X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রোবটি বশীকরণ

নাজমুল হক তপন
০৮ মার্চ ২০১৬, ২০:৪৭আপডেট : ০৮ মার্চ ২০১৬, ২০:৫১

সেরা দশ গল্প

মেয়েটি অতি চৌকস। ক্লাসে, ল্যাবরেটরিতে , মহল্লা ,বাড়ি কিংবা ডিপার্টমেন্ট সবখানেই নিখাদ । কাজে ফাঁকি নাই , ত্রুটি নাই। ভার্সিটির মত বাড়িতেও তার উপর কমবেশি সবাই নির্ভরশীল। ক্লান্তি , শ্রান্তি নামের শব্দটা হার মেনেছে মেয়েটার ইচ্ছাশক্তির কাছে। তার সবকিছুই এতই গোছানো যে তাকে দেখে মনে হয় যেন আগে থেকেই সব প্রোগ্রামিং করা। আর তাই ভার্সিটি থেকে বাসা পর্যন্ত তার নাম হয়ে গেল রোবটি (রোবটের ফিমেল ভার্সন)।

পড়া বুঝিয়ে নেওয়ার জন্য ডিপার্টমেন্টের জুনিয়ররা তো বটেই সহপাঠীদেরও ভরসা মেয়েটি। ১৬ ডিসেম্বর , ২৬ মার্চ এমন দিনগুলোতে মহল্লার বাচ্চাদের নিয়ে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন  সবকিছুই মেয়েটির তত্ত্বাবধানে। একটা নামি কোচিং সেন্টারে পার্ট টাইম কাজ করে। এর সঙ্গে স্টাইপেন্ডের টাকা দিয়ে প্রেশার ও সুগার মাপার (ডায়াবেটিক টেস্ট) যন্ত্র কিনে রেখেছে নিজের কাছে। এগুলো কাজে লাগে মহল্লার বয়স্কদের।

এই রোবটিকে সমীহ না করে উপায় নাই কারও। ঠিকঠাক মতই চলছিল সবকিছু। হঠাৎ করেই আমদানি ঘটল এক নতুন পাগলের। সব নিয়ম কানুন না মানা এক সাধারণ চেহারার কালাকুলো ছেলে। নিয়মের বাহুল্য , ক্যারিয়ার, ভব্যতা সবকিছু উড়িয়ে দেয় তুড়ি মেরে। সারাক্ষন টই টই। দিনে রাতে। এই সমুদ্র তো এই বনে। প্রচন্ড শীত অনুভব করতে উত্তর বঙ্গে তো পরের সপ্তায় হাতির পালের সন্ধানে শেরূপুর সীমান্তে। সাহিত্য চর্চ্চা ,ভ্রমন , আড্ডা - কে বলবে পৃথিবীতে দুঃখ - জরার কোন অস্তিত্ব আছে? সবার মুখে রোবটির কথা শুনে শুনে  রোবটি বিষয়টা মাথায় ঢুকে গেল ছেলেটির ............পেয়ে বসল রোবোটিক - সিনড্রোমে। দুজনের পরিচয়টা অবশ্য একটু অন্যভাবে। কয়েকজন সহাপঠিকে বেসিক ম্যাথস করাচ্ছিল রোবটি। সবার উদ্দেশ্যে ছেলেটি বলে উঠল, ‘গণিতকে সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যায় কবিতা দিয়ে।’ দূর যত সব পাগলামি, এটা আবার হয় নাকি? রোবটির উত্তর’। জবাবে ছেলেটির ভাষ্য, ০.. থেকে .. ৯ মাত্র ১০ টা অংক। অথচ এই ১০ অংক দিযে বিলিয়ন বিলিয়ন, ট্রিলিয়ন সংখ্যা বানানো যায়। এর একমাত্র ব্যাখ্যা দিতে পারে কবিতা, ‘ সীমার মাঝে অসীম .....’। রোবটি হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ে। মানে লজিক পছন্দ হয়েছে।

দক্ষিণবঙ্গ সফর শেষ করে ওই বালিমাখা জিন্স আর খোঁচাখোঁচা দাড়ি নিয়েই ঢুলতে ঢুলতে পা রাখল ক্যাম্পাসে। পেয়ে গেল ভক্ত বেষ্টিত রোবটিকে। কাউকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ... চিংড়ি ঘেরের মাছ চাষ আর ডাকাতির গল্প জুড়ে দিল। .. মাছের ঘের এবং ডাকাতি  নিয়ে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর একটা কবিতাও বেসুরো কণ্ঠে আবৃতি করলো......

 ’ঘেরে ঘেরে ঘেরাও হইল চারিদিক

                         ঘেরের গাড়ি চলছে ছুটে দিক বিদিক

                        অল্প পুজি বেশি লাভ চারিদিকে চিংড়ির চাষ

                       

                             .... আরে হারে হারে হারিয়া

                                 নিইছে সবই কাড়িয়া

                      চাইল্যে - ডাইল্যে হয় খিচুড়ি

                                     তল্লাটে নাই ঘি....।

কবিতা শেষ না করেই চিংড়ির মাথায় যে তরবারি আকৃতির করাত থাকে তার কয়েকটা ছেলেটা তুলে দিল কয়েকজনের হাতে। সবথেকে বড়টা দিল রোবটিকে। ঘেরে সবথেকে বড় চিংড়ি হয় ৭০০/৮০০ গ্রাম পর্যন্ত। এই ধরনের একটা চিংড়ির মাথায় যে করাত থাকে তা নেহায়েত চার ইঞ্চির কম না।

ইতস্তত করেও রোবটি এটা নিল। এই রকম একটা জিনিস তার সুন্দর সাজানো শোকেসে দারুন মানাবে মনে হতেই তার মন নরম হয়ে গেল।  পারলে রুদ্রর ক্যাসেট শুনে নিও বলে কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই .... ছুটতে ছুটতে চলে গেল ছেলেটি। চিংড়ির করাত শোকেজে রাখার আগে রুদ্রর একটা ক্যাসেটও কিনল মেয়েটা। এ থেকে একটু আধটু চা খাওয়ার সম্পর্কও তৈরি হলো দুজনের। মেয়েটির সামনে পুরো দেশ তুলে ধরে ছেলেটি ------- বাংলাদেশের নদীগুলোর মধ্যে নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুরের সোমেশ্বরি নদীর পানি সবচেয়ে স্বচ্ছ ... এখানকার মহাশোল মাছ কেন বিখ্যাত , কাতলা মাছ ভীষণ বোকা , মৃগেল মাছ ভীষণ চালাক ... রুই অ্যাডভেঞ্চারাস। নীচে যত হাত পানি থাকে রুই তত হাত লাফ দিতে পারে। তাই রুই জালে আটকানোর জন্য নীচের পানির হিসাব কষে পাতা হয় জালের ফাঁদ। মেঘনা নদীতে বড়শি দিয়ে বড় আকৃতির কাল-বাউশ শিকার করা নিয়ে লেখা হতে পারে ’দ্য ওল্ড ম্যান ইন দ্য সি’এর মত উপন্যাস। ঝিনাইদহ’র ঢোল সমুদ্র পুকুর নিয়ে মিথ ... কিংবা বর্ষকালের রাঙ্গামাটি লেক ধরে যাওয়ার পথে ঝর্ণাধারার পর ঝর্ণাধারা... শুভলংয়ে প্রবল বেগে নামা পাহাড়ি ঝর্ণায় স্নান .......।

নতুন এক বাংলাদেশকে দেখতে শুরু করে মেয়েটি। সিলেট শ্রীমঙ্গলের লাওয়াছড়া বনের এ মাথা থেকে ওমাথা (২০ কিমি এর মত) পর্যন্ত হাটতে হাটতে হাজারও বানরের দুষ্টামি , উল্লুক আরও কত কি গল্প শোনে মেয়েটা। আবার ছেলেটা লাপাত্তা। যথারীতি উদভ্রান্তের মতো ক্যাম্পাসে। শ্রীমঙ্গল হয়ে বড়লেখা গ্রাম থেকে আতর নিয়ে এসেছে সে। পৃথিবীর অন্যতম সুগন্ধি আতর তৈরি হয় বড়লেখা গ্রামে। আগর গাছ থেকে তৈরি হওয়া এই সুগন্ধি আতর যায় মধ্য প্রাচ্য থেকে ইউরোপে। ছোট্ট শিশি ভর্তি আতরও মেয়েটিকে দেয় সে। একটু একটু প্রতিক্রিয়া হতে থাকে মেয়েটির ভেতরে। একদিন একসঙ্গে ভাত খাওয়ার সময় ছেলেটি বলে ওঠে... যখন হাত দিয়ে ভাত খাই তখন মনে হয় আমার হাতের স্পর্শে ভাত নয় উঠে আসে মুঠো মুঠো বাংলাদেশ।’ ভেতরটা একটু এলোমেলো হয়ে যায় মেয়েটার। কিন্তু নিজেকে সামলে নেয়ার যে ভীষণ ক্ষমতা রোবটির! একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। এবারের সমুদ্রযাত্রার সময় মেয়েটিকে বলে যায় ছেলেটি। কোথাও যাওয়ার আগে কাউকে বলে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি ছেলেটি। কিভাবে যেন এটা বুঝে ফেলে অসম্ভব বুদ্ধিমতি মেয়েটি। ফেরে বেশ কয়েক দিন বাদে। হাতে বেশ কয়েকটা শঙ্খ। মেয়েটির দিকে একটা শঙ্খ বাড়িয়ে দেয়। .... এর আগে কখনো সমুদ্র দেখেনি মেয়েটি। শঙ্খ নিয়ে ধরে কানের কাছে।  শুনতে পায় শো শো শব্দ। খুব অস্ফুটে মেয়েটি বলে ওঠে.... ঠিক সমুদ্রের শব্দের মতো। মেয়েটির কথা শেষ না হতেই ছেলেটি বলা শুরু করে ......

 বিন্দু বুকে সিন্ধুর ছায়াপাত সম /

 শঙ্খ বাজে সমুদ্র তরঙ্গের আভাষের মত...

অজানা আবেগে কেপে ওঠে মেয়েটি। ভিজে ওঠে চোখ। চোখের পানি লুকাতে তাকায় মাটির দিকে। চোখ এড়ায় না ছেলেটির খুব সময় নিয়ে আস্তে আস্তে বলে, এই বিশ্বসংসারে চোখের পানির চেয়ে পবিত্র আর কিছু নাই। মেয়েটি প্রত্যাশা করে ছেলেটি হাত রাখবে তার হাতে। কিন্তু কোনও এক অবোধ্য কারণে সব বুঝেও ছেলেটি হাত বাড়ায় না। দাড়িয়ে থাকে চুপচাপ। নীরবতা না ভেঙ্গেই ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করে মেয়েটি। তাকে অনুসরন করে ছেলেটিও। উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটার একটা পর্যায়ে ফুল বিক্রি করা দুই পিচ্চির সামনে এসে ছেলেটি দাঁড়ায়। ইশারায় থামতে বলে মেয়েটিকেও।  সবগুলো ফুল কিনে মেয়েটিকে দেয় ছেলেটি। সঙ্গে ওই পরিমান টাকা না থাকায় মেয়েটির কাছে .. টাকাও চায়।

এরপর যা ঘটল সেটাই শাশ্বত.. সেটাই চিরন্তন। ছেলে মাত্রই মোস্ট ডোমেস্টিক , মোস্ট ওবিডিয়েন্ট এটা এখন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে মেয়েটি। মাঝে মধ্যে পুর্ণেন্দু পত্রির ’কথোপোকথন’ কবিতার আবৃতি শোনে। ওই কবিতার একটা লাইন মেয়েটির ভীষণ প্রিয়......’ তোমার মধ্যে আমার অনন্তকালের বসবাসের ইচ্ছা।’ কথোপোকথন কবিতায় মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে ছেলেটার কথা এটা। রোবটি বাংলার চেয়ে ইংরেজিটা ভালো বোঝে। তাই এই লাইনটির ইংরেজিও করে দিয়েছে ছেলেটি। তবে একটু নির্লজ্জভাবে ...... ম্যান অলওয়েজ ওয়ান্টস টু লিভ ইনসাইড উইম্যান।

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বিএনপি গণতন্ত্রে অকার্যকর ডামি রাজনৈতিক দল: ওবায়দুল কাদের
বিএনপি গণতন্ত্রে অকার্যকর ডামি রাজনৈতিক দল: ওবায়দুল কাদের
চারতলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে মাদ্রাসাছাত্রীর মৃত্যু
চারতলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে মাদ্রাসাছাত্রীর মৃত্যু
বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে থাইল্যান্ডের বিনিয়োগ চান প্রধানমন্ত্রী
বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে থাইল্যান্ডের বিনিয়োগ চান প্রধানমন্ত্রী
এবার ঘুমটা ভালো হবে ডু প্লেসির
এবার ঘুমটা ভালো হবে ডু প্লেসির
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী