X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মাসুদ রানার চেয়েও অধিক

লতিফুল হক
২০ জানুয়ারি ২০২২, ২৩:৩৬আপডেট : ২১ জানুয়ারি ২০২২, ২৩:৪৯

বাংলাদেশে থ্রিলার লেখকদের বরাবরই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়। অনেকে তো তাদের মূলধারার সাহিত্যের প্রতিনিধিই মনে করেন না। অনুবাদ, সম্পাদনা, প্রকাশনা মিলিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেনের যে কীর্তি তা নিয়ে দেশের খুব কম বড় লেখকই প্রকাশ্যে তার প্রশংসা করেছেন। মেলেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও। রহস্য-রোমাঞ্চ বা থ্রিলার সাহিত্যকে ‘দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক’ মনে করার এই ‘ঐতিহ্য’ অবশ্য এখনো আছে। তাই মোহাম্মাদ নাজিম উদ্দিনের লেখা উপন্যাস নিয়ে ওপার বাংলায় নিজস্ব প্রযোজনায় ওয়েব সিরিজ হওয়ার পরও অনেকের বিস্ময় কাটে না—উনি বাংলাদেশের লেখক বুঝি!

কাউকে তাচ্ছিল্য করার সবচেয়ে সহজ উপায় বোধহয় কোনো একটা ‘ট্যাগ’ লাগিয়ে দেওয়া। কাজীদাকেও যেমন দেওয়া হয়েছে ‘মাসুদ রানা’র লেখকের ট্যাগ। ‘মাসুদ রানা’ স্রেফ কেবল যে বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে লেখা স্পাই থ্রিলার নয়, সেটা এই রস যে আস্বাদন না করেছে তাকে বোঝানো কঠিন। নিশ্চিতভাবেই গেল এক দশকে [হয়তোবা তারও আগে] সেবা প্রকাশনী তার সেরা সময় পেছনে ফেলে এসেছে। কিন্তু কাজীদা ও সেবার যা করার তার আগেই করে গেছেন।

পরের দিকে বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে লিখলেও শুরুর দুই ‘মাসুদ রানা’ ও ‘কুয়াশা’ সিরিজ কিন্তু কাজীদার মৌলিক। তবে মৌলিক, অনুবাদ বা বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে—কাজীদা যাই লিখুন তার সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা ছিলো ভাষা। কী সহজ, কী সাবলীল। যেন আয়েশি এক ঝর্ণা, কাছে গিয়ে হাজির হলেই হলো; আপনাকে আলগোছে টেনে নিয়ে যাবে গন্তব্যে। তার শব্দ খুব মোলায়েম, এমন অসাধারণ বর্ণনা যে আপনার মনে হবে কাপ্তাই, নটিংহাম থেকে তাহিতি—দেশ-বিদেশে রানার সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চারে আপনিই নেমে পড়েছেন।

আমার নিজের ভ্রমণ নেশা তৈরির পেছনে কাজীদার অবদান অনেক, নিশ্চিতভাবেই আরো অনেক কিশোর-তরুণের মধ্যে এই ‘সর্বনাশের’ বীজ বুনে দিয়েছেন তিনি। তবে মজার ব্যাপার কাজীদা নিয়ে কিন্তু দেশের বাইরে যাননি বললেই চলে! স্পাই-থ্রিলারের অন্যতম বড় শক্তির জায়গা সংলাপ। এখানেও কাজীদার গাঁথুনি চমৎকার। মনে হবে আপনি বড় পর্দায় সিনেমা দেখছেন, চরিত্ররা আপনার সঙ্গেই কথা বলছে। চরিত্র তৈরিতেই ছিলেন অনবদ্য। তার লেখার ছোট ছোট চরিত্রগুলোও তাই মানুষ মনে রেখেছে বছরের পর বছর। মায়ের দেশ হুগলির বাচনভঙ্গি একটু এদিক সেদিক করে বসিয়ে দিয়েছেন গিলটি মিয়ার মুখে। চরিত্র ছোট, তবু এমনই তার নির্মাণ যে বসে থাকতে হত কখন বিচিত্র সব কীর্তি নিয়ে হাজির হবে গিলটি মিয়া।

বাংলাদেশের অনুবাদ সাহিত্যে লেখক ও প্রকাশক হিসেবে কাজীদার কোনো তুলনা নেই। এইচ জি ওয়ালেস, রবার্ট লুইস স্টিভেনসন, হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড, জুল ভার্ন, জিম করবেট থেকে এরিয়া মারিয়া রেমার্ক বিশ্ব সাহিত্যের এতো এতো ধন-রত্নের সন্ধান বাঙালি পাঠককে আর কে দিয়েছে? তাও সেই কবে, কত সস্তায়। দুই বাংলা মিলিয়েই অন্যতম সেরা অনুবাদক তিনি। কেবল কী অনুবাদ? তার অনেক কীর্তির আড়ালে হারিয়ে যায় ‘পঞ্চ রোমাঞ্চ’, ‘ছয় রোমাঞ্চ’, ‘ছায়া অরণ্য’ বা ‘নির্বাচিত রোমাঞ্চ গল্প’ সংকলন। বিদেশি কাহিনির খলনলচের অনেকটাই বদলে তাকে এই বাংলার কাঁদামাটির ছাঁচ তিনি যেভাবে লাগিয়েছেন তার তুলনা কোথায়।

প্রকাশক হিসেবে ছিলেন দুর্দান্ত। সেই কবে দেশে পেপারব্যাক নিয়ে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে লেখকদের কাছে সম্পাদক যেন সবচেয়ে অনাকাঙ্খিত পদ। কিন্তু তিনি সেবার লেখা সম্পাদনা ছাড়া ছাপতেন না। আমৃত্যু চেষ্টা করেছেন যতটা সম্ভব প্রায় সব বই নিজেই দেখে ছাড়তে। নতুন কোনো বইয়ে ছোট ছোট বাক্য, তীক্ষ্ম সংলাপ, পরিমিত রসবোধ আর সহজ শব্দের উপস্থিতি দেখে পুরনো পাঠকরা ঠিকই বুঝে যেতেন কাজীদার হাতের কাজ। কয়েক দশক ধরে সেবা তৈরি করেছে একঝাঁক লেখক। পারিশ্রমিক বুঝিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও প্রকাশনা সংস্থাটি সবাইকে টেক্কা দেয়। লেখক গ্রাম-গঞ্জ, দেশ-বিদেশ যেখানেই থাকুক সেবায় গেলেই পাই-টু-পাই পারিশ্রমিক বুঝে পান।

সত্তর, আশি বা নব্বইয়ের দশকে, ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের বিরতিতে পড়ার বইয়ের ফাঁকে লুকিয়ে ‘নিষিদ্ধ’ মাসুদ রানা পড়া প্রজন্মের কাছে কাজীদা ছিলেন এক রহস্যমানব। যার মূল কারণ চিরকাল নিভৃতে থেকে যাওয়ার স্বাভাব। গান গাওয়া, আঁকা, শিকার থেকে হেন গুণ নেই যা সৃষ্টিকর্তা দেননি তাকে। ছিলো না কেবল সামনে আসার স্বভাব। এই ফেসবুক যুগেও ‘আপডেট’ হয়নি তার স্ট্যাটাস।

কাজীদা ভক্তদের দাবি, বাংলাদেশের মানুষকে মোটা দাগে বই পড়া শিখিয়েছেন তিনি। দেশের জন্মের প্রায় কাছাকাছি সময়েই জন্ম সেবার। এই দাবি ঠিক না ভুল তা নিয়ে তর্কের কোনো মানে নেই। তবে পাঁচ-দশ পয়সা করে জমিয়ে বই কেনার যে গল্প প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চালু আছে সেটার সত্যতা সত্তর, আশি আর নব্বই দশকের দেয়ালে কান পাতলেই শোনা যাবে।

যতটা শোনা যায় ব্যক্তি কাজীদা ছিলেন ভীষণ একরোখা, ব্যক্তিত্ববান। শেষ বয়সে আরেক লেখক শেখ আবদুল হাকিমের সঙ্গে তার বিবাদের প্রায় পুরোটাই সেই ইগো থেকে। সে যাই হোক, দুজনেই এখন প্রয়াত। ওপারে বসে তারা যত খুশি যুদ্ধ করুন পাঠকদের তাতে বয়েই গেছে।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বাংলাদেশ ব্যাংকে সংবাদকর্মীদের প্রবেশে বাধা: উদ্বিগ্ন টিআইবি
বাংলাদেশ ব্যাংকে সংবাদকর্মীদের প্রবেশে বাধা: উদ্বিগ্ন টিআইবি
আপাতত গরমেই খেলতে হচ্ছে সাবিনা-সানজিদাদের
আপাতত গরমেই খেলতে হচ্ছে সাবিনা-সানজিদাদের
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসেডর যুবরাজ
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসেডর যুবরাজ
সর্বাধিক পঠিত
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন