই মিলে একই লক্ষ্যে কাজ করে দেশকে কাঙ্ক্ষিত কাঠামোতে পৌঁছে দিয়ে তারপর আবার ফিরে যাবে প্রচলিত গণতান্ত্রিক কাঠামোতে। কী নেই এই রূপরেখায়? এই বইয়ের মাধ্যমেই আমি বাকশালের আদর্শ, উদ্দেশ্য থেকে শুরু করে একটি শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে কেমন করে দ্রুত দেশকে টেনে তোলা যাবে তার বিস্তারিত জানতে পারলাম। বঙ্গবন্ধুর প্রথম সংসদ ভাষণের পুরোটা পড়তে পড়তে আমি যেন হাঁটছিলাম টাইম মেশিনে। উনি সেইকালে যা যা বলে গিয়েছিলেন সেগুলো তো এখনও আমাদের সমস্যা। সেই লুটপাট, সেই দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, দায়িত্বহীনতা, কোন্দল। সবকিছুর নিয়ন্ত্রণেই তিনি বাকশালের সূচনা করেছিলেন। আজকে এই দিনে বসেও আমি বুঝতে পারি বঙ্গবন্ধু কতটা দূরদর্শী নেতা ছিলেন। কারণ, সেসব সমস্যা এখনও আমাদের জাতিকে পিছিয়ে দিচ্ছে। বইটির পাতায় পাতায় আমি ঘুরেছি বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে। একজন মানুষ যিনি নিজের মুখে বলছেন যে তিনি চাইলেই আরাম আয়েশের জীবনে যেতে পারতেন, কিন্তু দেশের মানুষকে অসুখে রেখে তিনি আরাম করতে পারেন না। সেই মানুষটিকে কেবল দেশকে ভালোবাসার অপরাধে সেদিন পাকিস্তানের এদেশীয় এজেন্টরা হত্যা করেছিল, অথচ সেই হত্যাকে আজও কিছু মানুষ জাস্টিফাই করতে চায়।

বাঙালির এই দ্বিচারিতাকে বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বেশি আর কে বুঝতে পেরেছিল? লিখতে গেলে অনেক লম্বা হয়ে যাবে, তবে আমি কৃতজ্ঞ লেখক সুভাষ সিংহ রায়ের কাছে। তিনি আগামীর বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল দিয়েছেন। আমরা যে ভুলের মধ্যে বড় হয়েছি, আমাদের প্রজন্ম যেন একই ভুলের শিকার না হয়। তারা যেন অন্তত চাইলেই তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে নিজেদের বিবেক বুদ্ধিকে যাচাই বাছাই করে সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে পারে সেই আশ্রয়টুকু এই বই হবে বলেই আমি মনে করি।

বইয়ের নাম: বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ও বাকশাল
লেখক: সুভাষ সিংহ রায়
প্রকাশক: সময় প্রকাশন
প্রকাশকাল: ২০২৩

 
 
/এসএএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মানব ও সুপারি পাচারের অভিযোগে ভারতে শুল্ক কর্মকর্তা গ্রেফতার 
মানব ও সুপারি পাচারের অভিযোগে ভারতে শুল্ক কর্মকর্তা গ্রেফতার 
ভুয়া পরিচয়ে ভারতে বসবাস বাংলাদেশির, ৪ বছরের কারাদণ্ড
ভুয়া পরিচয়ে ভারতে বসবাস বাংলাদেশির, ৪ বছরের কারাদণ্ড
৫ কোটি টাকা নিয়ে ব্যবস্থাপক নিখোঁজ, পূবালী ব্যাংকের ৮ কর্মকর্তাকে বদলি
৫ কোটি টাকা নিয়ে ব্যবস্থাপক নিখোঁজ, পূবালী ব্যাংকের ৮ কর্মকর্তাকে বদলি
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
সর্বাধিক পঠিত
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি