X
বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪
২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

দীপ্তি ও দ্যুতির দীর্ঘ পথরেখায়

ড. সাজেদুল ইসলাম
০২ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:২৮আপডেট : ০২ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:২৮

কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক বেগম রাজিয়া হোসাইন নারী শিক্ষার অগ্রদূত ও একজন সমাজ সংষ্কারক। তাঁর জন্ম ১৯৩৬ সালের ২ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ জেলার দুর্গাপুর গ্রামে। সরকারি গুরুদয়াল কলেজের প্রথম মুসলিম নারী গ্রাজুয়েট। রক্ষণশীল সমাজে পড়াশোনা চালিয়ে নিতে তিনি বিস্তর লড়াই-সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন। পাড়ি দিয়েছেন বন্ধুর পথ। নিজের শিক্ষার জন্য যে সংগ্রাম করতে হয়েছে পরবর্তীকালে সেই সংগ্রাম নারী শিক্ষার অধিকার আদায়ের নেতৃত্বদানে তাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।  

পারিপাশ্বিক চাপে পিতা মৌলভী মো. আবদুল হাকিম ভূঁইয়া ও মা বেগম নুরুন্নাহার তাকে পঞ্চম শ্রেণি পাশের পর বিয়ে দিতে বাধ্য হন। গ্রামের লোকের চাপে বিয়ে দিতে বাধ্য হলেও রাজিয়া হোসাইনের বাবা তাঁর মেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে নেবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেন। তিনি পরিবারসহ গ্রাম ছেড়ে কিশোরগঞ্জ শহরে স্থানান্তরিত হন।

বেগম রাজিয়া হোসাইন অষ্টম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। সেসময় ভাষার দাবিতে অনুষ্ঠিত সভা-সমাবেশে তিনি বক্তৃতা করেন। কিশোর বয়সে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ তাঁর মানসপটে সাহিত্যবোধের উন্মেষ ঘটায়। তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। বিদ্যালয়ে দেয়ালপত্রিকা প্রকাশে নেতৃত্ব দেন। মাধ্যমিক পাশের পরে উচ্চমাধ্যমিকে তাঁর ভর্তি হওয়া নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। স্থানীয় রক্ষণশীল ব্যক্তিবর্গ ‘মেয়েদের এত লেখাপড়া প্রয়োজন নেই’ মর্মে মত দিলে রাজিয়া বেগমের পড়ালেখা হুমকির মুখে পড়ে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন অধ্যাপক এম ওসমান গণি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাদশতম উপাচার্য), গুরুদয়াল কলেজের অধ্যক্ষ এবং স্থানীয় সরোজ বালা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের আন্তরিক প্রচেষ্টায় তিনি কলেজে ভর্তির সুযোগ পান।

গুরুদয়াল কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করে তিনি সরোজ বালা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পরবতীকালে তিনি ময়মনসিংহ উইমেন টিচার্স ট্রেইনিং কলেজ থেকে বিএড এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। দীর্ঘ বিশবছর তিনি নিজের স্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে রাজশাহী, বরিশাল ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে বহুমুখী দায়িত্ব পালন শেষে উপপরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। নারী শিক্ষা ও বয়স্ক শিক্ষার প্রসারে তাঁর কর্মতৎপরতা সর্বজনবিদিত।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রশাসনে দায়িত্ব পালনকালে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের মানবিক মূল্যবোধের আমূল সংস্কারে ব্রতী হন। মেয়েদেরকে বিদ্যালয়মুখী করতে ব্যাপক প্রচার চালান। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। নারী শিক্ষার পাশাপাশি বয়স্ক শিক্ষার প্রসার, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। গার্ড হাইড, স্কাউট ও হলদে পাখির মত সহশিক্ষামূলক সংগঠনকে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় বাধ্যতামূলক করেন।      

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক থাকাকালে স্বাধীনতার পক্ষে অত্যন্ত কৌশলে তথ্য সমন্বয় করেন বেগম রাজিয়া হোসাইন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি গেরিলাদের আশ্রয় দেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজ বাড়িতে একজন হিন্দু শিক্ষিকাকে আশ্রয় দিলে পাকিস্তানি মেজর তাকে শাসালেও তিনি ওই মেজরকে বলে দেন— ‘শিক্ষককে আশ্রয় দেওয়া পরম ধর্ম’। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাঙালির বিজয়ের প্রাক্কালে পাকবাহিনীর হাতে নিগৃহীত নারীদেরকে উদ্ধার করে তাদের পরিবারে পুনর্বাসনে তিনি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। উল্লেখ্য, তাঁর স্বামী মো. হোসাইন আলী মুক্তিযুদ্ধকালে উদ্যোগী হয়ে বেওয়ারিশ লাশ দাফন, সৎকার করেন। 

১৯৮৬ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। নাম ‘বুকের ভিতর নদী’। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় ‘পাতার শব্দে শব্দে’, ‘রোদ্দুর হেটে যায় অন্ধকারে’ ইত্যাদি। ‘স্মৃতির পাতা’ তাঁর স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ। কবিতা, কথাসাহিত্য, গান, প্রবন্ধ-নিবন্ধ এবং শিশুতোষ রচনায় পারদর্শী এই লেখকের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পঞ্চাশের অধিক।  

বেগম রাজিয়া হোসাইন কিশোরগঞ্জে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি ও জাতীয় মহিলা সংস্থার নেতৃত্ব দেন। এছাড়াও তিনি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন। নারী শিক্ষা বিস্তারে তাঁর কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি স্বরূপ কিশোরগঞ্জ সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদ ১৯৭৯ সালে তাকে কিশোরগঞ্জের বেগম রোকেয়া উপাধিতে ভূষিত করে।

শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পাকিস্তান আমলে প্রাপ্ত স্টার অব পাকিস্তান পদক তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে প্রত্যাখ্যান করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষা, সাহিত্য ও সমাজকর্মে তিনি তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বেগম রোকেয়া পদক (২০০৯), সত্যজিৎ রায় স্মৃতি পদক (২০০৮), মেডেল অব মেরিট (১৯৯৫), ড. শহীদুল্লাহ স্বর্ণপদক (১৯৯০) এবং শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষিকা (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, ১৯৬৮) পদকসহ প্রায় ৩৫টি পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তিন মেয়ে ও এক ছেলের জননী। এছাড়াও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে বেগম রাজিয়া হোসাইনের রয়েছে এক বৃহৎ পরিবার। বেগম রাজিয়া হোসাইনের ৮৮ তম জন্মদিনের শুভক্ষণে তাঁর সুস্বাস্থ্যের সঙ্গে শতায়ু কামনা করছি।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
তোমার গানের ওপারে
পাওল নাটোর্পের রবীন্দ্র-মূল্যায়ন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে নানা আয়োজন
সর্বশেষ খবর
ফিলিস্তিনকে সহমর্মিতা জানাতে কর্মসূচি দিলো বাম জোট
ফিলিস্তিনকে সহমর্মিতা জানাতে কর্মসূচি দিলো বাম জোট
জার্মানির ইউরোর দলে নেই হামেলস, গোরেৎজকা
জার্মানির ইউরোর দলে নেই হামেলস, গোরেৎজকা
আরও ৫৫ নেতাকে বহিষ্কার করলো বিএনপি
আরও ৫৫ নেতাকে বহিষ্কার করলো বিএনপি
এমপিও আবেদন সরাসরি অধিদফতরে পাঠানো যাবে না
এমপিও আবেদন সরাসরি অধিদফতরে পাঠানো যাবে না
সর্বাধিক পঠিত
শিক্ষার্থী ভর্তির টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ
শিক্ষার্থী ভর্তির টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ
ফুল দিয়ে বরণ, রিট দিয়ে শুরু কোন্দল!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিফুল দিয়ে বরণ, রিট দিয়ে শুরু কোন্দল!
সৌরবিদ্যুতের দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় সরকার
সৌরবিদ্যুতের দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় সরকার
রাজশাহীতে গুটি আম পাড়া শুরু, কেজি ৪০ টাকা
রাজশাহীতে গুটি আম পাড়া শুরু, কেজি ৪০ টাকা
তালের শাঁস খেলে মিলবে এই ১০ উপকারিতা
তালের শাঁস খেলে মিলবে এই ১০ উপকারিতা