জীবনে কোনও কিছু সহজে পাননি গোলাম কিবরিয়া। অভাব, অনিশ্চয়তা, সমাজের চাপ, পরিবারের চাহিদা—সবকিছুকে পাশে রেখে তিনি আজ এমবিএ ডিগ্রিধারী একজন পেশাজীবী। তার এই যাত্রা কেবল ব্যক্তিগত সাফল্যের গল্প নয়; এটি বাংলাদেশের হাজারো পিছিয়ে পড়া তরুণের প্রতিচ্ছবি, যাদের একটিই লক্ষ্য—শিক্ষা দিয়ে জীবনের গতিপথ বদলানো।
গোলাম কিবরিয়ার জন্ম মাদারীপুর জেলার ডাসার উপজেলার আইসার গ্রামের একটি দরিদ্র পরিবারে। বাবা সৈয়দ আলী খলিফা ছিলেন বাঁশ দিয়ে তৈরি হস্তশিল্প বিক্রেতা, পাশাপাশি মাছ ধরে ও নৌকা চালিয়ে সংসার চালাতেন। সেই পরিবারে যেখানে তিন বেলা খাওয়ার নিশ্চয়তা ছিল না, সেখানে ‘পড়াশোনা’ শব্দটাই ছিল বিলাসিতা। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে নৌকায় যাওয়া, বাজারে মাছ বিক্রি কিংবা পুকুরে জাল টানার অভিজ্ঞতার ফাঁকে ফাঁকেই জন্ম নিয়েছিল লেখাপড়ার প্রতি টান।
ভর্তি হন আইসার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভালো ফলাফলের পর এলাকার মানুষ ও শিক্ষকরা তাকে স্কুলে যেতে উৎসাহ দেন। বাবার পক্ষে খরচ চালানো সম্ভব না হলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয়দের চাপে দর্শনা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিলেন কিবরিয়া।
কিন্তু এরপর জীবনের বাস্তবতা তাকে নিয়ে যায় ঢাকার একটি মুদি দোকানে, মাত্র ৫০০ টাকা বেতনের চাকরিতে। এখানে এসেও পড়াশোনা ছেড়ে দেননি কিবরিয়া। তবুও শিক্ষার প্রতি ভালোবাসা থেমে থাকেনি। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ধামালকোট আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। দোকানের কাজ সামলিয়ে তিনি একদিন স্কুলে যেতেন এবং পরীক্ষায় অংশ নিতেন। একসময় সিদ্ধান্ত নেন—আর নয়, পড়াশোনা চালিয়েই যেতে হবে। বাবা আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানালেও মহব্বত আলী নামে এক চাচার সহায়তায় গ্রামে ফিরে আসেন এবং আবার স্কুলে ভর্তি হন।
২০০২ সালে আগের স্কুল দর্শনা উচ্চ বিদ্যালয় থেকেই এসএসসি পাস করেন, কিন্তু অর্থের অভাবে কলেজে ভর্তি হতে পারেননি। শুরু হয় জীবিকার খোঁজে পেশাজীবনের আরেক অধ্যায়। গার্মেন্টস থেকে শুরু করে ক্লিনিক, ওষুধ কোম্পানি, এমনকি বিদেশগামী শ্রমিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র—প্রতিটি জায়গায় কাজ করেন তিনি।
২০০৭ সালের সিডরের সময় বাবা-মায়ের ঘর ভেঙে যাওয়ার পর প্রায় তিন বছর তাদের থাকার জায়গা ছিল না। এমন পরিস্থিতিতেও কিবরিয়া পড়াশোনার স্বপ্ন ছাড়েননি। বাবা মারা যাওয়ার পর শোক কাটিয়ে ২০১২ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে এইচএসসিতে ভর্তি হন। এরপর ইউল্যাব-এ অফিস স্টাফ পদে যোগ দেন পড়াশোনার সুযোগ পাওয়ার আশায়।
ইউল্যাবে কাজের সুযোগ তাকে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। কম্পিউটারের অভাব, ক্লাস মিস, আর্থিক সংকট, পরিবারের বিরোধিতা—সবকিছুর মধ্যেও তিনি একে একে বিভিন্ন বাধা পেরিয়ে শেষ করেন তার স্নাতক, এবং অবশেষে এমবিএ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মী ও শিক্ষকদের সহযোগিতা তাকে অনেকখানি এগিয়ে দেয়, বিশেষ করে যখন তার সদ্যোজাত কন্যা শিশুকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালের এনআইসিইউতে ভর্তি করতে হয়।
এতসবের মাঝে নিজের দায়িত্ব পালন, পরিবার চালানো ও উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করা কঠিনই ছিল তার জন্য। তবে ইউল্যাব প্রশাসনের আস্থা ও সহায়তায় অফিসের কাজ ও পড়াশোনাকে একসঙ্গে সামলে যান কিবরিয়া। রিসিপশনের দায়িত্ব পালন থেকে শুরু করে প্রশাসনিক নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজেও তার দক্ষতা আজ প্রমাণিত।
নিজের পড়াশোনার কষ্টের কথা স্মরণ করেই বন্ধুদের সঙ্গে মিলে গোলাম কিবরিয়া নিজ এলাকায় গড়ে তুলেছেন ‘অন্বেষণ পাঠাগার‘। নতুন প্রজন্ম ও শিক্ষার্থীদের বইয়ের প্রতি ভালবাসা তৈরি ও তরুণদের উৎসাহী করতে কাজ করে এই পাঠাগার।
গোলাম কিবরিয়ার নিজের কথায়, ‘জীবনে প্রমোশন, উন্নতি বা সাফল্য কেবল ভাগ্যের ব্যাপার নয়—প্রতিদিনের ছোট ছোট সাহসিকতার ফল।’ তার মতো একজন মানুষ যখন বলেন, ‘মনে হচ্ছে খরস্রোতা নদী সাঁতরে পার হয়েছি স্বপ্ন বোনার আশায়,’ তখন সেটি হয়ে ওঠে কেবল তার নয়—আমাদের সবার গল্প।
গোলাম কিবরিয়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) রেজিস্ট্রার লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) ফয়জুল ইসলাম বলেন, ‘গোলাম কিবরিয়া আমাদের এখানে যোগ দিয়েছিল সম্ভবত ২০১৩ সালে। শুরুতে সে পিয়নই ছিল, পরে আমরা তাকে পদ দিলাম অফিস স্টাফ। এর কারণ ছিল, তার পড়াশোনায় ব্যাপক আগ্রহ ছিল। তার আগ্রহ দেখে আমরাও তাকে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স সম্পন্ন করার সুযোগ দিলাম। পরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এমবিএ করেছে। এসময় তার যতটুকু সহযোগিতা করা দরকার, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা করেছে। সেসময় আসলে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছি। এমবিএতে যে এখানে ভর্তি হয়েছে, সেটাতেও তাকে ৭০ শতাংশ ওয়েভার দেওয়া হয়েছে। অবশ্য বাকি ৩০ শতাংশ ফি দিতেও তার সমস্যা হচ্ছিল, সেটাও শেষ পর্যন্ত দিতে পারেনি।‘
তিনি বলেন, ‘আসলে তারমধ্যে পড়াশোনার ব্যাপক আগ্রহ ছিল, সেটাকে আমরা সম্মান করেছি। আর এমপ্লয়ি হিসেবেও সে যথেষ্ট সিনসিয়ার, কাজের প্রতি তার মনযোগ আছে এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিও তার একটা কৃতজ্ঞতা আছে।’
গোলাম কিবরিয়ার ভবিষ্যত নিয়ে তিনি নিজের ভাবনা প্রকাশ করে বলেন, ‘সে যেহেতু পড়াশোনা করেছে, আমি ব্যক্তিগতভাবে চাইবো, সে যেন ভালো কোনও চাকরির জন্য চেষ্টা করে। তার অবশ্যই ভালো কোনও জবে যাওয়া উচিৎ।’
যেহেতু ইউল্যাব থেকেই সে পড়াশোনা করেছে, সেখানে চাকরিও করে; এখানেই তার ভালো কোনও পদে চাকরি হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার ফয়জুল ইসলাম বলেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তার অবশ্যই সুযোগ আছে। তবে এজন্য যেসব প্রক্রিয়া আছে, সেসব পূরণ করে আসতে হবে। এখানে মেধার মূল্যায়ন করা হয়। সেভাবে সব শর্ত পূরণ করে আসলে অবশ্যই তার এখানে চাকরির সুযোগ আছে। তবে প্রমোশন দিয়ে উচ্চপদে চাকরি দেওয়ার মতো সুযোগ নেই। তাকে অবশ্যই সব শর্ত পূরণ করে আসতে।
গোলাম কিবরিয়ার হাতে ‘প্রভিশনাল সার্টিফিকেট‘ তুলে দেওয়ার একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ইমরান রহমান লিখেছেন, ‘গোলাম কিবরিয়া গর্বভরে তার এমবিএ সনদ দেখাচ্ছে। সে কয়েক বছর আগে ইউল্যাবে একজন সাপোর্ট স্টাফ হিসেবে যোগ দিয়েছিল। বর্তমানে সে করপোরেট সেকটরে যোগ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত।’
