X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

অঙ্গীকার

ছন্দসী বন্দ্যোপাধ্যায়
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৩:৫১আপডেট : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৪:২৮

১.
আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় উঠে বসল মৈনাক। একটু আগেই খামে বন্ধ চিঠিটা নিয়ে লাফাতে লাফাতে ঘরে এসে সুলগ্না বলেছিল, “তোর নামে একটা চিঠি আছে। বিশ্বস্ত চিঠি।”

— কার চিঠি?
— জানি না। বোধ হয় তোর দপ্তর থেকে কোনো কনফিডেনশিয়াল চিঠি। খুলেই দ্যাখ্‌ না।

ভ্রু কুঁচকে, খামটা খুলল মৈনাক। সরকারি চিঠিই বটে। যে বিখ্যাত সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানে একজন সাংবাদিকের পদে নিযুক্ত মৈনাক, সেই ‘প্রতিদিনের সংবাদ’-এর চিফ সম্পাদক প্রণব চট্টোপাধ্যায়ের চিঠি। তাঁর আদেশ এই বছরের আসন্ন রাম-সীতার বিবাহ-পঞ্চমী উৎসবটিকে যেন মৈনাক কভার করে। ঘটনাটি ঘটবে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসের সন্ধিক্ষণে। স্থান, নেপাল তরাইয়ের জনকপুরধাম।

সুযোগটা অতি আকস্মিকভাবেই এসে পড়ল। বহুকাল ধরে যে স্বপ্নটাকে মৈনাক মনের মধ্যে লালন-পালন করে আসছে, অথচ নিত্যদিনের ব্যস্ততার মধ্যে, সহস্র দায়িত্বের সঙ্গে নিরন্তর জুঝতে জুঝতে একটু একটু করে যে স্বপ্ন এখন তার প্রায়োরিটি তালিকায় সবচেয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে, সহসা কোন যাদুকাঠির ছোঁয়ায় সেই স্বপ্নকেই চরিতার্থ করার একখানা সুবর্ণ সুযোগ হাতে এসে গেল।
একলাফে বিছানা থেকে নেমে ঘরের বাইরে এসে সে হাঁকল, “সুলগ্না, সুলগ্না।”

হাতের কাজ ফেলে সুলগ্না ছুটে এসে স্বামীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পরম উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, “কী ব্যাপার? অত উল্লাস কীসের? প্রণবদা কি তোকে প্রমোশনের খবরটা চিঠি লিখে জানিয়েছেন?”

একটু থমকালো মৈনাক। তারপরই ছুটে এসে সুলগ্নাকে দুহাতে জাপটে ধরে বলল, “আরে, প্রমোশনের চেয়েও বড় খবর। তোর আমার দু’জনেরই স্বপ্নাতীত।”

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে রইল সুলগ্না। মৈনাক আবার বলল, “প্রণবদা লিখেছেন আমাকে এবছর জনকপুরধামে বিবাহ-পঞ্চমী উৎসবটা কভার করতে পাঠাচ্ছে প্রতিদিনের সংবাদ।”

— ও মা! সে কী? এবার সুলগ্নার কণ্ঠেও আনন্দের উচ্ছ্বাস, “সত্যিই তো ফাটাফাটি একখানা খবর। এত বচ্ছর পর আবার নেপাল যাবি। সেখানে যাওয়া মানেই তো তোর অসীম আর অলোকের সঙ্গে দেখা হবে এক যুগ পর। হাউ এক্সাইটিং!” একটু থেমে সুলগ্না আবার প্রশ্ন করল, “কবে যাওয়া হবে?”

— সীতার স্বয়ম্বর এবং বিবাহ পড়ছে আটাশে নভেম্বর। তার দুই দিন আগে, মানে ছাব্বিশে নভেম্বরে পৌঁছতে হবে। তবে প্রস্তুতি এখন থেকে আরম্ভ করা দরকার। রিসার্চ করতে হবে জনকপুরধাম অঞ্চল সম্বন্ধে। কত কত বছর পর আবার যাচ্ছি, একটু হোমওয়ার্ক করে নিতেই হবে যে।

২.
অবশেষে দিনটা এসেই গেল। সুলগ্নার কাছ থেকে বিদায় এবং যাত্রা শুভ হোক শুভকামনা নিয়ে এবং পরিবর্তে সেও সাবধানে থাকবে, বৌকে প্রতিরাতে একবার ফোন করবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে এয়ারপোর্ট উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল মৈনাক।

মাত্র কয়েকঘন্টার মধ্যে কাঠমান্ডু হয়ে, স্পাইস্জেট তাকে নামিয়ে দিল জনকপুর এয়ারপোর্ট। বাইরে বেরিয়ে এসে উন্মুক্ত নীল আকাশের দিকে চেয়ে পরম স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস নিল মৈনাক। নভেম্বর মাসের সূর্য-প্রায়-গড়িয়ে-আসা একটি-বিকেল। আবহাওয়া স্নিগ্ধ। চমৎকার ফুরফুরে হাওয়ার নরম স্পর্শ এসে লাগল মৈনাকের মুখে, চুলে। সারাদেহে বহন করে আনল ভালো লাগার প্লাবন। মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠল ওর।

হোটেলে চেক ইন করার পর সে বেরিয়ে পড়ল নগর পর্যটনে। তিরিশ বছর আগে মৈনাকের জন্ম হয়েছিল তার মামাবাড়ি নেপাল তরাইয়ের একরাহী গ্রামে। তারপর শৈশব আর কৈশোরে কয়েকবার এসেছিল মামাবাড়ি বেড়াতে। সেই সময়েই জনকপুরে মা আর মামীমাদের সঙ্গে বাজারের সঙ্গী হয়ে আসতে হতো। মায়েদের তখন আকর্ষণ ছিল জনকপুরের চীন থেকে ইম্পোর্টেট সিল্কের শাড়ি, পশ্মিনার শাল এবং সাজগোজের জিনিসপত্র কেনা।

ভিড়ের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে মৈনাক ভাবছিল এই জনকপুর থেকে দক্ষিণপূর্ব দিশায় এগিয়ে গিয়ে ষোল-সতেরো কিলোমিটারের মধ্যে এসে পড়ে নেপাল তরাইয়ের সীমান্ত। সন্ধিস্থলের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা ভারতীয় ছোট্ট শহরটির নাম জয়নগর। আর জয়নগর এবং জনকপুর ধামের মাঝের প্রায় ছত্রিশ কিলোমিটার জমিটুকুতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কয়েকটি গ্রাম— দেওধা, ঝিঝা, মহুয়া, খজুরী, একরাহী, সিরহা।

কীভাবে মৈনাকের মায়ের পূর্বপুরুষ এই অঞ্চলে এসে পড়ে পাকাপাকিভাবে খুঁটি গেড়েছিলেন প্রায় সাড়ে তিনশত বছর আগে, সেই সম্বন্ধেও একটি রোমাঞ্চকর কাহিনি চালু আছে এই অঞ্চলে।

বলা হয় সাড়ে তিনশত বছর পূর্বে এই তরাই অঞ্চলের মানুষজন একবার দীর্ঘকালব্যাপী অনাবৃষ্টি আর ঘোর দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তখন রাজশাহী জেলার বাসিন্দা মৈত্র পরিবারের এক ছেলে নেপাল মহারাজাধিরাজের আমন্ত্রণে পা রাখেন এই তরাই এলাকায়। সেই ছেলে, যাঁর নাম ছিল কালীচরণ মৈত্র, তখন রাজশাহীর এক বিখ্যাত তান্ত্রিক ছিলেন। রাজার অনুরোধে, সম্পূর্ণ নিষ্ঠা সহ দীর্ঘ পাঁচদিন ব্যাপী এক যজ্ঞ করেছিলেন তিনি সেই শুষ্ক, তৃষ্ণার্ত জমির ওপর। বরুণদেব, ইন্দ্রদেব, শিবশংকর ভোলেনাথ প্রভাবিত হয়েছিলেন বৈকি কালীচরণের নিষ্ঠায়। অনাবৃষ্টি কেটে গিয়েছিল অতঃপর। পুনরায় শস্য-শ্যামলা হয়ে উঠেছিল তরাইয়ের ধরিত্রী। প্রসন্ন হয়ে নেপালের রাজা তাঁকে বারোটি গ্রামের জমিদারি (স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে বিরতা) প্রদান করেছিলেন। একরাহী গ্রামের মালিকানাও ছিল সেই দানের অন্তর্গত।

ওই জমিদারি এবং প্রভূত সম্পদের মোহ কাটিয়ে কালীচরণ মৈত্রের আর রাজশাহী ফিরে যাওয়া হয়নি। একটা যুগ কেটে গিয়েছে তারপর। নানা পরিবর্তনের সামনাসামনি হতে হয়েছে একরাহীর মৈত্র পরিবারকে।

বর্তমানে একরাহীর সেই মস্ত প্রাসাদোপম প্রাচীন ম্যানশনে থাকেন মৈনাকের বড়ো মামা, মামীমা আর বড়ো মামার ঠাকুমা যিনি কত্তামা নামেই পরিচিত। বয়সে মৈনাকের কাছাকাছি, বড়ো মামাদের দুটি টগবগে ছেলে, অসীম আর অলোক, কর্মসূত্রে কাঠমান্ডুবাসী।

৩.
আর খানিক পরে অসীম-অলোকের জনকপুরে চলে আসার কথা। কোলকাতায় থাকতেই মৈনাকের সঙ্গে ওদের কথা হয়ে গিয়েছিল। ঠিক হয়েছিল, ওরাও মৈনাকের গাইড হয়ে তরাই অঞ্চলে ওর সঙ্গেই ঘুরবে।

শহর ভ্রমণ করতে করতে মৈনাক ঝালিয়ে নিল জনকপুর সম্বন্ধে ওর সংগ্রহ করা কতকগুলো তথ্য। খানিক ইতিহাস-সম্মত বাস্তবমুখী আবার খানিক যুগ-যুগান্তর থেকে বহন করা কিংবদন্তি-মিশ্রিত এই শহরের ইতিকথা।

নেপাল এবং ভারতবর্ষের অধিকাংশ হিন্দুরা বিশ্বাস করেন যে মিথিলার রাজধানী জনকপুরধাম-নরেশ জনকের রাজধানী এবং সীতার জন্মভূমি। এখানেই নাকি লাঙল দিয়ে চাষ করতে গিয়ে জনকরাজা সীতাকে মাটির তলা থেকে কুড়িয়ে পান। জনকপুরধামেই শৈশব ও কৈশোর কাটিয়ে একদিন যৌবনের চৌকাঠে পা রাখেন সীতা। অতঃপর এই জনকপুরধামেই অনুষ্ঠিত হয় সীতার স্বয়ম্বর এবং রামের সঙ্গে বিবাহ।

সেই বিশ্বাসের ভিত্তিতেই আজও জনকপুরধামে প্রতিবছর মার্গ-শীর্ষ শুক্লা পঞ্চমীর দিনে (নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে) রাম-সীতার বিবাহ দেওয়া হয়, এখানকার পরম বিখ্যাত নৌলখিয়া জানকী মন্দিরের বিশাল চত্বরে।

আর মাত্র দুদিন পরেই আসন্ন স্বয়ম্বর এবং বিবাহোৎসব। সেই উপলক্ষে জনকপুরধামে হাজার-হাজার তীর্থযাত্রীর সমাগম। নানা রঙের চোখ-ধাঁধানো আলোর মালায় জ্বলজ্বল করছে নৌলখিয়া জানকী মন্দির।

অনুষ্ঠানের জন্য সজ্জিত মস্ত চত্বরটা ঘুরেফিরে, টহল দিয়ে অবশেষে হোটেল ফোয়ারে ফিরেই অসীমের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে গেল মৈনাকের।

— এ্যাই, তুই যে একা? অলোকবাবু এলো না?— মৈনাক প্রশ্ন করল।
— নাহ্। শেষ মুহূর্তে কাজে আটকা পড়ল কাঠমান্ডুতে। তবে আশা করছে কাজ সেরে চলে আসবে কয়েক দিনের মধ্যে।

অতঃপর রাম আর সীতার বিবাহোৎসবের সমস্ত খুঁটিনাটি কভার করতে চার দিন কেটে গেল।

চতুর্দিকে হাজার হাজার ভক্ত, তীর্থযাত্রীদের অদম্য আনন্দোচ্ছ্বাস, হাইজিনের অভাব, শব্দদূষিত আবহাওয়া পরিস্থিতির নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কাজটা খুব ভালোভাবেই সেরে ফেলল মৈনাক।

তারপর পরিকল্পনা মত অসীম এবং মৈনাক জনকপুরধাম থেকে বেরিয়ে, একটা ট্যাক্সি নিয়ে রওনা দিল মৈনাকের মামাবাড়ির বাসস্থান একরাহীর দিকে। একরাহীর সেই প্রাসাদোপম, অতি পুরাতন কিন্তু সযত্ন সুরক্ষিত মৈত্র বাড়িতে পৌঁছতে ওদের খুব দেরি হল না।

গাড়ি থেকে নামতে নামতে অসীম, বলল, “দেখ ভাই, নেপালের বড় বড় শহরে যে সব চেইঞ্জ এসেছে, মানুষজনের জীবন এবং চিন্তাধারার মোড় যেমন বদলেছে, এই অঞ্চলের গ্রামে কিন্তু সেরকম বদলের কোনো লক্ষণ হয়ত দেখতে পাবি না। এখানে জনসাধারণের ভাবনা-চিন্তা, রহন-সহন, খানাপিনা, লাইফ স্টাইল সবই তুই যে-রকম দেখে গিয়েছিলি প্রায় সেরকমই আছে। হেরফের বিশেষ হয়নি”।

ততক্ষণে মাঝবয়সী, ফতুয়া-ধুতি-পরিহিত একটি লোক আর বারো-তেরো বছরের একটা হাফপ্যান্ট আর টি-শার্ট পরা ছেলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে ট্যাক্সি থেকে ওদের মালপত্র নামিয়ে ঘাসের ওপর রাখতে আরম্ভ করল। তারপর মাথা হেঁট করে, দুই হাত জোড় করে এক সঙ্গে বলে উঠল— “প্রণাম, মালিক।”

অসীম হেসে বলল, “খুশ রহো”। তারপর মৈনাককে দেখিয়ে বলল, “ইয়ে ছোটি বুয়া কা ছোরা হ্যয় রে, তেত্রা।”

তেত্রা, অর্থাৎ সেই বয়স্ক লোকটি সকৌতুকে, হাসিমুখে মাথা নেড়ে বলল, “আরে বাপ! ইত্না লম্বা হো গয়া ছোরা! ননহা সা থা বিল্কুল যব আখিরি ওয়াক্ত দেখা থা।”

ছোট ছেলেটার বেশ নির্ভীক-নির্ভীক, মাস্তান-মাস্তান ভাব। গুরু গম্ভীর মুখে বলল, “জি, হমার নাম সুলেমান হ্যয়। তেত্রা মিস্তিরি কো নাতি ছি।”

— তেত্রা মিস্তিরিকে তোর মনে আছে? সেই কত বছর আগে, দাদু যখন জয়নগর-জনকপুর নেপাল রেলওয়েজের ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন সেইসব দিনে ট্রলিম্যানের কাজ করত। এখন অবশ্য রিটায়ার্ড। অসীম বলল, “এখন ও আমাদের বাগানে কাজ করে।”
— “আছেই তো। তেত্রাকে খুব মনে আছে আমার”— উৎফুল্ল হয়ে বলল মৈনাক।

ওর মনে হল যেন অনন্ত সময়ের দীর্ঘপথে এগিয়ে যেতে যেতে এক লহমা থমকে গিয়ে অনেকখানি পিছিয়ে চলে এসেছে সে। একরাহী অঞ্চলে বাল্যকালে কাটানো অতীতের অনেক সুপ্ত স্মৃতি অকস্মাৎ যেন ঘুম ভেঙ্গে আড়মোড়া দিয়ে উঠে বসল মনের মধ্যে।

বাইরের মস্ত বাগান পেরিয়ে ওরা বারান্দায় উঠে এসে দেখল কত্তামা, অর্থাৎ অসীমের বাবা আর মৈনাকের মায়ের ঠাকুমা, দিব্যি টানটান হয়ে একটা ইজিচেয়ারে বসে গুনগুন করে গান করছেন। ওঁকে প্রণাম করল দুই ভাই। কত্তামা মুখ তুলে চাইলেন। হাসিমুখেই চাইলেন অবশ্য, কিন্তু চিনতে পারলেন কি!

