X
মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

তিতুমীরের জন্মভিটায় || পর্ব-৪

মুহম্মদ মুহসিন
১৬ মে ২০১৭, ১৬:১২আপডেট : ১৬ মে ২০১৭, ১৬:২৫

তিতুমীরের জন্মভিটায় || পর্ব-৪ পূর্বপ্রকাশের পর

স্মৃতি ঝাঁকিয়ে যেটুকু ইতিহাস বের হলো তা দিয়ে এই পর্যন্ত বুঝে-সুঝে শুরু করলাম ফেরত যাত্রা। পথে একজনকে জিজ্ঞস করলাম এখানকার বাঁশের কেল্লা বিষয়ক ইতিহাস ভালো বলতে পারবে এমন কোনো মুরুব্বি পর্যায়ের কেউ আছেন কিনা। তিনি এক স্কুল শিক্ষকের কথা বললেন এবং বলে দিলেন ফিরতি পথেই স্কুলটি পড়বে। সেই আশায় হাঁটতে শুরু করলাম ফিরতি পথে। কিছুদূর এগিয়ে একটি গ্রাম্য চায়ের দোকান বা রেস্টুরেন্টের মতো খাবার ঘর পেলাম। রেস্টুরেন্টটি মূলত মালিকের মূল বসতঘরের সাথে লাগোয়া একটি খোলা বারান্দা। অনেকটা ঘরের ভিতরে রান্না করে বারান্দায় বসে মেহমান খাওয়াচ্ছে এমন আয়োজন। বেলা দুপুর। সকালের নাস্তা হয়নি। ভাবলাম ওটার মধ্যে গিয়ে কিছু খাবার-দাবার পাওয়া যায় কিনা দেখা যাক। কাছে যেতেই এক মহিলা উৎসুকভাবে জানতে চাইলেন, ‘আপনি, কাউকে খুঁজছেন?’ বললাম-‘আমি তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার ওখানে এসেছিলাম, বাঁশের কেল্লার ইতিহাসাদি ভালো জানেন এমন একজন মানুষ খুঁজছি।’ উনি অমনি একটি অল্প বয়সী লোককে ডাক দিয়ে থামালেন। লোকটি একটি সাইকেলে কোথাও যাচ্ছিলেন। লোকটি মহিলার কাছ থেকে আমার আগ্রহের বিষয় সম্পর্কে শুনে সাইকেল থেকে নেমে দোকানে ঢুকে বসলেন। এদিকে আমি জানতে চাইলাম নাস্তা আকারে কিছু খাওয়ার আছে কিনা। কেটলিতে চা বানাচ্ছেন এমন একজন মাঝ বয়সী লোক জানালেন ডিম রুটি দিয়ে বোম্বে টোস্ট করে দিতে পারেন। অর্ডার দিলাম বোম্বে টোস্টের। সাইকেল থেকে নামা লোকটি আমার পরিচয় নিলেন। তাপর তিনি জানালেন তিনি এখানে একজন মোবাল্লেগ এবং তাঁর নাম মদত আলী। তিনি লেখাপড়া করেছেন বাংলাদেশে খুলনায়। কিছুদিন আগে তিনি মোবাল্লেগ হিসেবে ইরানে ট্রেনিংও দিয়ে এসেছেন। তাঁর বয়স চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ হবে মনে হলো। এ দোকানের লোকটিকে তিনি বললেন- ‘ডিমটি না ভেঙে থাকলে তুমি টোস্ট বানাইও না। ভাইকে আমি নিয়ে যাই। উনি আমার বাসার মেহমান হবেন।’আমি এমন অতিথেয়তায় কিছুটা হকচকিয়ে গেলাম এবং জোর করলাম যাতে টোস্ট বানানো হয় এবং মনে মনে চাইলাম যাতে ওনার বাড়িতে আমার মেহমান না হতে হয়।

এর মধ্যে আমরা যেখানে বসেছি তার পাশেই দুটো মুরগি ফৎ করে অনেকখানি পায়খানা করে দিলো। মহিলা এক টুকরা কাগজ দিয়ে সেই পায়খানা পরিষ্কার করতে গেল। সে দৃশ্য দেখে ওখানে বসে কিছু খাওয়া কেমনে সম্ভব হবে তাই নিয়েই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। পরবর্তী ঘটনা আরো করুণ। টোস্ট যখন দিয়ে গেল তখন পাশের জগটা থেকে গ্লাসে একটু পানি দিয়ে অল্প-পানির ঝটকায় হাতটা বেঞ্চির নিচেই একটু ধুতে গিয়ে দেখি আমার পায়ের পাশেই মুরগির দীর্ঘ তরল একখানা পায়খানা। প্রায় বমি এসে যাচ্ছিলো। তারপরও সামলে নিলাম। শুধু সামলেই নিলাম না। ঐখানে বসেই খেতে শুরু করলাম বোম্বে টোস্ট। বিশাল সাইজের দু’টুকরো পাউরুটির মাঝে প্রায় রাজহাঁসের ডিমের সাইজের একখানা হাঁসের ডিমের অমলেট। এতে কেমনে স্যান্ডউইচ না হয়ে বোম্বে টোস্ট হলো তাও পুরো বুঝলাম না। তবে বুঝলাম যে এ টোস্টের অর্ধেকও সাবাড় করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি খাচ্ছি পাশে বসে মদত আলী সাহেব বলে যাচ্ছেন তাঁর পেশাগত কাজ বিষয়ে এবং এতদাঞ্চলের শিয়া মুসলমানদের আমল আখলাক বিষয়ে। ওনার কথাবার্তা থেকেই জানতে পারলাম যে নারিকেলবেড়িয়ায় চার-পাঁচশো ঘর মুসলমানের বাস। তার মধ্যে দশ-বারোখানা ঘর সুন্নী আর বাকী সব শিয়া। মাত্র একটি পাড়া আছে হিন্দুদের। তবে এখানে শিয়াসুন্নী হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে কোনো টানাপোড়েন নেই বলে তিনি গুরুত্বের সাথে জানালেন। তিনি পাশে বসে আর যা-কিছু বলছেন তা সবই বলছেন বর্তমান সময়ের শিয়া-সুন্নীদের আচার-আচরণ বিষয়ে। কিন্তু যে তিতুমীর সম্পর্কে জানার জন্য তাঁর পাশে আমার বসা সে নিয়ে তিনি কিছুই বলছেন না।

তবে তিনি যা যা বললেন তাতে নারিকেলবেড়িয়ার বাঁশের কেল্লা থেকে যে সকল খটকা বুকের মধ্যে নিয়ে আমাকে আসতে হয়েছিল তার অনেকগুলোই এতক্ষণে আমার সমাধান হয়ে গেল। পরে আরো কিছু খোঁজখবর নিয়ে ঐ খটকাগুলোর পরিপূর্ণ যে সমাধান পেলাম তার একটু বিবরণ এখানে দিয়ে ফেলতে পারি। খটকাসমূহের একটি ছিল এই যে, আমি নারিকেলবেড়িয়া বাঁশের কেল্লা নামের যে-স্থানটি দেখতে এসেছি পোস্টারে সে স্থানটিকে নারিকেলবেড়িয়া কারবালা কেন বলা হচ্ছে? কারবালা তো ইরাকের একটি প্রান্তর, নারিকেলবেড়িয়ার এই দেয়াল-ঘেরা চত্বর কীভাবে কারবালা হলো? এই খটকার সমাধান পেলাম এই যে, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার এই ঐতিহাসিক জায়গাটি থেকে বাঁশের কেল্লার স্মৃতি ধীরে ধীরে মুছে যায় কিংবা মুছে দেয়া হয়। এরপর জায়গাটির নতুন পরিচয় তৈরি করা হয় শিয়া ধর্মাচারের জন্য শাবিয়ে কারবালা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ‘নারিকেলবেড়িয়া কারাবালা’কথাটি সংক্ষিপ্ত রূপ। পূর্ণরূপ হলো নারিকেলবেড়িয়ার শাবিয়ে কারবালা। শাবিয়ে কারবালা একটি ফার্সি শব্দ। এর বাংলা অর্থ হলো কারবালার প্রতিকৃতি। শিয়া ধর্মাচার অনুযায়ী মহররমের তাজিয়া এবং অন্যান্য শোক অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে কারবালার অনুরূপ একটি চত্বর তৈরি করা হয় এবং সেখানে একটি ভবনে ইমাম হোসেনের মাজারের অনুকরণে একটি মাজার তৈরি করা হয়। এই চত্বর ও মাজারসহ ভবনকে একত্রে শাবিয়ে কারবালা বা সংক্ষেপে শুধু কারবালা বলা হয়। শিয়াগণ যে বারোজন ইমাম বিশ্বাস করেন সেই বার ইমামের সকলকে নিয়ে এমন চত্বর ও মাজারের প্রতিকৃতি নির্মিত হলে তাকে ইমামবারাহ (উর্দু ‘বারাহ’মানে বারো) বলা হয়। বাংলা ভাষায় একসময় ইমামবারাহকে ইমামবাড়া লেখা হতো। বাড়া শব্দ বাংলায় কোনো অর্থ না দেয়ায় অর্থবোধক করে তুলতে শব্দটি ইমামবাড়িতে রূপান্তরিত হয়। তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার স্থানে ইমামবাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়নি কারণ সেটি বার ইমামের সকলকে নিয়ে নয়। তাই সেটি শুধুই শাবিয়ে কারবালা বা সংক্ষেপে শুধু কারবালা।

