‘শাহবাগ থেকে টিএসসি হয়ে শিশু একাডেমি পর্যন্ত আমরা প্রায় তিনশ মানুষ রাতে ফুটপাতে ঘুমাই। ঠাণ্ডার কারণে প্রায় সারা রাতই জেগে থাকতে হয়, ঘুম আসে না। সেদিন একটা গাড়ি কম্বল দিতে এসেছিল। তিনশ মানুষ, বিশটি কম্বল নিয়ে কাড়াকাড়ি অবস্থা। বাসা-বাড়ি থেকে চেয়ে পুরনো কাথা নিয়ে এসেছে কেউ কেউ। শীতের মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে আগুন জ্বালিয়ে রাত কাটিয়ে দিই।’ কথাগুলো বলছিলেন বাংলা একাডেমির উল্টোদিকের ফুটপাতে বসে আগুন পোহানো শিরিন।
শিরিন বলেন, ‘শীতে আগুন জ্বালিয়ে রাখি। একটু পর একে একে সবাই উঠে আসে। আবার বসে থাকতে থাকতে ঝিমুনি আসলে যার যার জায়গায় চলে যায়।’ এই ফুটপাতে কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কখনও কখনও মাঠের (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ভেতরেও থাকি। ওখানে দেয়াল ঘেঁষে শুলে শীত কম লাগে। কিন্তু পুলিশের দাবড়ানি থাকেই।’
এত শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন, আপনি করেন কী জানতে চাইলে পান চিবাতে চিবাতে শিরিন এক গাল হেসে বলেন, ‘বোতল টোকাই। শুদ্ধ ভাষা আপনাদের কাছ থেকেই শিখছি। পড়ালেখা জানি না। আমার চৌদ্দকুলে কেউ নাই। সবাইকে জিগায় দেখেন আমি আসলে এতিম।’
শিরিনের পাশেই বসা তৃতীয়লিঙ্গের একজন বৃদ্ধা বলেন, ‘বয়সকালে দৌড়ে কম্বল নিতে পেরেছি বলে এখনও পারব এমনতো না। ঘরবাড়ি নাই। এভাবেই কেটে যাবে।’ রাতে আপনারা সবাই রোজ কি এভাবে সজাগ থাকেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ছোট ছোট টোকাই যারা আছে তারা ১২টা পর্যন্ত এদিক -সেদিক ঘোরে। এটা-ওটা খায়। সকালে আবার উঠে যায় সাড়ে পাঁচটার মধ্যে। আর এই শীতে মশার কামড়ে মাঝরাতে উঠে পড়াতো রোজকার বিষয়।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী রাজধানী ঢাকায় ভাসমান মানুষের সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি। বাস্তবে ভাসমান মানুষের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। ক্রমেই এ সংখ্যা বাড়ছে। বিভিন্ন রকমের দুর্যোগের কারণে নিঃস্ব হয়ে মানুষ ঢাকায় আসছে।
সরেজমিনে কথা বলে জানা গেছে, ফুটপাতে রাত কাটানো বৃদ্ধাদের কারও ঘরে জায়গা দেয়নি সন্তানেরা। এদের মধ্যে ঘুমন্ত কয়েকজনের গায়ে নতুন কম্বল দেখা গেলেও বেশিরভাগই গায়ে ছেড়া কাঁথা। অথচ তাপমাত্রা তখন ১২ডিগ্রিতে।
তেমনই একজনকে হাইকোর্টের সামনে রাত সাড়ে বারোটায় দেখা গেল বসে আছেন। হুডি জ্যাকেট পরা গায়ে কাঁথা মোড়ানো, না ঘুমিয়ে জেগে আছেন। ঘুমাননি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হাঁপানির সমস্যা। শীতের মধ্যে শুইলে কষ্ট। বসে থাকি।’ যখন এই বৃদ্ধার সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হচ্ছে, তখন পাশ থেকে আরও দুজন উঠে বসেন। হাঁপাতে হাঁপাতে ওই বৃদ্ধা আরও বলেন, ‘আমার কেউ নাই। স্বামী সন্তানদের নিয়া যুদ্ধের পরের বছর ঢাকায় আসছি। তার পরের বছরই স্বামী মরে গেছে। এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিজে না খেয়ে বড় করেছি।’ তারা কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঢাকাতেই। ছেলের বউ ভালো না। ছেলেও ভালো না। তাদের একঘরে বউবাচ্চা নিয়া গাদাগাদি অবস্থা, আমার জায়গা কই থেকে দেবে।’
কষ্ট করে মানুষ করলেন দেখবে না কেন প্রশ্ন করতেই পাশে শোয়া থেকে উঠে বসেন রহমান নামের এক ব্যক্তি। কেবল শুক্রবার দিন বেলুন ফোটানোর খেলা নিয়ে যান পার্কে-পার্কে। তাছাড়া বেকার। তিনি বলেন, ‘মানুষ করতে পারলে রাখতো, আমরাতো কেবল বড় করেছি’। তারও একমাত্র ছেলে ঢাকাতেই মুগদায় থাকে। কিন্তু বাবার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই।
বাসা ছেড়ে আসলেন কেন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘থাকার মতো না। এখানে খাই না-খাই সবাই সমান। কেউতো গালি দেয় না। নিজ রক্তের গালি শুনতে গায়ে কাঁপন লাগে।’
রাজধানীজুড়ে এই মানুষদের বিষয়ে কারও তেমন কোনও আগ্রহ নেই। এদের সঠিক পরিসংখ্যান নেই জানিয়ে দুর্যোগ ফোরামের মেহেরুন্নেসা বাংলা ট্রিবিউনক বলেন, ‘কেবল নদীভাঙা কর্মহীন যত মানুষ কাজের খোঁজে ঢাকায় আসেন, সেই সংখ্যাইতো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া পারিবারিক জটিলতায় ঢাকাতে বসবাসকারী বয়স্করা রাস্তায় বসবাস শুরু করেছেন। এদের স্বাভাবিক যে মৌলিক অধিকার সেবিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ জরুরি। কারণ পথে বসবাসকারী শিশুরা ভঙ্গুর দশায় আছে এবং এতে করে সমাজে একটা বড় ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হবে ।’
ছবি: নাসিরুল ইসলাম।
/ইউআই/এপিএইচ/
/আপ-এএ/