বেলা প্রায় বারোটা তখন। অঘ্রান মাসের বিকেলটাকে শীঘ্রই ঢেকে ফেলবে সাঁঝের আঁধার। মৈনাকের মনে হল অন্ধকার নামার আগে, বাড়িটার চারিদিক ঘেরা অতি প্রশস্ত, মনোরম বাগান আর বাড়ির পিছনের মাঝারি সাইজের পুকুরটা একবার দেখে আসতে হবে।

অসীম ততক্ষণে স্নান করতে ঢ়ুকে পড়েছে। অগত্যা একাই বাগানটা ঘুরে ঘুরে দেখল মৈনাক। বাল্যকালে, কৈশোরে যে ক’বার এসেছিল, বাগানটা ঠিক সেই রকমই আছে। পরিবর্তন তেমন কিছু নজরে পড়ল না। শুধু বেশ কিছু মরশুমি গাছ, মস্ত এক স্বর্ণচাঁপা আর বিশাল একটা স্থলপদ্ম গাছ—‘নতুন’-এর হাত ধরে ঢুকে পড়ে নিজের নিজের জায়গা দখল করে নিয়ে দিব্যি বেড়ে উঠছে, এই যা।

ওর নিজের দিদার অদম্য শখ ছিল বাগান করার। ছুটি-ছাঁটাই মৈনাক যতবার এখানে এসেছে, দেখেছে ধবধবে সাদা একটা ওড়নায় মাথা ঢেকে, মালীকে নিয়ে বাগানের কাজে লেগে আছেন তিনি। মনের চোখে সেই দৃশ্য ভেসে আসতেই যেন আবার জোর হোঁচট খেল মৈনাক। ওর মনে পড়ল, সেই সব দিনে একরাহীর এই বাড়িতে দিন আর রাত্রির আসা-যাওয়া চলত অন্য নিয়মে।

খানিক পরে, চৌবাচ্চার জলে স্নান করে, খেতে বসে মৈনাক খেয়াল করল সকলের সাথে একসঙ্গে টেবিল-চেয়ারে বসে খেতে বসার প্রথাটিও নতুন চালু হয়েছে এই বাড়িতে। অসীম বলেছিল, এই গ্রামে কয়েকটি সচ্ছল বাড়িতে বিদ্যুতের আলো বসানো হয়েছে। কিন্তু বড়মামা এই আধুনিক বিদ্যুৎ সঞ্চার ব্যবস্থার ঘোর বিরোধী। অতএব রাত্রিতে এই বাড়িতে লণ্ঠন আর কেরোসিন টেবিল ল্যাম্পই ভরসা।

খাবার টেবিলে রাখা মস্ত কেরোসিন ল্যাম্প থেকে থিরথির করে কাঁপতে থাকা আলোর শিখাকে বারংবার ছুঁয়ে দিয়ে বাতাস বুনে চলেছে আবছা আলো-ছায়ার জাল।

বড়মামা, মামীমা, অসীমের সঙ্গে খেতে বসে সহসা মৈনাকের খেয়াল হল কত্তামা ওখানে নেই। সে আশ্চর্য হয়ে বড়মামীর দিকে তাকাতে তিনি সম্ভবত ওর মনের কথা আঁচ করতে পেরে বললেন, “তোমাদের কত্তামা’র দিন আর রাত চলে সময়ের উল্টো চাকায়।”

— কত্তামা এখনও সময়ের সঙ্গে তার লাইফ স্টাইল বদলাতে পারেনি। মানে সেই আগের মতনই চালিয়ে যাচ্ছে আর কী”। অসীম যোগ দিল।

বড়মামা এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন। খাওয়া থামিয়ে হঠাৎ বললেন, “তাতে আমাদের কোনো অসুবিধে হচ্ছে কি? তোমাদের কত্তামা এ জীবনে অনেক কিছু হারিয়েছে— স্বামী, দুই ছেলে, এক মেয়ে— সেই সব শোক ভুলে গিয়ে এখন যদি নিজের তৈরি সেই পুরোনো সময়ের গণ্ডির মধ্যে আনন্দে বাস করতে পারে, তাতে কার কী ক্ষতি?”

সত্যিই তো! বড়ো মামার প্রশ্নের উত্তর কারো মুখেই জোগাল না।

রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কত্তামার কথা ভাবছিল মৈনাক। মাঝে বহু বছর কেটে গেলেও কত্তা মা’র স্মৃতি ধূসর হয়নি আজও। সেই সময়ে ডাকসাইটে সুন্দরী ছিল কত্তামা। সদা হাস্যময়ী, সুরসিকা এবং অতিশয় কর্মঠ। তার স্বামী চলে গিয়েছেন, সেও বহু বছর। কত্তামার বয়স এখন কত কে জানে! তাও, অসীম বলল, বয়সের তোয়াক্কা কত্তামা করে না। চোরেদের সঙ্গে এখনও নাকি মহড়া দিতে পারে।

৪.
সন্ধ্যা নামতেই শেয়ালের ডাকের সঙ্গে সুর মিলিয়েছিল একদল ঝিঁঝিঁ পোকা। আশ্চর্য সেই সুর-সঙ্গীত শুনতে শুনতে এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল মৈনাক। মধ্যরাতে সহসা ঘুম ভেঙ্গে গেল। মনে হল সদর দরজা থেকে কে যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল সে এবং পরক্ষণেই পায়ে চটি লাগিয়ে, খুব সন্তর্পণে দরজা খুলে বাইরের লম্বা বারান্দাটায় এসে দাঁড়াল। যা দেখল তা যেমন চমকপ্রদ, তেমনি অপ্রত্যাশিত।

মৈনাক কি স্বপ্নেও কোনোদিন ভেবেছিল যে রাত দুটোর সময়ে দুধের ঘটি হাতে কত্তামা বারান্দায় দাঁড়িয়ে গোয়ালার সাথে গাল-গল্প করতে পারেন! গোয়ালা মৈনাককে দেখে দুই হাত তুলে বলল, “প্রণাম মালিক”।

এবার চমকে উঠে পিছন ফিরে কত্তামা মৈনাককে দেখে শংকিত হয়ে বললেন, “কে? তুম কৌন হো?”
মৈনাক অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “কত্তামা আমি মৈনাক। অসীমের সাথে এখানে বেড়াতে এসেছি।”
— মৈনাক! মৈনাক! বিড়বিড় করে বললেন কত্তামা। এক মিনিট যেন হাতড়ালেন সুপ্ত স্মৃতিকে। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন, “অ! আমি ভাবতাছিলাম, কৌন না কৌন!”