যেমনটা আগেই বলেছি, নারিকেলবেড়িয়ার কারবালায় দাঁড়িয়ে আমার অনুভূত খটকাসমূহের আরেকটি ছিল বিসমিল্লাহ-সূচক সংখ্যা ৭৮৬ এর পাশে ৯২ এবং ১১০ লিখিত কেন। মোবাল্লেগ মদত আলী ব্যাপারটি খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করলেন। তিনি বললেন আরবি বর্ণমালার রীতি অনুযায়ী হরফের মান যোগ করে বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম থেকে যেমন ৭৮৬ পাওয়া যায় তেমনি মুহাম্মদ (স.) শব্দের হরফের মান থেকে পাওয়া যায় ৯২ এবং আলী করমুল্লাহ ওয়াজহু থেকে পাওয়া যায় ১১০। মানে হলো বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিমের পরিবর্তে যেমন ৭৮৬ লেখা যায় তেমনি মুহাম্মদের পরিবর্তে লেখা যায় ৯২ এবং আলী করমুল্লাহর পরিবর্তে লেখা যায় ১১০। এই সংখ্যামানগুলো দেখেছিলাম যে পোস্টারটিতে সেই পোস্টারটিই উদ্রেক করেছিল আরেকটি খটকার। সেটি হলো- হযরত ফাতিমা (রা.) এর শাহাদাৎ নিয়ে শোক অনুষ্ঠান কেন? শোক অনুষ্ঠান বা তাজিয়া ইমাম হোসেনের শাহাদাৎ ঘিরে অনুষ্ঠিত হয় এবং হওয়া স্বাভাবিকও কারণ ইয়াজিদের হাতে ইমাম হোসেনের শাহাদাতের ঘটনাটি যে ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক এক ঘটনা তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু হযরত ফাতিমাকে ঘিরে কেন শোক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে আর তাঁর মৃত্যুকে শাহাদাৎই-বা কেন বলা হবে? এই ঘটনার সমাধান মোবল্লেগ মদত আলী সাহেবের কাছ থেকেও সেদিন কিছুটা জেনেছি এবং তিতুমীরের বংশধর জনাব সৈয়দ রেজা আলীর কাছ থেকেও জেনেছি।

এ ঘটনার পূর্ণ ব্যাখ্যার সাথে জড়িয়ে রয়েছে মহানবী (স.) এর ইন্তেকালের পরে ইসলামের ইতিহাসে সংঘটিত কতিপয় ইতিহাস-আচ্ছাদিত রহস্যময় ঘটনা। ঘটনাগুলি সুন্নী মুসলমানদের জানা ও বিশ্বাস থেকে একটু  আলাদা। শিয়াগণ তাঁদের রক্ষিত ঐতিহাসিক রেকর্ডসমূহ এবং তাঁদের অনুসন্ধানলব্ধ ইতিহাস অনুযায়ী বলেন যে, মহানবী (স.) এর মৃত্যুর তারিখ ১২ রবিউল আউয়াল নয় বরং ২৮ সফর। মহানবী (স.) একটি যুদ্ধের প্রস্তুতিস্বরূপ তাঁর মৃত্যুর কিছু দিন পূর্বে ওসামা বিন যায়েদের নেতৃত্বে সকল মুহাজির ও আনসারকে মদিনা ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিলেন। অবশ্য অসুস্থতার কারণে তাঁকে দেখাশোনার জন্য আহলে বাইতের সাহাবীগণের  মদিনায় থাকা দরকার বিধায় আহলে বাইতের সাহাবীগণের ওপর এই আদেশ প্রযোজ্য ছিল না। মহানবীর এই নির্দেশ অনুযায়ী অধিকাংশ সাহাবী মদিনা ছেড়ে গেলেও অসুস্থ মহানবী (স.) যে-কোনো সময় ইন্তেকাল করতে পারেন এই আশঙ্কায় মশহুর সাহাবীগণের অনেকেই বিভিন্ন অযুহাতে মদিনায় রয়ে গেলেন। এমতাবস্থায় ২৮ সফর তারিখ মহানবী (স.) ইন্তেকাল করলেন। ইন্তেকালের পরে হযরত আলী এবং আহলে বাইতের সাহাবীগণ তাঁর দাফন  কাফন ও জানাজা ইত্যাদিতে ব্যাপৃত হন।

তিতুমীরের ৫ম অধস্তন বংশধর মদত আলী ও লেখক অপরদিকে আবুবকর (রা.), ওমর (রা.) ও এই তরিকার প্রবীণ ও প্রসিদ্ধ সাহাবীগণ খলিফা নির্ধারণের তাগিদে গোপনে সাকিফায়ে বানি সায়াদ নামক স্থানে মিলিত হন এবং তাঁরা হযরত আলীকে কোনো কিছু জানতে না দিয়ে আবুবকর ইবনে কোহাফাকে (রা.) খলিফা মনোনীত করেন। উক্ত মনোনয়ন শেষে হযরত উমর (রা.) সহ আরো কয়েকজন হযরত আলীকে (রা.) হযরত আবুবকরের নিকট বায়াত গ্রহণ অর্থাৎ অধীনতা স্বীকারের জন্য আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু মহানবীর বংশধরগণ অর্থাৎ আহলে বাইতের সকলে জানতেন- মহানবীর মৃত্যুর পরে হযরত আলীই যে খলিফা হবেন তা মহানবী (স.) নিজেই ১০ম হিজরিতে হজ্জ পালন শেষে নির্ধারণ করে দিয়ে গিয়েছেন। ১০ম হিজরিতে হজ্জ অনুষ্ঠানের পরে ১৮ জিলহজ্জ তারিখে গাদিরে খোম নামক স্থানে হজ্জ পালনকারী আনসার ও মুহাজিরগণকে একত্র করে মহানবী (স.) সকলের সামনে নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন যে, তাঁর ওফাতের পরে মুসলিম জাহানের খলিফা হবেন ইমাম হাসান ও হোসাইনের পিতা হযরত আলী। সাকিফায়ে বানি সায়াদ নামক স্থানে যাঁরা হযরত আবুবকরকে খলিফা মনোনয়ন করেছেন তাঁরা মহানবীর উক্ত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। ফলে উক্ত মনোনয়ন মানা যায় না বলে মনে করলেন হযরত আলী ও হযরত ফাতিমা উভয়। তাই তাঁরা আবুবকরের অধীনতা স্বীকার বা বাইয়াত গ্রহণ করলেন না। এতে আবুবকরের অনুগামীরা ক্ষিপ্ত হলেন। তাঁরা হযরত আলীর গৃহে আক্রমণ করলেন। গৃহে আলী ছিলেন না, তবে ফাতিমা ছিলেন। ফাতিমা দুয়ারের কপাটের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন এমন অবস্থায় আক্রমণকারীরা আঘাত দিয়ে দুয়ার ভেঙে ফেলে। ভেঙে যাওয়া কপাটের নিচে পড়ে হযরত ফাতিমার পাজরের হাঁড় ভেঙে যায়। এইভাবে আহত অবস্থায় অসুস্থতায় ও ক্ষোভে-দুঃখে রসুলের ইন্তেকালের ১০০ দিন পরে ৩ জমাদিউস সানি হযরত ফাতিমা-তুজ-জোহরা (রা.) এই নিপীড়ন নির্যাতনের যন্ত্রণা সয়ে সয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আবুবকরের অনুসারীদের অত্যাচারে ও নিপীড়নের শিকার হয়ে ফাতিমার এই মৃত্যুকে শিয়াগণ হযরত ফাতিমার শাহাদাৎবরণ হিসেবে জ্ঞান করেন। শাহাদাৎ হিসাবে জ্ঞান করার কারণেই শিয়াগণ ফাতিমার মৃত্যুর এই দিনে শোক অনুষ্ঠান পালন করে থাকে।

মদত সাহেবের তথ্যাদির মাধ্যমে নারিকেলবেড়িয়া কারবালার অভ্যন্তরে আমার তৈরি হওয়া প্রায় সবগুলো খটকা বা প্রশ্নেরই এভাবে সমাধান হয়ে গেল। এর পরও খুচরা ধরনের দু’একটি প্রশ্ন অবশ্য রয়ে গেল। সেইসব খুচরা প্রশ্নের একটি ছিল- কারবালার অভ্যন্তরের সাইনবোর্ড, ব্যানার ইত্যাদিতে হযরত আলী কিংবা ইমাম হোসেন প্রমুখের নামের পরে (আঃ) এবং হযরত ফাতিমার নামের পরে (সাঃ আঃ) কেন লিখিত রয়েছে। ‘(আঃ)’ দিয়ে তো ‘আলাইহিস সালাম’বোঝানোর কথা, আর ‘(সাঃ আঃ)’ দিয়ে তো ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম’ বোঝানোর কথা। সুন্নী বিধান অনুযায়ী ‘আলাইহিস সালাম’ব্যবহৃত হবে নবীদের নামের পরে দরুদ হিসেবে এবং ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম’ব্যবহৃত হবে মহানবী মুহাম্মাদ-এর নামের পরে দরুদ হিসেবে। সুতরাং  ‘(আঃ)’ কেন হযরত আলী কিংবা ইমাম হোসেন প্রমুখের নামের পরে ব্যবহৃত হলো, এবং (সাঃ আঃ) ই-বা কেন হযরত ফাতিমার নামের পরে ব্যবহৃত হলো? এ প্রশ্নের সামাধানও মদত সাহেবের কাছে থেকে পাওয়া গেল। (আঃ) দ্বারা আমরা সুন্নীরা ‘আলাইহিস সালাম’বুঝাই এবং এই কথা আমরা নবীদের নামের পরে দরুদরূপে আমরা ব্যবহার করি। কিন্তু শিয়াগণ রসুলের বংশধর অর্থাৎ আহলে বাইতের সকল পুরুষের জন্য ‘আলাইহিস সালাম’এবং মহিলাদের জন্য ‘সালামুল্লাহে আলাইহা’দরুদ ব্যবহার করেন। তাদের দরুদ এমন হওয়ার পিছনে তারা কোরআনের একটি আয়াতকে দলিল হিসেবেও ব্যবহার করেন। এই প্রেক্ষিতেই তারা আহলে বাইতের পুরুষগণের নামের সামনে লেখেন (আঃ) যার পূর্ণরূপ তাদের কাছেও আলাইহিস সালাম। আর মহিলাদের নামের সামনে লেখেন (সাঃ আঃ) যার পূর্ণরূপ সালামুল্লাহি আলাইহা, ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম’নয়।

মদত সাহেবের কাছে এই সব বিষয়াদি শোনা শুরু হয়েছিল গ্রাম্য একটি রেস্টুরেন্টে বসে- এ কথা আগেই বলেছি। রেস্টুরেন্ট থেকে ওঠার পরেও একই ধারাবাহিকতায় কথা চলতে থাকলো। রেস্টুরেন্ট থেকে উঠে আসার পর মদত সাহেবের অকৃত্রিম আতিথেয়তা আমাকে পূর্ণ মহব্বতের দাবিতে কবুল করতে হয়েছিল। রেস্টুরেন্ট থেকে উঠে আসার সময় অনুভব করলাম এ মহব্বত এখানে সকলের মাঝেই বিস্তর। রেস্টুরেন্টের মালিক মহিলা খুব আন্তরিকতার সাথে বললেন- ‘আমাদের এখানে আসবেন আশুরার সময়, তাজিয়ার সময়। অনেক মজা পাবেন। ঐ সময় বাংলাদেশ থেকে অনেক মানুষ আসে।’ মহিলার আন্তরিক এই আমন্ত্রণ এবং মদত সাহেবের তাৎক্ষণিকভাবে বাড়িতে দাওয়াত কবুল করানোর ঘটনায় আমার বারবার মনে পড়ছিল তপন রায়চৌধুরীর ‘ ‘বাঙালনামা’য় বিধৃত মহব্বতের প্রমাণ-সূচক ঘটনা।

‘বাঙালনামা’র লেখক তপন রায়চৌধুরী তাঁর এই গ্রন্থে প্রসঙ্গক্রমে দেখাতে প্রয়াস পান প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মাঝে অর্থাৎ এশিয় ও ইউরোপিয়দের মাঝে মৌলিক পার্থক্য কী। সেই পার্থক্যের মূল পরিচয়টুকু অবশ্য তিনি দিয়েছেন এক হিন্দুস্তানি মুসলমান মৌলবির চার শব্দের একটি বাক্য দিয়ে। ইংল্যান্ডে একদিন সন্ধ্যায় এক ট্রেনের সহযাত্রী এই মুসলমান মৌলবির কাছে জনাব রায়চৌধুরী জানতে চেয়েছিলেন ইংল্যান্ডে ওঁর কেমন লাগছে। তপন রায়চৌধুরী লিখেছেন- ‘এই প্রশ্নের উত্তরে চারটি শব্দে বিলাতি সভ্যতার উনি যে-মূল্যায়ন করলেন, তার চেয়ে সুষ্ঠু বর্ণনা এবং আমাদের সঙ্গে এদের মূলগত তফাত কোথায় তার নির্দেশ, আমি আর কোথাও পাইনি। ওঁর বক্তব্য- এদের ‘ইনসানিয়াত জেয়াদা, মুহাব্বত কম।’ এই বক্তব্যের আলোকে তপন রায়চৌধুরী এরপর যে-সকল ঘটনার বর্ণনা দেন তাতে দেখি ইউরোপ প্রবাসে জীবনের অর্ধভাগ কাটিয়ে ঘনিষ্ঠভাবে মেশা মানুষগুলোর সাথে যে মহব্বত জনাব রায়চৌধুরী পাননি মাত্র কয়েক মিনিটের পরিচয়ে তাঁর সাথে মানুষের সেই মহব্বত গড়ে উঠছে এশিয়ায়। ইউরোপে বছরের পর বছরে কারো সাথে তাঁর সেই মহব্বত গড়ে উঠতে দেখি না, যা ইস্তাম্বুলে পৌঁছে অর্থাৎ এশিয়ায় পৌঁছে গড়ে উঠেছে একেবারে বাসস্টপে দাঁড়ানো পাশের যাত্রীটির সাথে মাত্র এক মিনিটে। (চলবে)

তিতুমীরের জন্মভিটায় প্রতি মঙ্গলবার প্রকাশিত হবে

আরো পড়তে ক্লিক করুন-

তিতুমীরের জন্মভিটায় || পর্ব-৩

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
টেকনাফে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
টেকনাফে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
ঝড়ে গাছ ভেঙে পড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বন্ধ ছিল এক ঘণ্টা
ঝড়ে গাছ ভেঙে পড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বন্ধ ছিল এক ঘণ্টা
‘স্বাভাবিক পরিবেশে বাঁচতে প্রত্যেককে গাছ রোপণ করতে হবে’
‘স্বাভাবিক পরিবেশে বাঁচতে প্রত্যেককে গাছ রোপণ করতে হবে’
ভিটামিন ডি কমে গেলে কীভাবে বুঝবেন?
ভিটামিন ডি কমে গেলে কীভাবে বুঝবেন?
সর্বাধিক পঠিত
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব যার হাতে গেলো
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব যার হাতে গেলো
চাসিভ ইয়ার ঘিরে হাজার হাজার সেনা জড়ো করছে রাশিয়া
চাসিভ ইয়ার ঘিরে হাজার হাজার সেনা জড়ো করছে রাশিয়া
যেভাবে অপহরণকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে এলো স্কুলছাত্র
যেভাবে অপহরণকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে এলো স্কুলছাত্র
যে শিশুকে পাচারের অভিযোগে মিল্টনের বিরুদ্ধে মামলা
যে শিশুকে পাচারের অভিযোগে মিল্টনের বিরুদ্ধে মামলা
আজও ঝোড়ো হাওয়াসহ শিলাবৃষ্টির আভাস
আজও ঝোড়ো হাওয়াসহ শিলাবৃষ্টির আভাস