X
মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪
২৪ বৈশাখ ১৪৩১

নিজেই ক্রমশ হয়ে উঠেছিল ব্যবহৃত

উৎপলকুমার বসু
০৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৭:০০আপডেট : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৭:০০

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবন বিপুল সৃষ্টি ও বৈচিত্রে ভরপুর। মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে লিখেছিলেন উৎপলকুমার বসু, লেখাটি বাবা ভয় করছে-তে গ্রন্থিত হয়েছে। আয়তনে ছোট্ট হলেও লেখাটি সুনীলকে বুঝতে বেশ সহায়ক। আজ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিনে লেখাটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো। নিজেই ক্রমশ হয়ে উঠেছিল ব্যবহৃত বন্ধুর মৃত্যুর পর তার কাজ নিয়ে লেখা মুশকিল। এবং সেই বন্ধু যদি হয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় লেখক, আরও মুশকিল।

প্রতিটি লেখকেরই একটি নিজস্ব দর্শন থাকে। সুনীল একটি কথা বলত। তার মর্মার্থ : ‘মহাকাল আমাকে মনে রাখবে কি-না, তা নিয়ে আমি বিন্দুমাত্র ভাবিত নই। এখন যা লিখলাম, সেটা পড়ে তুমি আনন্দ পাচ্ছ কি-না, সেটিই আসল কথা। আমি যদি পাঁচটা খারাপ গল্প আর তিনটে বাজে উপন্যাস লিখে থাকি, দুনিয়ার কোনও মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।’ সুনীল বেশির ভাগ লেখায় সাহিত্যের প্যাঁচপয়জারের চেয়েও মানুষকে বেশি বিনোদন দিতে চেয়েছে।

‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার আদিযুগে সুনীল বিনোদন বিতরণের এই দায়িত্ব নেয়নি। সিগনেট প্রেসের স্বত্বাধিকারী ডি কে বা দিলীপকুমার গুপ্ত সুনীলকে খুব ভালোবাসতেন। ‘কৃত্তিবাস’ ছাপা হত ওই প্রেসেই। দীপক মজুমদার, আনন্দ বাগচী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তিন সম্পাদকই স্থির করেছিল, ওই পত্রিকায় তরুণরা কবিতা লিখবে। গদ্য ছাপা হবে শুধু বয়স্ক লেখকদের।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তার আগে ‘কল্লোল’, ‘কালিকলম’, ‘প্রগতি’ ইত্যাদি পত্রিকা ছিল। ছিল বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’। ‘কৃত্তিবাস’ তরুণ কবিদের মুখপত্র ঠিকই, কিন্তু সেটি ছাপতেও কাগজ কিনতে হয়, দফতরিকে বাঁধাইয়ের টাকা দিতে হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া এক দেশ, চারদিকে উদ্বাস্তুর মিছিল, জিনিসপত্রের দাম আক্রা...আমার বয়সী সবাই জানেন, সে বড় সুখের সময় নয়।

সুনীল নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে, বাবা স্কুলের মাস্টারমশায়। তাদের ভাড়াটে বাড়ির ভাড়াও সেই আক্রার বাজারে বাড়ছে। বড় ছেলেকে পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়, সুনীলকেও অজস্র টিউশনি করতে হয়েছে। ‘জনসেবক’ কাগজে চাকরি নিতে হয়েছে। পরে আনন্দবাজার। আমার মতো অনেকে তখন শিক্ষকতার চাকরি নিয়েছে। কলেজে পড়ানোর মাইনে মাসে ৩২৫ টাকা।

খবরের কাগজে কবিতার ব্যাপার বিশেষ থাকে না। পাতা ভরানোর জন্য গদ্যই প্রধান। সুনীল ক্রমে এই বিষয়টিতে দক্ষ হয়ে ওঠে। প্রতিভার সঙ্গে দক্ষতার মিশেল ঘটলে যা হয়, সুনীলের ক্ষেত্রে তা-ই ঘটল। কবিতাই তার প্রথম প্রেম। তবু টাকার জন্য তাকে গদ্য লিখতে হচ্ছে বলে বহুবার আক্ষেপ করেছেন সুনীল।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস জানে, এই গদ্যযাত্রার শুরু ‘দেশ’ শারদীয়া সংখ্যায় ‘আত্মপ্রকাশ’ উপন্যাস থেকে। সেটিই সুনীলের প্রথম উপন্যাস। ওর এক-দেড় বছর আগে-পিছে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় অনেকে উপন্যাস লিখছেন। প্রত্যেকে আগের প্রজন্মের সাহিত্যের ছক ভাঙার চেষ্টা করছেন।

সুনীল এই চেষ্টাটা নিল অন্যভাবে। নতুন আখ্যানরীতির গদ্য সে লিখল না, বরং কলকাতার নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজের মুখের ভাষাকে তুলে আনল। তৈরি হল জনপ্রিয় এক গদ্যরীতি। ঝরঝরে ভঙ্গি, যে কোনও লোকেই সেখান থেকে বিনোদনের আস্বাদ খুঁজে নিতে পারে। আবার সেই গদ্যরীতিতেই তৈরি হয় ‘গরম ভাত অথবা নিছক ভূতের গল্প’র মতো ছোট গল্প। সুনীল বলত, একদিনে বসে গল্পটা লিখেছে। কিন্তু ওইভাবে তো লেখার রসায়ন তৈরি হয় না। অনেক দিন ধরেই তার মাথায় ওই গল্পের ছবি ঘুরত।

সুনীলের উত্থান আসলে কলকাতার মধ্যবিত্তের উত্থান। তার ভাষার উত্থান, চিন্তার উত্থান। ‘মনীষার দুই প্রেমিক’-এর মতো প্রেমের গল্প ছেড়ে সুনীল পরে ‘সেই সময়’, ‘প্রথম আলো’-র মতো বড় উপন্যাসে হাত দেয়। সেখানেও কিন্তু উনিশ শতকের নাগরিক কলকাতা। শরদিন্দু ঐতিহাসিক উপন্যাসে সামগ্রিক গৌড়মল্লার-এর ঝঙ্কার তোলেন, চেনা পরিবেশ ছেড়ে চলে যান তুঙ্গভদ্রার তীরে। কিন্তু সুনীল তার প্রিয় কলকাতার ইতিহাসকেই যেন ঘুরেফিরে দেখতে চায়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং গৌরদাস বসাকের সম্পর্কে সমকামিতা ছিল কি-না, ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত অবস্থান কী রকম ছিল, তাকেই পরখ করে নেয়। দুটি উপন্যাস লিখতেই প্রবল পরিশ্রম করেছিল সুনীল। উত্তরপাড়ার জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরি থেকে বহু জায়গায় খুঁটে তথ্য আহরণ করেছিল। বাংলা সাহিত্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মানে শুধু প্রতিভা এবং দক্ষতার মেলবন্ধন নয়। তার সঙ্গে জুড়তে হবে প্রবল পরিশ্রমের দক্ষতা। পরিশ্রমের ক্ষমতা না থাকলে একই সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নীললোহিত এবং সনাতন পাঠক হওয়া যায় না।

আমাদের বন্ধুদের অবশ্য একটি দুঃখ থেকে যাবে। খবরের কাগজে চাকরি নিয়ে ‘কৃত্তিবাস’ সম্পাদক বলেছিলেন, ‘সিস্টেমকে ভিতর থেকে ভাঙতে হয়। বাইরে থেকে ভাঙা যায় না।’ কিন্তু সিস্টেমকে ভাঙা যায়? সুনীল সত্যিই ভাঙতে চেয়েছিল? নাকি, ব্যবহার করতে চেয়েছিল? আর তা করতে গিয়ে নিজেই ক্রমশ হয়ে উঠেছিল ব্যবহৃত ব্যবহৃত এবং ব্যবহৃত!

তবু সুনীল পাঞ্জা লড়েছিল!

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
গ্রোসারি কেনাকাটায় টাকা সাশ্রয় করার ৬ স্মার্ট উপায়
গ্রোসারি কেনাকাটায় টাকা সাশ্রয় করার ৬ স্মার্ট উপায়
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় কলকাতায় নামতেই পারলো না কেকেআরের বিমান!
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় কলকাতায় নামতেই পারলো না কেকেআরের বিমান!
রাজধানীতে মাদকদ্রব্যসহ একদিনে গ্রেফতার ২৪
রাজধানীতে মাদকদ্রব্যসহ একদিনে গ্রেফতার ২৪
উপজেলা নির্বাচনে প্রথম ধাপে ৪১৮ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন
উপজেলা নির্বাচনে প্রথম ধাপে ৪১৮ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন
সর্বাধিক পঠিত
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব যার হাতে গেলো
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব যার হাতে গেলো
চাসিভ ইয়ার ঘিরে হাজার হাজার সেনা জড়ো করছে রাশিয়া
চাসিভ ইয়ার ঘিরে হাজার হাজার সেনা জড়ো করছে রাশিয়া
যে শিশুকে পাচারের অভিযোগে মিল্টনের বিরুদ্ধে মামলা
যে শিশুকে পাচারের অভিযোগে মিল্টনের বিরুদ্ধে মামলা
যেভাবে অপহরণকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে এলো স্কুলছাত্র
যেভাবে অপহরণকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে এলো স্কুলছাত্র
ছাত্রলীগ সহসভাপতি সাদ্দামের বছরে আয় ২২ লাখ, ব্যাংকে ৩২ লাখ, উপহারের স্বর্ণ ৩০ ভরি
হরিরামপুর উপজেলা নির্বাচনছাত্রলীগ সহসভাপতি সাদ্দামের বছরে আয় ২২ লাখ, ব্যাংকে ৩২ লাখ, উপহারের স্বর্ণ ৩০ ভরি