দীর্ঘকাল একরাহী-বাসের ফলে তাঁর শৈশবে রাজশাহীতে শেখা ভাষার অনেকখানি রূপান্তর ঘটেছে, বোঝাই গেল।
লম্বা বারান্দার আর এক প্রান্তে রান্নাঘর। গোয়ালা চলে গেলে সেদিকে গুটি গুটি এগিয়ে যেতে যেতে সহসা থমকে দাঁড়িয়ে কত্তামা বললেন, “কী হইল কী? চইল্যা আয়।”
ওঁর কাছাকাছি এসে মৈনাক বলল, “আপনি ঘুমাবেন না?”
— সে কী! এই আধা রাতে ঘুমায় না কি কেহ?” আশ্চর্য হয়ে বললেন কত্তামা, তারপর কী মনে হতে চাপা গলায় খিলখিলিয়ে হেসে উঠলেন এবং পরক্ষণেই হাসি থামিয়ে বললেন, “জানিস, আজকাল এ বাড়ির কেহই মানতে চায় না যে এই সময়টাই আসলে ঝিঝার দস্যুগুলির লুটমার করনের সব চাইতে ঠিকঠাক সময়। তাই একটু আঁধার নাইম্যা আইসতে উহারা খাইয়্য-দাইয়্য শুইয়্যা পড়ে। আমিই শুধু একা-একা এই বাসার পাহারাদার হইয়া জাইগা থাকি। এই সময়টা গয়লা দুধ দিয়া যায় রোজ। আর নিত্যিদিনের নিরিমিষ্যি রান্নাবান্নাটা এই সময়ে আমিই সাইরা রাখি। পালা-পার্বনে পায়স করি, পিঠা-পুলি করি, নানাবিধ আচার বানাইয়্যা রাখি। আবার বাগানে গিয়া গাছপালাদের তদারকিও করি।”

— আর ভোরবেলা? কখন ওঠো বিছানা থেকে?— মৈনাকের প্রশ্ন।
— ভোরে? দিনের আলো যখন ফোটে, চান কইরা, বাগান হইতে ফুল তুইল্যা ঠাকুরঘরে যাই। ইষ্ট দেবতারে প্রণাম কইরা, নাইয়্যা, খাইয়্যা-দায়িয়্যা তারপর ঘুমাইয়্যা পড়ি। ঘুম যখন ভাঙে সন্ধ্যা ততক্ষণে ঘনাইয়্যা আসে বাগানে।

রান্নাঘরের একটা জানালার নিচে মেঝের ওপর পিঁড়ি টেনে নিয়ে আয়েশ করে বসে মৈনাক সকৌতুকে বলল, “তার মানে এই দাঁড়ায় যে তুমি বাইরে কোথাও বেড়াতে যাও না। খালি বাড়ি পাহারা দাও, বাগান করো আর ঘুমাও। তাই তো?”

আঁচ দেওয়া তোলা উনুন ততক্ষণে দিব্যি জ্বলে উঠেছে। ধীরে-সুস্থে কড়ায় সর্ষের তেল দিলেন কত্তামা তারপর তেলটা তেতে উঠতেই কাটা পাঁচমিশালি তরকারির টুকরোগুলো কড়ায় ফেলে দিয়ে, খুন্তি দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন, “নাহ। আর কোথাও যাওয়া-আসা করি না। শ্বশুরের ভিটা পাহারায় নিযুক্ত থাইক্যাই কাইট্যা যায় আমার সময়”।

—কেন? জনকপুরেও যাও না?” আশ্চর্য হয়ে বলল মৈনাক।
— আরে রামো-রামো! জনকপুর! ওই ভিড়-ভাট্টায় যায় নাকি কেউ?
—অবশ্যই যায়, কত্তামা। এই তো অসীম আর আমিই রাম-সীতার বিয়ে দেখে এলাম।
— তা বেশ করছস। রাম-সীতার বিয়া—সে যে এলাহি ব্যাপার।
—তাহলে তুমি যাও না কেন? কোনোদিন না হয় দুপুরবেলাতেই একবার ঘুরে এলে...

ফোক্লা মুখখানা হাসিতে ভরে গেল কত্তামার। বললেন, “আরে সে কি আমি কখনও যাই নাই, মনে করস? কত্তা যখন বাঁচি ছিল, অনেকবার গেসি”।
মৈনাক লক্ষ করল, কত্তামা লণ্ঠনের আলোয় চশমাহীন চোখেই, প্রথমে একথাল চাল আর তারপর একথাল ডাল বাছলেন। বিস্মিত হয়ে সে জিজ্ঞেস করল, “তোমার চশমা লাগে না, কত্তামা?”
— না। লাগেই না তো! তুই কি আমারে বুড়া ভাবছস?” এক মিনিট নীরবতার পর ফোকলা মুখ আবার সেই ভুবনমোহিনী হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। কত্তামা বললেন, “দ্যাখ্ ছোঁড়া, বয়সখানা মাইনসের মনের কারসাজি। যদি মনে করস তর বয়স আশি, তাইলে আশি; আর যদি ভাবস তর বয়স কুড়ি, তাইলে কিন্তু তুই কুড়িতেই থাইম্যা থাকলি। চিরতরে। অন্যথা হইব না।“
— তাই বুঝি?” সকৌতুকে মৈনাক উত্তর দিল, “তা তোমার মুখের হাসিটা তো এখনও কুড়ি বছরের মেয়ের মতনই আছে। বয়স কত তোমার?”

এবার গম্ভীর হয়ে কত্তামা বললেন, “জানি না। বাপে গৌরীদান করসিল সেই কবে। পালকি চেপে শ্বশুরের ভিটায় আসছিলাম। তখন বয়স ছিল আট বচ্ছর— তারপর কত্তগুলা বচ্ছর কাটাইয়্যা দিলাম। অহন বয়স কত ভুইল্যা গেছি গিয়্যা। নব্বুই-পচানব্বুই তো হইবই। একশতও হইতে পারে।”

একশতও হতে পারে! বুড়ি বলে কী! একশ বছর বয়সে, এই রাত দুপুরে উনুন ধরিয়ে, নিজে হাতে সব জোগাড় করে, বাটনা বেটে, রান্না করছেন কত্তামা! আবার পূজা-পার্বণে পুলি, পীঠে, পায়েসও করেন। আচার-মোরব্বা-কাসুন্দিও বাদ যায় না।
এতসবের পর আবার ভোরবেলা কুয়ো থেকে টেনে আনা জলে স্নান করবেন! কয়েক সেকেন্ড মুখ থেকে কথা সরল না মৈনাকের।
সে হেসে বলল, “নেভার মাইন্ড, কত্তামা, তোমার বয়স আসলেই কুড়ি। কাজে-কম্মে, শরীরে-মনে তুমি চিরটা কাল কুড়ি বছরেই থেমে থাকবে। দেখে নিও।“

কত্তামার খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে, রান্নাঘর পরিষ্কার করে, হেঁসেলে তালা দিয়ে তিনি বললেন, “যাও বাছা, তুমিও এবার যাইয়া শুইয়্যা পড়ো। আমারেও এবার এট্টু গড়াইয়্যা লইতে হইব। কাল দুপুরবেলা পালকি আসব। আমারে বসরাজার দুয়ারে দর্শন করাইতে লইয়্যা যাইবে”।

বসরাজা! মুহূর্তে মৈনাকের চোখের সামনে কত বছর আগে দেখা বসরাজার ধূসর ছবি ভেসে এলো। স্থানীয় লোকেরা অনেকেই বসরাজাকে ‘পঞ্চবটী’ নামে ডাকত। একরাহী অতিক্রম করে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে খজুরী গ্রামের উপকূলে, কমলা নদীর একটি ক্ষীণ শাখা বয়ে চলেছে অনন্তকাল। সেখানেই, বছরের পর বছর পরস্পরকে জড়িয়ে একাত্ম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অতি প্রাচীন আর প্রশস্ত বট, অশ্বথ, বিল্ব, আমলকী, অশোক গাছেদের ঘন সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে ছোটখাটো একটি কক্ষের মত, ছায়ায় ঘেরা নিরালা জায়গা। সাধু-সন্ন্যাসী এবং যোগীরা জনকপুর যাওয়া-আসার পথে পঞ্চবটী-পরিবৃত সেই ছোট্ট পরিসরে বিশ্রাম করতেন, ধ্যান করতেন। আবার প্রায়শই রাত্রিবেলা বসরাজার নীচের সেই কক্ষ থেকে ভেসে আসতো ঝিঁঝার মাতাল ডাকাতদের গান। শুঁড়িখানা থেকে আকণ্ঠ ঠর্রা পান করে বাড়ি ফেরার পথে তারাও বসরাজার তলায় একটু জিরিয়ে নিত।

পঞ্চবটীর খানিক দূরে, কমলা নদীর সূক্ষ্ম সেই প্রশাখা পেরিয়ে এগিয়ে গেলেই দেখা যেত ধুধু মাঠের ওপর শ্মশানভূমি। জীবনের অন্তিম যাত্রা যেখানে শুরু হয় প্রজ্বলিত চিতার বুকে। ভাবতে ভাবতে অভিভূত মৈনাক হঠাৎ বলে বসল, “কত্তামা, আমিও তোমার সঙ্গে বসরাজা দর্শন করতে যাব। নিয়ে যাবে তো আমাকে তোমার সঙ্গে?”

— এঁরাই, ক্যান্ রে? তর মতন নৌজওয়ানের বসরাজায় কী কাম?”
— আমার যে ভারি ইচ্ছে করছে এতদূর যখন এসেছি তখন ওখানে একবারটি ঘুরে যেতে।
— বুঝছি, বুঝছি। বসরাজার ভোলে বাবা তরে জোর তলব দিতাছে। তাঁর ডাক না আইলে হোথায় যায় কাইর সাধ্যি।” কোমল কণ্ঠে বললেন কত্তামা, “তাইলে তো আর পাল্কীতে যাওয়া হইব না। একখান মটর গাড়ি লইতে হইব।”
— সে চিন্তা তুমি করো না। ট্যাক্সি জোগাড়ের দায়িত্ব আমার।

৫.
পরদিন সকালে মৈনাকের ঘুম ভাঙতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল। স্নান করে জলখাবারের টেবিলে গিয়ে বসতে না বসতে, তীক্ষ্ণ আওয়াজে সেলফোনটা বেজে উঠল। অপর প্রান্তে অলোক। অবশেষে কাঠমান্ডুর কর্মস্থল থেকে ছুটি পেয়ে সে একরাহী ফিরছে। তবে এখন সে একরাহী থেকে আঠারো কিলোমিটার দক্ষিণে ভারত-নেপাল বর্ডারের জয়নগর শহরে। কথা সারা হয়ে গেলে শশব্যস্তে উঠে পড়ে মৈনাক বড়মামা আর অসীমকে বলল, “আমাকে এখুনি বেরোতে হচ্ছে।”

— সে কী? হঠাৎ? কেন? কোথায়? বড়মামার গলায় বিস্ময়।
— কয়েক মিনিট আগের ফোনটা অলোকের ছিল। কাঠমান্ডু থেকে বাই রোড দ্বারভাঙা হয়ে সে এখন জয়নগরে এসেছে। আমাকে ডাকছে আজকের দিনটা ওর সঙ্গে জয়নগর পর্যটন করে কাটাতে। তারপর সন্ধ্যা ছটা-সাতটা নাগাদ একরাহী ফিরে আসব আমরা।
— জয়নগর পর্যটন! মামিমার কথায় বিদ্রুপের ছোঁয়া, “জানতাম না তো জয়নগরে কোনো দ্রষ্টব্য, কোনো পর্যটনের জায়গা আছে”।
সহসা কী একটা মনে পড়ে গেল মৈনাকের। ইতস্তত করে বলল, “কত্তামাকে বলে যাওয়া হল না তো!”
— তবেই হয়েছে! খিলখিল করে হেসে উঠে বড়মামীমা উত্তর দিলেন, “তাহলে আর জয়নগর যাওয়াই হবে না আজ। তোমাদের ফিরে আসার সময়ে হয়ত তাঁর ঘুম ভাঙবে।”
কথা না বাড়িয়ে মৈনাক খুব চটপট টোস্ট, দুধ-মুড়ি আর ডিম-পোচ খেয়ে বেরিয়ে পড়ল এবং সঙ্গে অসীমও।
“আ বিগ ডে অ্যাহেড! ভালোই হল এই সঙ্গে জয়নগরটাকেও একবার হায়-হ্যালো বলা হয়ে যাবে”— মনে মনে বলল মৈনাক, “বুঝতে পারছি, বসরাজার ভোলেনাথ এই যাত্রায় আমাকে ডাকছেন না। তাই আর যাওয়া হল না।”
তারপর ওরা তিন ভাই, অসীম, অলোক আর মৈনাক মহানন্দে সারাটা দিন কাটিয়ে দিল জয়নগরে। সিনেমা দেখল একটা। মৈনাক বড়মামীমা আর তার পরমা সুন্দরী কত্তামার জন্য পছন্দসই শাড়ি কিনল।

তারপর একটু বেলা করে, ওদের পরিবারের অনেককালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু পঞ্চুকাকা আর লক্ষ্মীকাকীমার বাড়িতে সুগন্ধি তুলসী ফুল চালের ভাত, রুই মাছের কালিয়া, গরগরে করে রাঁধা পাঁঠার ঝোল, মুগডাল আর মাছের মুড়ো, ল্যাজা, পুঁইশাক, বেগুন আর কুমড়ো দিয়ে রগরগে ছ্যাঁচড়া সহযোগে খাওয়া সারল তারা।

খাওয়া-দাওয়ার পর, বিকেল পাঁচটা নাগাদ কোনরকমে একটা ট্যাক্সি জোগাড় করে ওরা জয়নগর থেকে একরাহী অভিমুখে রওনা হয়ে পড়ল। পরদিনই সকালে মৈনাককে আবার জনকপুর ফিরে গিয়ে কোলকাতার প্লেন ধরতে হবে।
আকাশে তখন দিনের শেষে সূর্যের বাড়ি ফেরার সময় আগত।
ট্যাক্সিতে উঠে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিমর্ষ গলায় মৈনাক বলল, “যাহ্, সবই হল, শুধু বসরাজায় ভোলেনাথের সঙ্গে দেখাটাই হয়ে উঠল না। এবারকার যাত্রায় আমাকে ডাকলেন না তিনি।”
একটা আক্ষেপের সুর যেন ওর কথায়! অসীম, অলোকের অন্তত তেমনটাই মনে হল।

উত্তরে অলোক বলল, “আরে সব বকওয়াস হ্যয়। বসরাজার-পঞ্চবটীতে কিছুই দেখার নেই—কাদামাটির ওপর মস্ত মস্ত ঝুরি নামিয়ে দিয়েছে বট-অশ্বথ গাছরা। তাদের তলায় মাটি আর পাথরের এক বিরাট চাঙড় রাখা। সর্বাঙ্গে সিঁদুর মাখিয়ে তাকে ভোলেনাথ মহারাজের মূর্তি বলে এখানকার অনপঢ় বেওকুফ মানুষগুলো পূজা দেয় হর বখত। কাছ থেকে বয়ে যায় কমলা নদীর সরু শাখা। আর তার কোল ঘেঁষে শ্মশান। ছোটবেলা তো আমরা সকলে গিয়েছি সেখানে।”

“যদিও আমরা খানিকটা ওদিক দিয়েই যাব, কিন্তু বসরাজায় যেতে হলে একরাহী যাবার সোজা রাস্তা থেকে কিছুটা বাঁ দিকে ঘুরতেই হবে। এখন দেরি হয়ে গিয়েছে বলে থামা যাবে না। সন্ধ্যাবেলা জায়গাটা ভাল নয়”— অসীম বলল।

মৈনাক দুচোখ বন্ধ করে গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে বসে নিজের মনে বলল, বসরাজা কি শুধুই “কমলা নদী থেকে বহতা সূতোর মত সরু এক শাখা? আর তার কোল ঘেঁষে শ্মশান?” তাহলে ভোলেনাথের সামনে জ্বলতে থাকা ধুপের সেই অপার্থিব সুগন্ধ? ভোলেনাথের সমুখে চোখ বন্ধ করে বসে তাঁর পরশের রোমাঞ্চ অনুভব করা? থালায় সিঁদুর, ফল-ফুল, লাড্ডু নিয়ে মেয়ে-বৌদের ভোলেনাথকে পুজো দিতে আসা? ধেনো খেয়ে টং হয়ে বসরাজার আশ্রয়ে ঝিম মেরে বসে থাকতে থাকতে ঝিঁঝা গ্রামের ডাকাতের গান ধরা? সবই কি নিরর্থক? এসব কি মনে নেই অসীম, অলোকের? বসরাজার স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সেই সব আনুষঙ্গিকদের বাদ দেওয়া যায় কি?"

— কী অত ভাবছ, গুরু?” অসীম বলল।
— ভাবছি পঞ্চবটী, টিমটিমে প্রদীপের আলো গায়ে মেখে ভোলেনাথ, ধুপের সুবাস, কাছেই সুর তুলে কুলকুল করে বয়ে চলা কমলা, শ্মশানে চিতাগ্নি, চিতায় শায়িত মৃতকে দেখে জীবনের নশ্বরতার অনুভূতি—এই সব মিলেমিশে মানুষের মনে বসরাজা বহন করে আনে এক আত্মিকতার স্পর্শ। সেই অনুভবে সমৃদ্ধ হতেও অনেকে আসে পঞ্চবটীতে।“
— আরে কেয়া সুনায়া জনাব নে। হো হো করে হেসে অলোক বলল, “তুই জার্নালিস্ট জানি, তবে তার সাথে কবিও?”

গাড়ি আর একটু অগ্রসর হতে ওরা দেখল একরাহী গ্রামের দিক থেকে বসরাজা অভিমুখে এগিয়ে আসতে থাকা কয়েকটি পরিচিত মুখ।
ট্যাক্সি ছুটে চলেছে দ্রুতগতিতে। বাতাসের ঝাপ্টা ঘনঘন মারছে গাড়ির বন্ধ জানালাগুলোর ওপর। সহসা অলোক চিৎকার করে উঠল, “আরে ট্যাক্সি রোকো, রোকো।”
পায়ের হ্যাঁচকা চাপে ব্রেক কষে গাড়ি থামাল ড্রাইভার। সকলে বেরিয়ে এলো ট্যাক্সি থেকে।

— কী ব্যাপার? চারিদিক তাকিয়ে অসীম বলল, “আরে! এটা তো বসরাজার ধাম! এখানে কেন থামলাম আমরা?”
অলোককে খুব উত্তেজিত দেখালো। যেন অপ্রত্যাশিত কিছু দেখেছে।
তার দৃষ্টি অনুসরণ করে অসীম আর মৈনাকের চোখ এবার পড়ল বয়ে চলা সরু নদীটার ওপারে। ওরা দেখল, শ্মশানে বেশ লোকসমাগম। কারো অন্তিম শয্যার জন্য চিতা সাজানো হয়েছে। আরও দেখল, কৌশিক মৈত্র, অর্থাৎ মৈনাকের বড়োমামা আর অসীম, অলোকের বাবা, সেখানে উপস্থিত।
ওরা দ্রুতপায়ে ছুটে গিয়ে দাঁড়াল চিতার কাছে।

কী হয়েছে, বাবা?” অসীমের প্রশ্নে দারুণ ব্যাকুলতা আর উদ্বেগ।
যেন অপ্রত্যাশিত কোনো দুর্ঘটনার আঘাতে কথা বলার শক্তি হারিয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে কৌশিক মৈত্র।
শ্মশানবন্ধুরা ততক্ষণে মৃতদেহটিকে তুলে চিতার ওপর শুইয়ে দিলেন।
এবার মৈনাক ছুটে চিতায় শায়িত মানুষটির খুব কাছে চলে এলো। মৃতের চেহারাও দেখতে পেল।

কত্তামা!

স্তম্ভিত হয়ে মাটিতে বসে পড়ল সে। মায়ামুক্ত হয়ে কত্তামায়ের ওপারে যাবার সময় হয়েছিল, অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু সেই মুহূ্র্তে নতুন করে অনুভব করল মৈনাক যে প্রিয় মানুষকে বিদায় দেবার সময়ে শুধু হারানোর ব্যথাই বাজে মনে। যে কোনো বয়সে, যে কোনো সময়ে, যে কোনো পরিস্থিতিতে—কাছের মানুষকে চলে যেতে দেওয়া কতখানি দুঃসহ।

ওর বুকের পাঁজরগুলো ভেদ করে ভেসে এলো কত্তামার গলা। সকৌতুকে বলছেন, “কী রে ছোঁড়া, ভোলেনাথ বাবার ডাক এড়াইতে পারলি না তো? সেই আসতেই হোলো? অঙ্গীকার-বদ্ধ হইয়্যছিলি যে।”
তখন আশপাশে লোকেরা বলাবলি করছিল কেমন ভাগ্যবতীর মত চলে গেলেন বুড়ি মা। আজ সকালে ঘুম থেকেই উঠলেন না। আর একটু পরেই বড়োমামা মুখাগ্নি করলেন। মৈথিলি পুরুত ঠাকুরের উদাত্ত গলা শুনতে পেল মৈনাক— ওঁ দিব্যান্ লোকান্ স গচ্ছতু।

৬.
দুই হাত তুলে বিদায় জানিয়ে মৈনাক মনে মনে বলল, “কত্তা মা, তোমার নতুন যাত্রা শুভ হোক। ভালো থেকো তুমি। যেখানেই যাও, যেখানেই আরম্ভ করো তোমার নতুন জীবন, চিরটা কাল কুড়ি বছরেই থেমে থাকবে তুমি, দেখে নিও”।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে