X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

দৈহিক মিলন হবে বিশুদ্ধ আত্মার ঘ্রাণ

মিলন আশরাফ
২১ জুন ২০১৭, ১৬:৪৯আপডেট : ২১ জুন ২০১৭, ২০:০৪

দৈহিক মিলন হবে বিশুদ্ধ আত্মার ঘ্রাণ
রোগা-পটকা লাল রঙের দাঁড়িতে অদ্ভুত ধরনের একটা ব্যক্তিত্ব ছিলো তাঁর। বাল্যকালে প্রথম প্রেমে পড়েন ফেসিয়া চেম্বারস নামে এক মেয়ের। ফেসিয়া-এবং তাঁর মা’র ভেতরের টানাপোড়নের ব্যক্তিগত কাহিনিকে আমরা তাঁর উপন্যাস ‘সন্স অ্যান্ড লাভার’স’ এর ভেতরে দেখতে পাই। এরপর এক বিবাহিত মহিলা এলিস ডাস্কের সাথে প্রথম যৌন সম্পর্ক হয়। সে-ই প্রথম তাঁকে যৌনতা সম্পর্কে সৃষ্টিশীল চিন্তাধারায় সলতে তে আগুন ধরিয়ে দেন। ১৫ এর কোঠায় এসে তিনি লুই বরোজ নামের এক সুন্দরীর প্রেমে পড়েন। যার ফলে আগের সম্পর্কের ছেদ ঘটে।

উল্লেখ্য যে, উপরের তিন নারী-ই তাঁর প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। কিন্তু ওদের জীবনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তিনি। প্রমাণ হিসাবে আমরা দেখতে পাই- প্রবঞ্চিতা ফেসিয়া চেম্বারস অবিবাহিতা থেকে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেন। এলিস ডাস্ক সারাজীবন পথ হেঁটেছিল তাঁর উজ্জ্বল স্মৃতিকে হৃদয়ে ধারণ করে। আর লুই বরোজ বিয়ে করেছিলেন লেখক মারা গেলে।

বিশ্বখ্যাত ছোটগল্পকার ক্যাথরিন ম্যানসফিল্ড ও তাঁর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও সেটা যে প্রেমই ছিল সে খবর জানাজানি হয় ‘দি লস্ট গার্ল’প্রকাশের মধ্য দিয়ে। ক্যাথরিন তাঁর বিয়ের পরও বহুবার দেখা-সাক্ষাৎ করেন। ম্যানসফিল্ডকে নিয়ে তারও যে আগ্রহের কমতি ছিল না এমনটি জোর গলায় বলতে পারি না আমরা। কারণ এ কথা তো দিনের আলোর মতো সত্য যে, ১৯২০ সালে প্রকাশিত ‘দি লস্ট গার্ল’ক্যাথরিনকে নিয়েই লেখা। উপন্যাসে বর্ণিত আলভিনা চরিত্রের মতো ম্যানসফিল্ডের বাবাও ছিলেন ব্যবসায়ী। আলভিনার ঘর ছাড়ার সঙ্গে ক্যাথরিনার গৃহত্যাগের হুবহু মিল। উপন্যাসের আলভিনা উত্তর লন্ডনের কঠিন জীবন পার করেন প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে এসে। থাকেন বোর্ডিং হাউসে। অনুরূপভাবে ১৯০৮ সালে লন্ডনের সংগীতজ্ঞ গারনেট ট্রাওলের প্রেমে পড়েন ম্যানসফিল্ড। তবে ১৯০৯ এ এসে জর্জ বাউডেনকে বিয়ে করেন কিছুটা হঠাৎ করেই। কিন্তু বিয়ের রাতে সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে প্রেমিকের সঙ্গে থাকতে আরম্ভ করেন ম্যানসফিল্ড। শুধু এখানে নয় ‘উইমেন  ইন লাভ’উপন্যাসেও ক্যাথরিন ম্যানসফিল্ডের সরব উপস্থিতি আমাদের নজর এড়িয়ে যায় না। 

১৯১২ সালে আবারও তিনি উইক্নির নামের একজনের প্রেমে পড়েন এবং উভয়ই পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেন। এরপর ওই একই সালে মার্চ মাসে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় অভিজাত জার্মানি মহিলা ফ্রিদার। ফ্রিদা ছিলেন নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আর্নেস্ট উইকলির স্ত্রী। এই অধ্যাপক ছিলেন লেখকের প্রাক্তন শিক্ষক।  তিন সন্তানের জননী  সুন্দর ফিগারের ফ্রিদা তাঁর চেয়ে ৬ বছরের বড় ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ফ্রিদা পালিয়ে আসেন নিজ পৈতৃক বাড়িতে। সেটা ছিল জার্মানির গ্যারিসন শহর মেটজ এ। শহরটি ছিল ফ্রান্স ও জার্মানির অশান্ত সীমান্ত অঞ্চলের কাছাকাছি। এখানে থাকাকালীন সময়ে সামরিক বাহিনির সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষ বাধে। ব্রিটিনের হয়ে চরবৃত্তি করছে এমন অভিযোগ এনে তাকে গ্রেফতার করা হয়। অবশেষে ফ্রিদার বাবার মধ্যস্থতায় ছেড়ে দেওয়া তাঁকে। এসব ঘটনায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি চলে আসেন মিউনিখের একটি ছোট্ট গ্রামে। সত্যিকার অর্থে এখানেই হয় তাঁদের মধুচন্দ্রিমা। তাঁর ‘লুক উই হ্যাভ কাম থ্রু’ (১৯১৭) নামক প্রেমের কবিতাটি এইসব স্মৃতিতে ভরা। সারাটা জীবন খুব ভালো না কাটলেও, ফ্রিদার সঙ্গে যৌন সহচর্য বেশ ভালোভাবে উপভোগ করেছেন তিনি। লেখক যখন সাধারণ লোকদের মধ্যে যৌন শিক্ষা প্রচারে ব্যস্ত থাকতেন, তখন ফ্রিদা ইতালিয়ান চাষী আর অফিসারদের সঙ্গে যৌন সঙ্গমে মিলিত হতেন। এই বিষয়ে একটা সংঘও গঠন করেছিলেন তাঁরা। উক্ত সংঘের কাজ ছিল রক্তমাংসের শরীরের ইচ্ছার ক্ষুধাগুলোকে মেটানো। তাঁর ‘উইম্যান ইন লাভ’বইয়ে এই বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া আছে। এছাড়াও ‘লেডি চ্যাটার্লীজ লাভার’বইয়ের মাধ্যমে তিনি আমাদেরকে জানান দিচ্ছেন যে, ‘আমি এমন পুরুষ এবং মহিলা দেখতে চাই, যারা সৎ, স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার ভাবে যৌন চিন্তা করে।’তাঁর বন্ধু এবং আত্মজীবনীকার রিচার্ড আলকিংটন এর কাছ থেকে আমরা জানতে পারি- ‘মেয়েদের সঙ্গে যখন ওর বিরক্তি ধরে যেতো, তখন সে কোন পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক কামনা করত। পুরুষের নগ্ন দেহ তাঁকে নাকি মুগ্ধ করতো।‘

যৌন বিষয়কে অবলম্বন করে এমন বলিষ্ঠ সাহিত্য তাঁর সমকালে আর কেউ রচনা করেননি। খোলাখুলি যৌন ঘটনাবলীর বর্ণনা দেওয়াতে তাঁর অধিকাংশ বইকে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯২০ সালে ‘উইম্যান ইন লাভ’উপন্যাসটি গোপনে ছাপা হয়। ‘দি রেইনবো’উপন্যাসটি এতোটাই বিতর্কিত ছিল যে, এজন্য তাকে আদালত পর্যন্ত যেতে হয়। অবশ্য পরে আদালত তাঁকে মুক্তি দেয়। যৌন তৃষ্ণাকে তিনি সব সময় স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পরামর্শ দেন। তাঁর অন্যতম প্রধান উপন্যাস ‘সন্স অ্যান্ড লাভারস’এ যৌনতা বিষয়ে অনেকগুলো বক্তব্য স্পষ্ট। উপন্যাসটিতে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন হৃদয়হীন শরীর বা শরীরহীন হৃদয় অসম্পূর্ণ। এই অসম্পূর্ণ সত্তা সামাজিকভাবে ক্ষতিকর। কাহিনিতে আমরা দেখতে পাই, একটি মেয়ে তার ছেলে বন্ধুর সঙ্গে শুধু মৌখিক প্রেমে উৎসুক, শরীরের প্রেমে সে উৎসাহী নয়। আবার ঐ একই ছেলের সঙ্গে ভিন্ন একটি মেয়ে যৌন সম্পর্কে আগ্রহী, হৃদয় সেখানে অনুপস্থিত। তিনি মনে করেন এই দুই প্রকারের প্রেম-ই ক্ষতিকারক। তিনি শেক্সপিয়ারের মতো মনে করতেন, ‘লাভ ইজ দি কম্বিনেশন অব বডি অ্যান্ড সোল।’ আমাদের ভালো থাকার জন্য অবশ্যই মনোদৈহিক একটি সম্পর্কের প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে ‘লেডি চ্যাটার্লী’জ লাভার’বইটি একটা দুর্দান্ত উপন্যাস। খোলামেলা সঙ্গমের দৃশ্য বর্ণনা এমন দুঃসাহসিকভাবে তাঁর আগে কেউ দেননি। দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ থাকার পর ১৯৬০-এ কাটছাঁটের মাধ্যমে তা প্রকাশ করতে দেওয়া হয়। বইটি ১৯২৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। তিনি তাঁর উপন্যাস গুলোতে দেখাতে চেয়েছেন জীবনের প্রত্যেকটির অধ্যায়ের মূলে রয়েছে যৌনশক্তি। কবিতার ক্ষেত্রেও তাঁকে আমরা ফ্রয়েডের ভাবশিষ্য হিসেবে দেখতে পাই। সেখানে মানসিক অবদমনকে তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। যৌন তাড়নার যে তীব্র আবেগ সেটা তাঁর কবিতায় বেশ ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। তাঁর প্রায় সব কবিতায় নর-নারীর প্রার্থিত মিলনের আনন্দ উদ্ভাসিত। সবকিছুর ভেতর আগ্রাসী যৌন ক্ষুধা। তিনি বারবার বোঝাতে চেয়েছেন পাকস্থলির ক্ষুধার চেয়ে যৌন ক্ষুধা মারাত্মক। তাঁর লেখা ‘ম্যানিফেস্টো’কবিতায় এসব বিষয় লক্ষণীয়। তিনি বিশ্বাস করতেন দৈহিক মিলন হবে বিশুদ্ধ আত্মার ঘ্রাণ।

অন্যদিকে ১৯১৬-১৭ সালে ‘উইমেন ইন লাভ’লেখার সময় তাঁর সঙ্গে উইলিয়াম হেনরি হকিং নামের এক কৃষকের অত্যন্ত ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কেউ কেউ এটাকে সমকামীর পর্যায়েও নিয়ে যায়। তবে এটাকে নিছক গুজব বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ তিনি সমকামী বিষয়ে পজেটিভ ছিলেন। ‘উইমেন ইন লাভ’উপন্যাসে এই সব বিষয়ে প্রায় খোলাখুলি আলোচনা করেছেন তিনি। সমকামিতা সম্পর্কে স্বীকারোক্তি রয়েছে ১৯১৩ সালে তাঁর লিখিত একটি চিঠিতে। সেখানে তিনি জানান, ‘আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, মানুষ কেন মহত্বের প্রতি অগ্রসর হয়ে নিজের ভেতর জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে সমকামী মনোভাব ব্যক্ত করে।’তাঁর লেখায় তিনি আরও বলেন, ‘ষোলো বছর বয়সে এক তরুণ কয়লা শ্রমিকের সংস্পর্শে এসেছিলাম, আমার মনে হয় সেই আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রণয়ী।’এভাবে ব্যক্তিজীবন ও লেখকজীবন একাকার হয়ে মিশে আছে যে লেখকের তিনি আর কেউ নন, বিশ্বসাহিত্য অঙ্গন উত্তপ্ত করা ডেভিড হারবার্ট লরেন্স। আমরা সবাই তাঁকে ডি. এইচ. লরেন্স নামেই চিনি।


আরও পড়ুন-

লেখকদের কিছু রঙ্গ-রসিকতার ঘটনা

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ফুটবল লেখকদের ভোটে বর্ষসেরা ফডেন
ফুটবল লেখকদের ভোটে বর্ষসেরা ফডেন
চীন সফরের পরিকল্পনা করেছেন পুতিন
চীন সফরের পরিকল্পনা করেছেন পুতিন
টসে জিতে বোলিংয়ে বাংলাদেশ
টসে জিতে বোলিংয়ে বাংলাদেশ
কম শক্তির আবাহনীর বিপক্ষেও জিততে পারেনি মোহামেডান
কম শক্তির আবাহনীর বিপক্ষেও জিততে পারেনি মোহামেডান
সর্বাধিক পঠিত
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
কামরাঙ্গীরচরে নতুন ভবন নির্মাণের অনুমতি দিলো ডিএসসিসি
কামরাঙ্গীরচরে নতুন ভবন নির্মাণের অনুমতি দিলো ডিএসসিসি
কুমিল্লায় বজ্রাঘাতে ৪ জনের মৃত্যু
কুমিল্লায় বজ্রাঘাতে ৪ জনের মৃত্যু
আরও কমলো সোনার দাম
আরও কমলো সোনার দাম
ব্যর্থতার অভিযোগে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়ে আইনি নোটিশ
ব্যর্থতার অভিযোগে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়ে আইনি নোটিশ