সাহিত্য বিভাগের আয়োজনে নির্ধারিত প্রশ্নে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কবি চরু হক। তার জন্ম ৩ এপ্রিল, নেত্রকোণায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। কাব্যগ্রন্থ : পাতা ঝরার শব্দ পাই (২০০৯), ভুল বানানের চিঠি (২০১২), আমার ভেতর হাওয়ার বাসাবাড়ি (২০১৫), সুগন্ধিত দুঃখগুলো (২০১৫), শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০২৩)। পেয়েছেন ‘দেশ পাণ্ডুলিপি পুরস্কার ২০১৪’।
বাংলা ট্রিবিউন: কোন বিষয় বা অনুভূতি আপনাকে কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত করে?
চরু হক: এ মহাবিশ্বের যে অলৌকিক শক্তি ও সৌন্দর্য দিনরাত্রি বিকিরণ হয়ে প্লাবিত করে দিচ্ছে চারদিক, সেই অলৌকিক সৌন্দর্যের হাতছানিই বোধকরি জানান দেয় কবিতা লিখতে হবে।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনি কী ধরনের থিম বা বিষয় নিয়ে কবিতা লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
চরু হক: মানুষ। প্রকৃতি। জগৎ। মানুষের ভেতরকার সুর, প্রকৃতির ভেতরকার সুর। জগতের অন্তর্গত সুর ও ঝংকার। এসব নিয়েই কবিতা লিখতে ভালো লাগে।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনি তাৎক্ষণিক অনুপ্রেরণায় লেখেন, নাকি ধীরে ধীরে শব্দ সাজান?
চরু হক: তাৎক্ষণিকভাবে হৃদয়ে যে অনুভব অনুভূতি দোলা দেয়, তাকেই শব্দের পর শব্দে গেঁথে নিই। এটি মূলত কবিতা লেখার ক্ষেত্রে। কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে কখনো তাৎক্ষণিক কোনো স্পর্শকাতর ঘটনা, আবার কখনো ধীরে ধীরে শব্দ সাজিয়ে আঁকতে চেষ্টা করি জীবনের জলছাপ।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনার কবিতার ভাষা ও শৈলী কীভাবে বেছে নেন?
চরু হক: জীবনযাপনে নিত্য ব্যবহৃত যে ভাষা, তাই আমাকে আকৃষ্ট করে বেশি। পছন্দ করি লেখালেখির ক্ষেত্রে সহজ, সরল, নিরলংকার ভাষায় লিখতে। সমসাময়িক ব্যবহৃত সহজ শব্দাবলির মধ্যে আপন ভাবনার ডানা মেলে ধরা, এইতো।
বাংলা ট্রিবিউন: কোন কোন কবির প্রভাব আপনার লেখায় আছে?
চরু হক: সকল প্রকৃত কবির মধ্যেই একটা হৃদয়ের সেতুবন্ধন আছে। ভাবনার আপাত বৈচিত্র্য থাকলেও শেকড় একই। তাই আমি মনে করি, সকল প্রকৃত কবির প্রভাবই আমার মধ্যে আছে। আমি কবিতার মাধুর্যে আচ্ছন্ন একজন মানুষ। আমার বাবা প্রয়াত কবি নূরুল হক বলেছেন, "কবিতা হলো মহাজগতের মাতৃভাষা। মহাজগতের প্রতিটি অণু পরমাণুতে কবিতা আছে।" বাবার চিন্তা, ভাবনা, দর্শন, জগতকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা আমি গভীরভাবে প্রভাবিত। বিশেষ করে, বলতে গেলে আরো ভালো লাগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুফি জালালুদ্দিন রুমি, লোরকা, হুইটম্যান, পাবলো নেরুদার কবিতা পড়তে।
বাংলা ট্রিবিউন: কথাসাহিত্যের চর্চা করেন? এ চর্চা আপনার কবিতায় কতটুকু প্রভাব রাখে?
