X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১
ইন্টারন্যাশনাল বুকার প্রাইজ

কী আছে ‘টাইম শেল্টার’ উপন্যাসে?

অনিকেত সুর
২৬ মে ২০২৩, ০০:০০আপডেট : ২৬ মে ২০২৩, ০০:০০

গত মঙ্গলবার ইন্টারন্যাশনাল বুকার প্রাইজ পেলেন বুলগেরীয় ঔপন্যাসিক, কবি ও নাট্যকার গিওর্গি গস্পোনিডভ তার সাম্প্রতিকতম উপন্যাস ‘টাইম শেল্টার’-এর জন্য। ‘টাইম শেল্টার’ তার তৃতীয় উপন্যাস। অ্যাঞ্জেলা রোডেলের চমৎকার অনাড়ষ্ট ইংরেজি অনুবাদে তিনশো চার পৃষ্ঠার উপন্যাসটির পাঠ কৌতূহলী সব পাঠকের জন্যই হবে একটি প্রীতিকর অভিজ্ঞতা।

‘টাইম শেল্টার’ সম্পর্কে নোবেলজয়ী ওলগা তোকারজুক বলেন, ‘আমাদের কালদর্শন ও কালযাপন প্রণালি নিয়ে লেখা নিগূঢ়তম সাহিত্যিক সৌন্দর্যের নিদর্শন এটি। রচিত হয়েছে পুরোমাত্রায় অচিন্তনীয় ও নৈপুণ্যনিখুঁত কারুকর্মের সাথে।’

সমালোচক ডেভ এগার্স চিহ্নিত করেছেন ‘ইউরোপের সবচেয়ে চিত্তহর ও অতুলনীয় উপন্যাসগুলোর একটি’ বলে।

এ বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র অগাস্টিন গ্যারিবাল্ডি নামের একজন মনোচিকিৎসক, যার ডাকনাম গস্টিন, যে সমসাময়িক বাস্তবতা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে ভালোবাসে। সে জীর্ণ পোশাক পরিধান করে। পাঠ করে পুরোনো সব খবর। এবং ঘুরে বেড়ায় বিশ শতকের হারিয়ে-যাওয়া রাস্তাগুলোতে। স্মৃতিভ্রষ্ট নারী-পুরুষদের চিকিৎসার জন্য সে জুরিখে একটি ক্লিনিক খুলেছে। এর প্রতিটি তলাকে সাজানো হয়েছে পুরোনো একেকটি দশকের বস্তু ও দৃশ্যমালা দিয়ে- যেন বিশেষ সেই দশকগুলো তাদের সমস্ত কালিক চেহারা নিয়ে হাজির হয়।

উপন্যাসের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে উত্তম পুরুষে। এবং এই কাহিনি বর্ণনা করছে গস্টিনের এক সহকারী । তার কাজ হলো অতীতের সব নিদর্শন, হারানো কালের সব স্মারকচিহ্ন এনে প্রতিটি তলায় জড়ো করা। ষাট দশকের আসবাবপত্র। চল্লিশ দশকে ব্যবহৃত জামার বোতাম, পারফিউম, এমনকি হারানো দিনের বৈকালিক আলোর সঙ্গে দৃশ্যমান সব ছবি ও তাদের রং এবং এ রকমের আরও অনেক কিছু।

মনোচিকিৎসার এই গস্টিনীয় রীতি বেশ সাড়া জাগায়। বর্তমান থেকে পালিয়ে অতীতের ভেতর আশ্রয় নেবার উদ্দেশে ক্রমবর্ধমান হারে সুস্থ লোকেরাও আসতে শুরু করে তার ক্লিনিকে। সমস্ত ইউরোপ জুড়ে এই ‘আদর্শ’ ক্লিনিক স্থাপনের হিড়িক পড়ে যায়। সময়ের অগ্রগতিকে থামিয়ে একটা কল্পিত নিরাপত্তার বেষ্টনীর ভেতর আশ্রিত লোকেরা মানসিক সুখের সন্ধান করে।

এদিকে গস্টিনের ক্লিনিকে অতীতে আশ্রয়-খোঁজা মানুষের জীবনে নেমে আসে বিমূঢ় বিভ্রান্তি, একটা প্রহেলিকা, যেখানে বর্তমানে এসে হানা দেয় অতীত। ভবিষ্যতকে স্থগিত করে দেবার এই আকাঙ্ক্ষা ক্রমে বিস্তৃত হলে অতীত ও বর্তমানের সীমারেখা ঝাপসা হতে শুরু করে। ইউরোপের সব জাতি ‘গৌরবময় অতীতের জন্য ভোট’ দেবার প্রস্তুতি নেয়। তারা অতীতকে এনে ভবিষ্যতের গর্ভে স্থাপন করতে ব্যগ্র হয়ে ওঠে।

লেখক এইভাবে পূর্ব ইউরোপ এবং ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের অতীত ও বর্তমান রাজনীতির বৈশিষ্ট্যকে উপন্যাসের ফর্মে নিজস্ব ভঙ্গিতে তুলে এনেছেন। আঙুল নির্দেশ করেছেন ব্রেক্সিট এবং পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণের দিকেও। এই রাজনীতি, চলমান এই কর্মকাণ্ড যেন গড়ে তুলতে চাইছে সময়ের একটা নিখুঁত মানচিত্র, যেখানে কালরেখা অবশেষে একটি আরেকটির সাথে মিলেমিশে যাবে। অবশ্য আদৌ তা যদি ঘটে। কিন্তু শেষাবধি পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। গস্টিন লাপাত্তা হয়ে যায়। কাহিনি বর্ণনাকারীর (গস্টিনের সহকারী) নিজেরই স্মৃতি কেমন গোলমেলে হয়ে ওঠে। একটির জায়গায় আরেকটি এসে কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়। সে বলে ওঠে, ‘গস্টিন, যাকে আমি প্রথম কল্পনা করেছিলাম, তারপর যার সশরীর সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম, অথবা, হতে পারে, উল্টোটাই ঘটেছিল, আমার ঠিক মনে নেই।’ -পাঠকের মনে তখন এই প্রশ্ন জাগে, গস্টিন নামে আদৌ কি কেউ ছিল, নাকি সে বর্ণনাকারীর কল্পনামাত্র?

সব মিলিয়ে ‘টাইম শেল্টার’ একটি জটিল, চিন্তামূলক আখ্যান। মাঝে মাঝে তা ভীতি-জাগানিয়াও। এবং এসবের মধ্য দিয়েই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠককে নিমগ্ন রাখে।

উপন্যাসটি পাঁচটি আখ্যানভাগে বিভক্ত। স্মৃতিভ্রষ্টতা, পলায়ন, কালের গতি নিয়ন্ত্রণ ও তাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা, এবং সম্মুখগতির বদলে অতীতে বসবাসের পরিণতি।

একটা কৌতুক-আবহের ভেতর স্মৃতিকাতরতার বর্ণনা দিয়ে উপন্যাস শুরু, তারপর শেষে এসে হাজির অরাজকতা আর তীব্র গভীর দুর্ভোগ।

উপন্যাসটি পাঠশেষে আমাদের মনে একটা সত্যবোধ দৃঢ় হয়, অতীতকে ফিরিয়ে আনা যায় না। কারণ ভবিষ্যতকে কখনও অতীতের একটা সংস্করণ হিসেবে নির্মাণ করা যায় না। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর এক নিবন্ধে গিওর্গি গস্পোনিডভ লেখেন, ‘আমার সাম্প্রতিকতম উপন্যাসে আমি অতীতের ভূতগুলোর কথা বিশদ বলেছি। বলেছি ১৯৩৯ সালের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর একটা ঘটনাদৃশ্য দিয়ে আমি শেষ করেছি উপন্যাস।...আমরা কি চিরকাল ১৯৩৯ সালের প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে থাকব? এতসব কিছু ঘটে যাবার পরও আমরা কি ফিরে যাব ইতিহাসের সেই বিপজ্জনক সময়টিতে? কেন?’

গিওর্গি গস্পোনিডভ গিওর্গি মূলত কবি। কৌতুক আর আত্মবিদ্রূপের সঙ্গে কাহিনির প্রাণে তিনি সঞ্চার করেন কবিতার কম্পন যা তার উপন্যাসকে দেয় ভিন্নমাত্রা। এতে বর্ণনা হয়ে হয়ে ওঠে মর্মভেদী, গাঢ় আবেদনমণ্ডিত। আর সকল কবির মতোই তিনিও যুদ্ধবিরোধী। শান্তিবাদী। বিচ্ছিন্নতা ও সংঘাতের বদলে মানবীয় ও মানবিক ঐক্যই তার ধ্যান। ‘টাইম শেল্টার’ তার এই হিতমগ্ন ধ্যানের অনিন্দ্য ফসল। মনে হতে পারে, এটি কেবল ইউরোপের ইতিহাস আর জীবন নিয়ে লেখা। আমাদের এ নিয়ে মাথা ঘামাবার কী আছে! কিন্তু না। উপন্যাসে বর্ণিত অতীত চারিতা কেবল ইউরোপে নয়, পৃথিবীর সবখানেই আছে। আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি, ভারতে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান, এই সবকিছুর দিকেও এর অনভিষ্ট ইঙ্গিত আছে।

৫৫ বছর বয়েসি গিওর্গি গস্পোনিডভের লেখকজীবন শুরু হয় কবিতা দিয়ে। তার প্রথম উপন্যাস ‘ন্যাচারাল নভেল’, যা প্রকাশের পরপরই ২১টি ইউরোপীয় ভাষায় অনূদিত হয়। দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দ্য ফিজিক্স অব সরো’। ‘অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ নামে একটি ছোটগল্প সঙ্কলনও আছে তার। ‘ইন্টারন্যাশনাল বুকার প্রাইজ’ জেতার আগে তিনি পেয়েছেন আরও সতেরোটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার। ইউরোপের সবচেয়ে মেধাদীপ্ত ও অগ্রগামী লেখকদের একজন মনে করা হয় তাকে।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
রাজনীতি ঠিক না হলে অর্থনীতি ঠিক হবে না: সালেহউদ্দিন আহমেদ
ড. মাহবুব উল্লাহর ‘আমার জীবন আমার সংগ্রাম’ বইয়ের পাঠ উন্মোচন 
ভুটানি ভাষায় বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন
সর্বশেষ খবর
ওডেসায় একটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত ৫
ওডেসায় একটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত ৫
বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যায়পাল নিয়োগের পরামর্শ ইউজিসির
বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যায়পাল নিয়োগের পরামর্শ ইউজিসির
‘৭ জানুয়ারি নৌকার প্রার্থীকে জেতানোর জন্য আমরা অনেক অপকর্ম করেছি’
‘৭ জানুয়ারি নৌকার প্রার্থীকে জেতানোর জন্য আমরা অনেক অপকর্ম করেছি’
চুয়াডাঙ্গা জেলায় ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুয়াডাঙ্গা জেলায় ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
সর্বাধিক পঠিত
এসি কেনার আগে মনে রাখতে হবে এই ৭ বিষয়
এসি কেনার আগে মনে রাখতে হবে এই ৭ বিষয়
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
ফালুর বিরুদ্ধে দুদকের চার্জশিট অনুমোদন
ফালুর বিরুদ্ধে দুদকের চার্জশিট অনুমোদন
১০ দিনে ভরিতে কমলো ৮ হাজার টাকা
সোনার দাম১০ দিনে ভরিতে কমলো ৮ হাজার টাকা
ট্রাকের চাকায় পিষে দেওয়া হলো ৬ হাজার কেজি আম
ট্রাকের চাকায় পিষে দেওয়া হলো ৬ হাজার কেজি আম