X
সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫
১৬ আষাঢ় ১৪৩২

মুক্তিযুদ্ধের খেতাব পুনর্মূল্যায়নের পরিকল্পনা সরকারের

এমরান হোসাইন শেখ
২৩ মার্চ ২০১৭, ২৩:০০আপডেট : ২৩ মার্চ ২০১৭, ২৩:৩৬

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর মতো বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদেরও বেশি সংখ্যায় খেতাবে ভূষিত করার বিষয়টি বিবেচনা করছে সরকার। খেতাববঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধাদের দীর্ঘদিনের দাবি ও রাজনৈতিক নেতৃত্বে পরিচালিত জনযুদ্ধটি যাতে অদূর ভবিষ্যতে সামরিক যুদ্ধ হিসেবে পরিচিতি না পায়, সেজন্যই এই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে এখনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির কাজ শেষ হওয়ার পর সরকার খেতাব পুনর্মূল্যায়নের উদ্যোগ নেবে।
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া হয়েছে চার ধরনের খেতাব। এগুলো হচ্ছে- বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম, বীরবিক্রম ও বীরপ্রতীক। বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব ধরনের মুক্তিযোদ্ধাদের খেতাব পাওয়ার কথা থাকলেও সংখ্যার বিচারে সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যরাই বেশি খেতাব পেয়েছে। এমনকি খেতাবপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে যুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধকারী পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও বঞ্চিত হয়েছেন। এ নিয়ে বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষোভ দীর্ঘদিনের। সরকারের বিভিন্ন ফোরামে বিভিন্ন সময় তারা বিষয়টি পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছেন। তাদের বঞ্চনার এই বিষয়টি সংসদ পর্যন্তও গড়িয়েছে। অবশ্য বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের বঞ্চনার সঙ্গে সহানুভূতিশীল বর্তমান সরকারও। ক্ষমতাসীন সরকার মনে করে, খেতাবের বিষয়টি পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন। তা না হলে রাজনৈতিক নেতৃত্বে পরিচালিত দেশের মুক্তিযুদ্ধ এক সময় বিশ্বের কাছে সামরিক যুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
মুক্তিযুদ্ধের খেতাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিটি সামরিক ও আধা-সামরিক সদস্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়েছে। বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত সাত জনের মধ্যে পাঁচ জন সামরিক ও দুই জন আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া অন্যান্য বাহিনীর সদস্য বা বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের কেউই এ উপাধি পাননি। এদিকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধির মতো বীরউত্তম, বীরবিক্রম ও বীরপ্রতীক খেতাবের ক্ষেত্রেও যুদ্ধে অংশ নেওয়া সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাই প্রাধান্য পেয়েছেন। তবে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি না পেলেও অন্যান্য বাহিনীর কিছু সদস্য ও কিছুসংখ্যক বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা বীরউত্তম, বীরবিক্রম ও বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন।
পদক প্রদানের সংখ্যার বিচারে সামরিক ও বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের এই বিস্তর ফারাককে ‘বৈষম্যমূলক’ বলে মনে করেন অনেকে। মুক্তিযুদ্ধটি জনযুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও বীরত্বসূচক পদকগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা পাওয়ায় সম্প্রতিককালে সরকারের ভেতরে ও বাইরে বিতর্ক উঠেছে। বিষয়টি পুনর্মূল্যায়নের দাবিও উঠেছে বিভিন্ন মহলে। প্রদত্ত খেতাব বা পদক সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বেশি পাওয়ায় ভবিষ্যতে দেশের মুক্তিযুদ্ধের ধরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে বলে খোদ সরকারের পক্ষ থেকেও আশঙ্কা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধটি জনযুদ্ধের পরিবর্তে সামরিক যুদ্ধ হিসেবে পরিচিতি পেতে পারে। এজন্য সরকার পদক প্রদানের বিষয়টি পুনর্মূল্যায়নের চিন্তা করছে বলে জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা অবদান রেখেছিলেন, তাদের মধ্যে থেকে অবদানের ভিত্তিতে সরকার সাত জন বীরশ্রেষ্ঠের বাইরে ৬৮ জনকে বীরউত্তম, ১৭৫ জনকে বীরবিক্রম ও ৪২৬ জনকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করে। এই সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ ছাড়াও ৬৮ জন বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্তদের মধ্যে ৬৬ জন বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য। এখানে মাত্র দু’জন রয়েছেন বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা। ১৭৫ জন বীরবিক্রমের মধ্যে ১৩৭ জন বিভিন্ন সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং ৩৮ জন গণবাহিনী (মুক্তিযোদ্ধা, গেরিলা, মুজিব বাহিনী) ও পুলিশ থেকে আগত। বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ৪২৬ জন। এর মধ্যে মুক্তিবাহিনীর সদস্য ১২০ জন ও সামরিক বাহিনীর সদস্য ৩০৬ জন।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধের বাইরে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঁচাতে গিয়ে নিজ বাহিনীর বিপদগামী কিছু সেনা সদস্যের হাতে নিহত হন কর্নেল জামিল আহমেদ। ২০১০ সালে তাকে বীরউত্তম খেতাব প্রদান করা হয়। এছাড়া স্বাধীনতার পর এপর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও অন্যান্য স্থানে পরিচালিত অপারেশনে সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ রাইফেলসের (বর্তমানে বিজিবি) ১২৬ জন বীরত্বসূচক খেতাব পেয়েছেন।
সশস্ত্র বাহিনীর বাইরে স্বল্পসংখ্যক বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা পদক পাওয়ার ঘটনা নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচিত হয়। গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর সংসদের প্রশ্নোত্তরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ সুবিদ আলী ভূঁইয়া। মন্ত্রী তার জবাবে মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক ও বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদেরও বীরত্বের জন্য ‘বীরত্বসূচক খেতাব’ পুনর্মূল্যায়ন করার কথা জানান। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক ও সিভিলিয়ান মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের মূল্যায়ন করে খেতাব না দেওয়া হলে মনে হবে এটা সামরিক মুক্তিযুদ্ধ ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ সামরিক নয়, রাজনৈতিক জনযুদ্ধ ছিল।’
এ প্রসঙ্গে মন্ত্রী জানান, স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনী প্রধান এমএজি ওসমানীর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের মে মাসে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটি মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বসূচক খেতাবগুলো দেয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি রাজনৈতিক যুদ্ধ, জনযুদ্ধ। মাত্র দুয়েকজন ছাড়া রাজনৈতিক কেউই মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বসূচক খেতাব পাননি। এতে রাজনৈতিক মুক্তিযোদ্ধারা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক-বেসামরিক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন করা না হলে এটা বৈষম্য হবে। এভাবে চলতে থাকলে মনে হবে, মুক্তিযুদ্ধ সামরিক যুদ্ধ ছিল। এটা যে রাজনৈতিক যুদ্ধ সেটা আর থাকবে না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুবিদ আলী ভূঁইয়া মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের কথা উল্লেখ করে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জীবিত কেউ খেতাব পেলে আমাকে দিতে হবে। কিন্তু আমি কোনও পদক পাইনি। আমি মনে করি, আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আর সরকার বেসামরিক ব্যক্তিদের পদক দেওয়ার যে বিষয়টি বিবেচনা করছে, আমি তার সঙ্গে একমত। সরকারের সুযোগ আছে অবদান পুনর্মূল্যায়ন করে ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধাদের যোগ্য সম্মান দেওয়ার।’
মুক্তিযুদ্ধের একজন কমান্ডার ও সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সম্প্রতি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার কারণে পদক প্রদানে বৈষম্য হয়েছে। সামগ্রিক এই সম্মান ও কৃতিত্বটি কেবল সামরিক ক্ষেত্র নয়, সব ক্ষেত্রকে মূল্যায়ন করা উচিত ছিল।’ তিনি বলেন, ‘এটা জনযুদ্ধ ছিল। তাই জনগণকেই তার খেতাব দেওয়া উচিত।’
বীরশ্রেষ্ঠ পদকটি সামরিক বাহিনীর বাইরে কারও পাওয়ার সুযোগ ছিলো কিনা জানতে চাইলে সরকার দলীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম বলেন, ‘অন্যান্য পদক সামরিক বাহিনীর বাইরে পেয়েছেন। কাজেই অবদান থাকলে নিশ্চয়ই বীরশ্রেষ্ঠ পদকও বেসামরিক কেউ পেতে পারতেন। আমরা যা জেনেছি, তাতে কিছু কিছু মুক্তিযোদ্ধা তার সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। কিন্তু তার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা কমান্ডার বিষয়টি হয়তো সেইভাবে সুপারিশ করে সরকারের দৃষ্টিতে আনতে পারেননি।’ স্বাধীনতার এতদিন পরে এই বিষয় নিয়ে মন্তব্য করা সমীচীন নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের খেতাব পুনর্বিবেচনায় সরকারের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক মঙ্গলবার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় রয়েছে। তবে কোনও আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ এখনও শুরু হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমরা মুক্তিযুদ্ধের তালিকা যাচাই-বাছাই করছি। এটা সম্পন্ন হওয়ার পর খেতাবের বিষয়ে চিন্তা করব। বীরত্বসূচক কার কী অবদান আছে তা খুঁজে বের করে সেভাবে মূল্যায়ন করব।’
এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পদকটি বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিও সামরিক বাহিনী বা সিভিলিয়ান মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ নতুন করে পেতে পারেন বলেও মন্তব্য করেন মন্ত্রী।
/এপিএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
শাহে আলম মুরাদ আবারও রিমান্ডে 
শাহে আলম মুরাদ আবারও রিমান্ডে 
ত্বকের যত্নে দই ব্যবহার করলে যেসব উপকার পাওয়া যায়
ত্বকের যত্নে দই ব্যবহার করলে যেসব উপকার পাওয়া যায়
পিরোজপুরে যুবদলের কমিটি গঠনের তিন দিন পর আরও দুই নেতার পদ স্থগিত
পিরোজপুরে যুবদলের কমিটি গঠনের তিন দিন পর আরও দুই নেতার পদ স্থগিত
রুশ হামলায় ইউক্রেনের এফ-১৬ পাইলট নিহত
রুশ হামলায় ইউক্রেনের এফ-১৬ পাইলট নিহত
সর্বাধিক পঠিত
ঘরে ঢুকে নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা, যুবককে পিটিয়ে হত্যা এলাকাবাসীর
ঘরে ঢুকে নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা, যুবককে পিটিয়ে হত্যা এলাকাবাসীর
এনবিআরের শীর্ষ ৬ কর্মকর্তার দুর্নীতি অনুসন্ধান করছে দুদক
এনবিআরের শীর্ষ ৬ কর্মকর্তার দুর্নীতি অনুসন্ধান করছে দুদক
ব্যাগে গুলির ম্যাগাজিন পাওয়ার বিষয়ে যা জানালেন উপদেষ্টা আসিফ
ব্যাগে গুলির ম্যাগাজিন পাওয়ার বিষয়ে যা জানালেন উপদেষ্টা আসিফ
এনবিআরের সব চাকরি ‘অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস’ ঘোষণা
এনবিআরের সব চাকরি ‘অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস’ ঘোষণা
এইচএসসি পরীক্ষা দিতে গিয়ে নিখোঁজ ছাত্রী সাভারে উদ্ধার
এইচএসসি পরীক্ষা দিতে গিয়ে নিখোঁজ ছাত্রী সাভারে উদ্ধার