চরু হক: কথাসাহিত্যে আমার দুর্বলতা রয়েছে বটে, কিন্তু মনে মনে জানি, অত ভালো লেখা বুঝি হয় না। তবু ভালো লাগে তাই লেখি। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে, আপন খেয়ালে। তাতে চলে আসে কবিতার নিভৃত ছন্দ। কবিতার অন্তর্গত স্পন্দন। তাই উলটো করে বলতে চাচ্ছি আমার কাব্যচর্চা কথাসাহিত্য দিয়ে নয়, কথাসাহিত্যই কবিতার মায়াজালে আচ্ছাদিত।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনার প্রথম কবিতার বই সম্পর্কে কিছু বলুন। প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতি কেমন ছিল?
চরু হক: আমার প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে, কোরাস প্রকাশনী থেকে। গভীর মায়া, ভালোলাগা, অপেক্ষা দিয়ে নির্মিত এই কাব্যগ্রন্থ। নাম রেখেছিলাম "পাতা ঝরার শব্দ পাই"। বাবার হাত ধরে নদীর পাড় ধরে, বনে-বাদাড়ে ঘুরতে ঘুরতে বড় হই আমি। বাবার সাথে সেই সময় প্রতিটা মুহূর্তে ছিলাম উজ্জীবিত। সেই পাতা ঝরার গান শুনতে শুনতে যে সব পঙ্ক্তিমালা গেঁথেছিলাম, তা দিয়ে রচিত হয়েছিল সেই কাব্যগ্রন্থ। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রথম সন্তানের মতো। এরপর যে কয়টা গ্রন্থই প্রকাশিত হয়েছে, সেই প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার উৎসাহ, হৃৎকম্পন, ভালোলাগা আর কোথাও খুঁজে পাইনি।
বাংলা ট্রিবিউন: সমকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক ঘটনা কি আপনার কবিতায় প্রভাব ফেলে? যদি ফেলে, তবে কীভাবে তা প্রকাশিত হয়?
চরু হক: আমরা তো এই জগতেরই অংশ। তাই আমাদের আশপাশে যা যা ঘটছে, সাদা এবং কালো, সুন্দর এবং অসুন্দর, দেব গুণসম্পন্ন এবং কাম-ক্রোধ-ঘৃণা, হিংস্রতা আর নারকীয়তার করাল থাবা, সবই হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে। একটা সুন্দর সুর যখন শুনি, মনে হয় এইতো দেখতে পাচ্ছি ঈশ্বরকে। আবার চারপাশ ধূমায়িত করে শঠতা আর নারকীয়তার যজ্ঞ যখন চলে, তখন দু-চোখ ছাপিয়ে বুঝি প্রবাহিত হয় রক্ত অশ্রু। লেখকদের তো আসলে কলম ব্যতীত আর তেমন কোনো মাধ্যম নেই—জগতের এই আহ্বানে নিজেকে যুক্ত করার, তাই তখন কলম তুলে নেই হাতে। যতদূর দৃষ্টি যায়, আঁকতে চেষ্টা করি।
বাংলা ট্রিবিউন: পাঠকদের মন্তব্য আপনার লেখায় কোনো পরিবর্তন আনে?
চরু হক: হ্যাঁ অবশ্যই। পাঠকের মন্তব্য বোঝার চেষ্টা করি। তাদের চাওয়া-পাওয়ার সাথে নিজের রং মিলিয়ে দিয়ে সাজাই ক্যানভাস। তবে বেসিক ঠিক রেখে।
বাংলা ট্রিবিউন: ভবিষ্যতে কী ধরনের কবিতা লিখতে চান? নতুন কোনো ধারা বা শৈলীতে কাজ করার ইচ্ছা আছে কি?
চরু হক: সুফি জালালুদ্দিন রুমির একটা কথা মনে পড়ল। তিনি বলেছিলেন, ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর অনেক রাস্তা রয়েছে। এরমধ্যে আমি প্রেমকে বেছে নিলাম। আমি তাকে অনুসরণ করেই বলতে চাই যুদ্ধ নয়, প্রেমই হোক জীবনের একমাত্র উপজীব্য। হিংসা নয়, কেবল প্রেম। যে ধারা বা শৈলীতে কাজ করলে আমি জগতকে ভালোবাসার শক্তি খুঁজে পাব, সেই ভাষাকে খুঁজে বেড়াই।