X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

ওমর আলী : এক কক্ষচ্যুত নক্ষত্র!

এম আবদুল আলীম
২০ অক্টোবর ২০২২, ১৬:৫৯আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০২২, ১৭:১৪

ওমর আলী (১৯৩৯-২০১৫) কবি, মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত কবি। কবি ছাড়া তিনি আর কিছুই নন! আজ (২০ অক্টোবর) এই কবির তিরাশিতম জন্মদিন। জীবনের অধিকাংশ সময় (প্রায় সত্তুর বছর) কবিতার সঙ্গে ঘরবসতি করেছেন। কবিতার রাজপ্রাসাদে কীভাবে অভিষেক ঘটলো এই কবিরাজন্যের? সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। তাঁর চেতনার ভূমিতে এই বোধের বীজ প্রথম রোপিত হয় মাত্র দেড় বছর বয়সে, এবং সেটা মাতৃবিয়োগকে কেন্দ্র করে। একই সঙ্গে পদ্মার করাল-গ্রাসে পৈত্রিক ভিটা ও জমিজমা তলিয়ে যাওয়ায় জীবন-জীবিকার যে সংগ্রাম এবং তা থেকে উদ্ভূত যে যন্ত্রণা, তা তাঁকে জীবন সম্পর্কে ভাবতে শেখায়। চারণকবি চাচা তজীর আলীর ছড়া কেটে কথা বলার ঢং বিস্ময় জাগায় তাঁর শিশুমনে। পদ্মার খেয়ালি প্রকৃতির রহস্য অবলোকন, পদ্মাচরের সংগ্রামী জীবনে বসবাস এবং নির্মল প্রকৃতির বুকে সাঁতার কাটতে গিয়ে তাঁর মনের গহীন থেকে কিছু একটা বের হয়ে আসতে চাইতো। মনের আকাশে জমাট হওয়া সেই ভাবের মেঘ থেকে বর্ষণ হতে সময় লাগেনি। তখন তিনি চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। সালটা ১৯৪৮। চেতনার তলদেশ থেকে উৎসারিত ভাবকে ছন্দে মিলিয়ে কাগজে প্রথম আঁচড় বসান। এই আঁচড় কাটায় সচেতন প্রয়াস ছিল না। পাবনা গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশনে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় কিছু সচেতনতার পথে যাত্রা শুরু হয় তাঁর শিক্ষক মৌলবি আবদুল লতিফ রাজির প্রচেষ্টায়। তিনি কতকটা জুতসইভাবে ওমর আলীর চেতনায় প্রোথিত করেন কবিতার বীজ; তাতে রসদ জোগায় জিয়া হায়দার, আবু হেনা মোস্তফা কামালের সঙ্গ-সান্নিধ্য ও বৈকালিক আড্ডা। এ সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীম উদ্দীন, গোলাম মোস্তফা, বন্দে আলী মিয়া প্রমুখের কবিতার সঙ্গে পরিচিত হন। একটি ইঁদুরের মৃত্যুর শোক সইতে না পেরে লিখে ফেলেন ‘একটি ইঁদুরের মৃত্যু’ নামক কবিতা। পাবনার ‘সায়াহ্ন নীড়’ থেকে প্রকাশিত, সৈয়দ আজিজুল হক সম্পাদিত পাক-হিতৈষী পত্রিকায় কবিতাটি প্রকাশিত হয়। পত্রিকার পাতায় এটিই তাঁর প্রথম কবিতা। দ্বিতীয় কবিতা ‘জেহাদে করিনা ভয়’ ওই একই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কবিতাটির উপজীব্য ছিল কাশ্মীর যুদ্ধ। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর অপরিপক্ব ভাবনার কবিতাগুলো একসঙ্গে করে স্কুলশিক্ষক মৌলবি আবদুল লতিফ রাজি একটি বই প্রকাশ করে দেন, যেটির নামকরণ করা হয় ‘জেহাদে করিনা ভয়’। কবির নামের সঙ্গে আনসারী যুক্ত করে লেখা হয় ‘ওমর আলী আনসারী’।
       
     পাবনার গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশনে পড়ার সময় বড় কবি হওয়ার উদগ্র বাসনা পেয়ে বসে তাঁকে। শুধু কী তাই? ওই বাসনা তাঁকে ঘরছাড়া করে। তাই গ্রাম ও শৈশব-কৈশোরের মায়া ছিন্ন করে ব্যাগ-পোঁটলা চুপিসারে যমুনা পার হয়ে হাজির হন বাংলা কবিতার নতুন রাজধানী ঢাকায়। তখন তাঁর বয়স মাত্র তেরো বছর। সম্বল বাবার গরু বিক্রি করা কিছু টাকা। ঢাকায় গিয়ে প্রথমে ভর্তি হন সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে। কিন্তু এ স্কুলের বাঁধাধরা নিয়ম পদ্মাতীরের মুক্ত প্রকৃতিতে বেড়ে ওঠা কিশোরকে আটকাতে পারলো না। তাই স্কুল থেকে পালালেন। অতঃপর নাম লেখালেন পুরনো ঢাকার হাম্মাদিয়া হাইস্কুলে। কবিতা যাকে পেয়ে বসেছে তাঁকে কী আর স্কুলের রুটিন-মাফিক লেখাপড়া বেঁধে রাখতে পারে? না, পারেনি। স্কুলের পড়া সিকেয় তুলে ছুটলেন বিউটি বোডিং আর পুরনো ঢাকার সাহিত্য আড্ডাগুলোতে। আর ছুটবেনই বা না কেন? তিনি তো ঢাকায় পারি জমিয়েছিলেন কবি হওয়ার উদগ্র বাসনায়। তাই স্কুলের সহপাঠীদের সঙ্গ অপেক্ষা সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতের তরুণ বন্ধুদের সঙ্গই তাঁকে স্বস্তি দিলো বেশি। আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, দিলওয়ার, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, ফজল শাহাবুদ্দীন, আব্দুর রশীদ ওয়াছেকপুরীসহ উদীয়মান কবি-সাহত্যিকদের সঙ্গ-সান্নিধ্য তাঁকে নিত্য-নতুন কবিতা-রচনার রসদ জোগালো। সান্নিধ্য পেলেন আবদুল গনি হাজারী, সরদার জয়েনউদ্দীন, হাবিবুর রহমান, ফয়েজ আহমদ, জহুর হোসেন চৌধুরী প্রমুখের মতো সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মিডিয়া জগতের প্রথিতযশা মানুষদের। আড্ডার পাশাপাশি পড়তে থাকলেন বিচিত্র বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকা। বেশি টানলো আধুনিক বাংলা ও ইংরেজি কবিতার বই। ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি, আমেরিকান ইনফরমেশন সার্ভিস লাইব্রেরি হয়ে উঠলো প্রিয় জায়গা। টি. এস. এলিয়ট, জীবনানন্দ দাশ, স্টিফেন ক্রেন, কাহলিল জিবরান তাঁকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করলো। সবচেয়ে বেশি টানলো স্টিফেন ক্রেন ও কাহলিল জিবরান। এই কবিদ্বয়ের কবিতার প্রভাবে লিখতে শুরু করলেন সংলাপধর্মী ও গভীর দার্শনিক চেতনাসমৃদ্ধ কবিতা। দৈনিক সংবাদ-এর ‘খেলাঘর’ এবং সাপ্তাহিক মিল্লাত-এর ‘কিশোর দুনিয়া’য় নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকলো তাঁর ছড়া ও কবিতা। স্নেহধন্য হলেন ‘কচি-কাঁচার আসরে’র রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের।

    ১৯৫৩-র মাঝামাঝি পাবনায় ফিরলেন; কিন্তু মন টিকলো না। কিছুদিন পর অর্থাৎ চুয়ান্নর শুরুতে আবারও ফিরলেন ঢাকায়। এবার রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের সঙ্গ পেলেন নিবিড়ভাবে। পরিচিত হলেন নাসির আলী এবং আহসান হাবীবের সঙ্গে। কেবল পরিচিত হওয়া নয়, আহসান হাবীবের বাসায় জায়গির থাকার ব্যবস্থা পর্যন্ত হলো, বাড়তি দায়িত্ব তাঁর মেয়ে কেয়ার গৃহশিক্ষকতা করা এভাবেই ঢাকার সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে ওমর আলী নিজেকে খাপ খাইয়ে নিলেন। মাহে-নও, সওগাত, মোহাম্মদীসহ নানা পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে লাগলো। ১৯৫৫-তে দৈনিক সংবাদের ঈদ সংখ্যায় তাঁর ‘বৃষ্টির বিপদে এক চড়–ই’ প্রকাশিত হলে আশরাফ সিদ্দিকী এবং নরেশ গুহ ভূয়সী প্রশংসা করেন। কেবল ঢাকাই সাহিত্যআসরে নয়, কলকেত্তাই সাহিত্যভুবনেও তাঁর নাম পৌঁছে গেল বুদ্ধদেব বসুর কবিতা এবং হুমায়ুন কবিরের চতুবঙ্গ পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে। ওমর আলী তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। ১৯৫৬ সালে দৈনিক ইত্তেফাকে-এর ‘সাহিত্য সাময়িকী’তে প্রকাশিত হলো তাঁর ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’ কবিতা। মুনীর চৌধুরী কবিতাটির শুধু প্রশংসাই করলেন না, উদীয়মান কবিকে ঢাকা বেতারে নিয়ে তা পাঠের সুযোগ পর্যন্ত করে দিলেন। এ সময় এমন আরো কয়েকটি কবিতা লিখে সাহিত্যাঙ্গনে নিজের অস্তিত্ব জানান সুদৃঢ় করলেন। ১৯৬০ সালে প্রথম প্রথম কাব্য ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’ প্রকাশের পর তাঁর নাম ছড়িয়ে গেলো চতুর্দিকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ মুহম্মদ আবদুল হাই ঢাকা বেতারে এ গ্রন্থের ওপর আলোচনা করলেন। একই সঙ্গে অকুণ্ঠ প্রশংসা করে কবিকে উৎসাহ দিলেন। বইটি তরুণদের মধ্যেও সাড়া ফেললো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের সাংস্কৃতিক সপ্তাহে এ গ্রন্থের নাম-কবিতাটি আবৃত্তির জন্য মনোনীত হলো। কলকাতার বইমেলাতেও হলো এর জায়গা এক কথায় প্রথম গ্রন্থ দ্বারাই ওমর আলী বাজিমাত করলেন। ভয়েস অব আমেরিকার প্রশ্নোত্তর বিভাগে এটিকে ‘বাংলা সাহিত্যের দীর্ঘতম নামের সফল কাব্যগ্রন্থ’ বলে অভিহিত করা হলো। প্রথম কাব্যগ্রন্থের জন্য এত সুনাম খুব কম কবির ভাগ্যেই জুটেছে। প্রসঙ্গত, বলতে দ্বিধা নেই যে, জীবনানন্দ দাশের ঝরা পালক, শামসুর রাহমানের প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে কিংবা বিনয় মজুমদারের নক্ষত্রের আলোয় পাঠকের মনে তেমন দাগ কাটেনি; তাঁরা পাঠকের মনোযোগ কেড়েছিলেন দ্বিতীয় গ্রন্থ, অর্থাৎ  ধূসর পান্ডুলিপি, রৌদ্র করোটিতে এবং ফিরে এসো চাকার মাধ্যমে। এটিও সত্য যে, ওমর আলী নিজে পরবর্তীকালে যে তিন ডজনের অধিক কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন, সেগুলোর একটিও প্রথম কাব্যের খ্যাতির চূড়া স্পর্শ করতে পারেনি!

 দুই

ওমর আলীর কবিমানস হলো বিচিত্রগামী, কবিতার রসদ সংগ্রহের জন্যে তা ছুটলো ভুবনের ঘাটে ঘাটে। তবে যৌবনের উন্মাতাল রাতে মনে যেমন প্রবাহিত হলো তেমনি কবিতার শরীরেও তা জায়গা করে নিলো, যার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলো প্রেম। চিরায়ত বাংলার নর-নারীর প্রেমের সঙ্গে স্থান পেলো প্রাত্যহিক জীবনের নির্মল চালচিত্র। দেশি-বিদেশি সাহিত্য, ইতিহাস, চিত্রকলা, সংগীত, পুরাণের বহুমাত্রিক ও সহজ-সরল প্রয়োগ তাঁর কবিতার ভাব-ভাষাকে স্বকীয়তা দান করলো। ওমর আলী গ্রামের মানুষ। গ্রামের স্নিগ্ধ প্রকৃতি, সমাজ আর পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে কেটেছে তাঁর শৈশব-কৈশোর। এসবের মধ্যে অবগাহন করে তাঁর কবিমানস পরিপুষ্ট হয়। গ্রামীণ নর-নারীর যে সংসার, তাদের যে পারিবারিক জীবন, তা গভীরভাবে অবলোকন করে নিজের কাব্যবোধকে শাণিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। এসব থেকে লব্ধ প্রত্যক্ষ ও বাস্তব অভিজ্ঞতাই তাঁর কবিতায় রসদ সরবরাহ করেছে। পাশাপাশি ছিল বিস্তর পঠন-পাঠনজাত জ্ঞান তাঁর কবিসত্তাকে পরিশীলিত করেছে। বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি অর্জন করায় নানা দেশের সাহিত্য সম্পর্কে যেমন তাঁর জ্ঞান ছিল, তেমনি কবিতার আঙ্গিকেও নানা নিরীক্ষা চালিয়েছেন। জীবন-জীবিকার তাগিদে সরকারি কলেজে অধ্যাপনা পেশায় যুক্ত থাকলেও কবিতাচর্চাই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। প্রথম দিকের কবিতাগুলোর পঙক্তিতে পঙক্তিতে রয়েছে এর প্রমাণ। সবকিছু ছাপিয়ে আবহমান বাংলার চিরায়ত নর-নারীর সাজানো সংসার তাঁর কবিমনে গভীর দাগ কেটেছিল। বাংলাদেশের নারীকে তিনি আইভি লতার রূপে দেখেছেন, যে কিনা সতেজ আর স্নিগ্ধ; ভরা বর্ষার নদীর মতো স্বাস্থ্যবান, যৌবনবতী ও প্রফুল্ল। তাদের জীবনের সহচর যেসব পুরুষ তারা সরল, সুঠামদেহী এবং কর্মঠ; নারী যাদের কর্মে আস্থাবান ও সহযোগী। তাদের কাছে ভালোবাসার উপহার সন্তান পেয়ে নারীর মন জুড়ায়, প্রাণ ভরে। আপন পরিমন্ডলের বাইরে জটিল-জীবনের সঙ্গে এসব নর-নারীর তেমন পরিচয় ঘটেনা। আঁতুরে শিশু কোলে নিয়ে ভাত রান্না তার নিত্যদিনের কাজ। স্বামীর ঘরে-ফেরার আকাঙ্ক্ষায় সে সবসময় অধীর হয়ে অপেক্ষা করে। রোদে-বৃষ্টিতে শ্যামল রঙ ধারণ করা এই নারীদের সুনামই ওমর আলী শুনে এসেছেন বংশ-পরম্পরাগতভাবে। প্রথম গ্রন্থই তাঁকে প্রেমের কবির অভিধায় অভিষিক্ত করে। ‘মিমোসা’, ‘হাসিনা’, ‘তোমাকে, ‘পরীও সান্নিধ্যে আসে’, ‘সেই নারী তুমি’, ‘আমি কিন্তু যামুগা’, ‘এখন পালাও দেখি’, ‘প্রেয়সী’, ‘একদিন একটি লোক’, ‘ফরহাদের প্রতি শিরীণ’, ‘শিরীণের প্রতি ফরহাদ’, ‘কোনো মানবীকে’, ‘সুসজ্জিতা’ প্রভৃতি কবিতায় নর-নারীর প্রেমের বিচিত্র অনুভূতি প্রকাশিত হয়েছে। নারীর রূপ-বর্ণনায় ওমর আলী পারিপার্শ্বিক জীবন, প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে উপমা ও রূপক ব্যবহার করেছেন। ‘হাসিনা’ কবিতায় লিখেছেন : ‘হাসিনা তোমার মুখ কাঁঠালি-চাঁপার স্নিগ্ধতায়,/উজ্জ্বল সুন্দর। তুমি পূর্ব বাংলার সুশ্রী মেয়ে।/তোমার পায়ের চিহ্ন যে ধূলির শান্ত আঙিনায়/পড়ে তা স্বর্ণ। সবই জীবন্ত, তোমার স্পর্শ পেয়ে।’ গ্রামীণ প্রকৃতি থেকে অলঙ্কার সংগ্রহ করে কবি সাজিয়েছেন তাঁর নায়িকার রূপ। মধ্যযুগের কবিগণ যেখানে নারীর রূপবর্ণনা করতে গিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ব্যয় করেছেন, ওমর আলী সেখানে কয়েকটি রেখায়, শব্দের পরিমিত প্রয়োগ করেছেন। আধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্যই এই পরিমিত শব্দচয়ন এবং তীক্ষ্ণ রসবোধ। ওমর আলীর নর-নারীর প্রেম এ কালের নগরজীবনের কিংবা বিজ্ঞান-প্রযুক্তিশাসিত পুঁজিবাদী সমাজের প্রেম নয়। তাঁর প্রেমিক-প্রেমিকার মনও পুঁজির সুতোর টানে ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায় না। সে প্রেম চিরস্থায়ী; এক মন ও এক আধারেই জীবন পার করে। এমনকি প্রিয়ার মৃত্যুর পরেও তার স্মৃতিকে জীবনভর ‘বুকে বয়।’

    ওমর আলী তাঁর সুবিখ্যাত এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি কাব্যটি উৎসর্গ করেছেন ‘প্রিয়তমাকে’। কে তাঁর সেই প্রিয়তমা? এ প্রশ্নের উত্তরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “নিজের কথা যদি বলি তাহলে আমার ‘কুতুবপুরের হাসনাহেনা’ উপন্যাসটির কথা বলতে হয়। উপন্যাসের নায়ক একজন প্রাইভেট টিউটর। নিরীহ আর মুখচোরা লাজুক। যে তার ভালোবাসার রমণীটিকে আর ভালোবাসার কথা না জানিয়ে নির্দিষ্ট মাপের একটি বক্ষবন্ধনী প্রথম উপহার দিয়েছিল। যা ঘটেছিল আমার নিজেরই জীবনে।” (কারুজ, ১ম বর্ষ, ৫ম খন্ড ১৯৯৯) উল্লেখ্য, এ গ্রন্থটি রচনার কালে ওমর আলী জায়গীর থাকতেন আহসান হাবীবের বাড়িতে এবং তাঁর মেয়ে কেয়ার গৃহশিক্ষক ছিলেন। ‘একদিন একটি লোক’ কবিতাটি রচনার পটভূমি সম্পর্কে একই সাক্ষাৎকারে বলেছেন : ‘নাজমা নামের একটি মেয়ে রাজশাহী থেকে এক যুবককে, যে যুবক তখনও প্রবেশিকা পাশ করেনি এবং যার কেবলমাত্র গোঁফ উঠেছে, নীল কাগজে সুগন্ধি পাউডার মাখা চিঠি পাঠাতো। সে মেয়েটি এম এ পাশ করে অন্য এক ব্যক্তিকে বিয়ে করলো। ডক্টরেটও করেছিল। ব্যক্তিটি ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আর মেয়েটি ছিলেন ড. নাজমা জেসমিন চৌধুরী। ... যাই হোক যুবকটি আইএ ফেল করলো কয়েকবার। অর্থ সংকটই এর কারণ। আর মেয়েটি সব পরীক্ষা পাশ করে ওপরে উঠতে থাকে। যুবককে আর চিঠি লেখেনা। সেই যুবকের অশ্রুসিক্ত ক্ষোভ শেষ পর্যন্ত আমাকে একদিন একটি লোক কবিতা লিখতে প্রেরণা জুগিয়েছিলো।’ (কারুজ, ১ম বর্ষ, ৫ম খন্ড ১৯৯৯) কবিতাটি আবদুর রশীদ খান ও মোহাম্মদ মামুন সম্পাদিত পূর্ব বাংলার প্রেমের কবিতা সংকলনে স্থান পায়। কলকাতার ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায় বলা হয়েছিল, এ সংকলনে এটিই একমাত্র প্রেমের কবিতা। ওমর আলী সংলাপধর্মী এ কবিতাটি লিখেছিলেন মার্কিন কবি স্টিফেন ক্রেনের কবিতাশৈলীর আদলে; যাতে বলা হয় : “একদিন একটি লোক এসে বললো, ‘পারো?’/বললাম, ‘কি?’/‘একটি নারীর ছবি এঁকে দিতে’, সে বললো আরো,/‘সে আকৃতি/অদ্ভুত সুন্দরী, দৃপ্ত, নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে/পেতে চাই নিখুঁত ভঙ্গিতে।’/‘কেন?’ আমি বললাম শুনে।/সে বললো, ‘আমি সেটা পোড়াবো আগুনে।’’ এমন নিটোল প্রেমের কবিতা বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি লেখা হয়নি। প্রেমের কবিতা ছাড়াও তিনি লিখেছেন ইতিহাস, সমাজ, ধর্ম, সমকাল, প্রকৃতি এবং জীবনের বিচিত্র অনুভূতি-সঞ্জাত কবিতা। লিখেছেন অসাধারণ সব সনেট ও সংলাপধর্মী কবিতা। স্বাধিকার-সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ থেকে একালের সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ এবং দেশে দেশে মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত হওয়া যুদ্ধসমূহ তাঁর কবিতার বড় অংশ জুড়ে স্থান পেয়েছে।    
           
 তিন

একজন কবি বা শিল্পীকে বিচার করতে হয় তাঁর সমগ্র সৃষ্টির নিরীখে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রতিভার যে পরিক্রমণ তা যাচাই করতে হয় সামগ্রিকভাবে। এক্ষেত্রে নির্মোহ ও সত্যনিষ্ঠ দৃষ্টি থাকা বাঞ্ছনীয়। ওমর আলীর প্রতিভা এবং কাব্যসম্ভার বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও এ কথা খাটে। পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তুর দশকে তাঁর প্রতিভার যে প্রস্ফুটন-বিকাশ লক্ষ করা যায়, তা ক্রমে উৎকর্ষ লাভ করে শেষ পর্যন্ত পরিণতিমুখী হয়নি। পদ্মাপাড়ের এই কবির প্রতিভা যেন পদ্মার খেয়ালি রূপে মতোই প্রবাহিত হতে হতে এক পর্যায়ে চরে আটকা পড়েছে; তাতে কবি যতই শিল্পের ফল্গুধারা প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছেন ততই তা অক্ষমতার ধু ধু বালুচরে লু হাওয়া প্রবাহিত করেছে। ফলে পাঠক ও কাব্যরসিকগণ ওমর আলীর কবিতার নন্দনভুবনে অবগাহন করতে গিয়ে অবারিত সৌন্দর্যের জলঝর্ণার স্নিগ্ধতায় প্রশান্তি পাওয়ার পরিবর্তে ব্যঞ্জনাহীন শব্দ আর বাহুল্য দোষেদুষ্ট বাক্যের চোরাবালিতে আটকে যাওয়ার বেদনা অনুভব করেছেন। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে প্রতিভার শক্তিমত্তায় ব্যাপক সাড়া জাগিয়ে যে কবির আবির্ভাব ঘটেছিল, বর্তমান শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে সেই কবি একপ্রকার শিল্পনৈপুণ্যহীন, ঢিলেঢালা ও একঘেঁয়ে ভাষার ‘রিপোর্টিং জাতীয়’ শিথিল ভাবের কবিতা রচনা করে নীরবে-নিভৃতে ইহজীবন ত্যাগ করেছেন। কবিতা যে এক ধরণের বিমূর্ত শিল্পকর্ম তা যে এ কবি ভুলেই গিয়েছিলেন। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয় মাহে-নও, সওগাত, মোহাম্মদী, কবিতা, চতুরঙ্গ-এর মতো সাহিত্যের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলোতে; গ্রন্থ ছাপা হয় বনেদি সব প্রকাশনী থেকে; মুনীর চৌধুরী, মুহম্মদ আবদুল হাই, বুদ্ধদেব বসু, আশরাফ সিদ্দিকী, নরেশ গুহ প্রমুখের মতো সাহিত্য-সমঝদারগণ তাঁর কবিতার আলোচনা ও প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন; সেই কবির কিনা শেষজীবনের বেশিরভাগ কবিতার ঠাঁই হয় পাবনার স্থানীয় ফোল্ডার কবিতাপত্রসহ বিভিন্ন নাম-গোত্রহীন পত্র-পত্রিকায়; এবং বই প্রকাশিত হয় নিজের গাঁটের (চাকুরির বেতন, বউয়ের গহনা এবং ওয়াক্তের চাউল বিক্রি করা) টাকায়! তবুও রক্ষা, পাবনার স্থানীয় প্রকাশনীগুলো ঝুঁকি নিয়ে তাদের সামর্থ্যরে সবটুকু উজাড় করে ওমর আলীর বই প্রকাশ করেছেন। তারা এই ঝুঁকি না নিলে ওমর আলীর শেষজীবনে অক্ষম প্রতিভার অপচয়ে সৃষ্ট কবিতাগুলো পাঠক-গবেষকদের হাতে পৌঁছাতো না। বলা চলে, এ সময় তিনি সাহিত্য-সমালোচক এবং বোদ্ধা পাঠকের দৃষ্টির আড়ালে চলে যান। এক প্রকার বিস্মৃতির অন্তরালে যেন হারিয়ে যান বাংলা কবিতার জগতে একদা তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করা এই কবি। এজন্যে ওমর আলীকে বাংলা কাব্যজগতের এক ‘কক্ষচ্যুত নক্ষত্র’ বললে বোধ করি এতটুকু অত্যুক্তি হয় না। 
   এতদসত্ত্বেও বলা যায়, ওমর আলীর বহু কবিতা শিল্পোত্তীর্ণ এবং বাংলা তথা বিশ্বসাহিত্যের সেরা কবিতাগুলোর পাশে স্থান পাওয়ার যোগ্য। সে কবিতাগুলো তাঁর কালের পাঠকদের মতো সর্বকালের পাঠককে আকৃষ্ট করবে। একাডেমিক পরিসরে যেভাবে মুনীর চৌধুরী, মুহম্মদ আবদুল হাই, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আবদুল মান্নান সৈয়দ, যতীন সরকার, মাহবুবুল হক, বিশ্বজিৎ ঘোষ, মুহম্মদ নূরুল হুদা, মহীবুল আজিজ, জাকির তালুকদার, শহীদ ইকবাল, মোহাম্মদ আজমসহ অগণিত সাহিত্য-সমঝদারের কাছে তাঁর কবিতা যেভাবে সমাদৃত হয়েছে, তা সত্যিই শ্লাঘার বিষয়। শুধু তাই নয়, অগণিত কবি তাঁর কবিতার ভাবসম্পদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তাঁর সমসাময়িক কবি আল মাহমুদ তাঁকে বলেছেন ‘প্রকৃত কবি’। তিনি এও বলেছেন ওমর আলীর ‘কবিতায় বাংলাদেশের প্রকৃতির যে গন্ধ পাওয়া যায় তাতে আমার মতো মানুষ বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে।’ মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেছেন ওমর আলী ‘স্বতন্ত্র কবি’, ‘আল মাহমুদের চেয়েও বেশি ক্ষমতাবান কবি।’ নগরের চোখ-ধাঁধানো, জৌলুশভরা জীবনে এই কবিকে অপাংক্তেয় মনে করা হলেও এবং প্রচারমাধ্যমে তাঁকে সেভাবে গুরুত্ব না দেওয়া হলেও বাংলা কবিতার ইতিহাস থেকে তাঁর নাম মুছে ফেলা যাবে না। প্রথম গ্রন্থ তো বটেই, পরবর্তীকালে রচিত অনেক গ্রন্থের বহু কবিতাই কালের কষ্টিপাথরে যাচাই হয়ে পাঠক ও কাব্যরসিকদের চিত্ত জয় করে টিকে থাকবে। প্রসঙ্গত একটি কথা বলা দরকার যে, কোনো কবিরই সকল কবিতা টিকে থাকেনি, শিল্পোত্তীর্ণও হয়নি। চর্যাপদের কবিদের থেকে, একালের কবিগণ; এমনকী কবিসম্রাট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ; এমনকী শেক্সপিয়র, বায়রণ, শেলী, কিটস, ইয়েটস, এলিয়ট; সকলের বেলায়ই এ কথা প্রযোজ্য। ঈশ্বরগুপ্তের কয়টি কবিতা শিল্পোত্তীর্ণ হয়েছে? কাব্যসাধনার স্বীকৃতি-স্বরূপ ওমর আলী জীবদ্দশায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেছেন, মৃত্যুর পরে ভূষিত হয়েছেন একুশে পদকে। নগর থেকে দূর লোকালয়ে জীবন-যাপনকারী, নীরবে-নিভৃতে আরাধনাকারী এই কবি আপন আলোয় দ্যুতি ছড়াবেন পাঠকহৃদয়ে। সাঁইত্রিশখানা কাব্য, একখানা ছাড়াগ্রন্থ এবং দুখানা উপন্যাস তাঁকে চিরঞ্জীব করে রাখবে। বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা, বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের অকৃত্রিম রূপের আধুনিক ভাষ্যকাররূপে তিনি স্বমহিমায় দীপ্যমান থাকবেন।

 

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
ঝুঁকি নিয়ে পজিশন বদলে সব আলো কেড়ে নিলেন রাফায়েল
ঝুঁকি নিয়ে পজিশন বদলে সব আলো কেড়ে নিলেন রাফায়েল
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক