X
রবিবার, ২৬ মে ২০২৪
১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

কাগুজে স্বীকৃতিও কেড়ে নেওয়া হয় রোহিঙ্গাদের

নাসিরুল ইসলাম, কুতুপালং অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে
১০ অক্টোবর ২০১৭, ১৪:২৮আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০১৭, ২১:০৪

একজন রোহিঙ্গার পারিবারিক পরিচয়পত্র মিয়ানমারের রাখাইন থেকে জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন রোহিঙ্গারা। হত্যা, ধর্ষণের মতো নির্মম নির্যাতন তো বটেই, ঘরে মানুষ থাকা অবস্থাতেই আগুন লাগিয়ে দেওয়ার মতো বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে তারা বাধ্য হয়েছেন দেশ ছাড়তে। তবে রোহিঙ্গাদের এতসব সংকটের মূলে রয়েছে তাদের পরিচয় আর অস্তিত্বের সংকট। প্রজন্মের পর প্রজন্ম রোহিঙ্গা নৃতাত্ত্বিক পরিচয় নিয়ে বেড়ে ওঠার পর হঠাৎ করেই তারা হয়ে গেলেন বাঙালি কিংবা ভারতীয়; সরকারি আদেশে জানতে পারলেন, তারা আর মিয়ানমারের নাগরিক নন। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা এভাবেই বলছেন হঠাৎ করেই নিজেদের পরিচয়হীন, রাষ্ট্রহীন হয়ে ওঠার বেদনার কথা।
রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্র ও জমির দলিল জানা যায়, সপ্তম শতক থেকেই মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বসবাস। সরকারিভাবেও তাদের ছিল মিয়ানমারের নাগরিকত্ব ও রোহিঙ্গা পরিচয়ের স্বীকৃতি। কক্সবাজারের কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন মো. জোহার। রোহিঙ্গা ভাষায় জুফারাং আর বর্মি ভাষায় সাব্রেডো গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। গ্রাম ছেড়ে চলে আসার আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন পালে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান।
মো. জোহারের বিয়ের অনুমতিপত্রের এই স্বীকৃতির কোনও মূল্য এখন নেই মিয়নমার সরকারের কাছে মো. জোহার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘আমার বাবা মৌলানা সিরাজুল্লাহ। ১৯৪২ সালে বাবা জমি-জমা নিয়ে মামলা করেছিলেন কোর্টে। ওই সময় কাগজপত্রে তার পরিচয় লেখা হয়েছিল রোহিঙ্গা মৌলানা সিরাজুল্লাহ। আমরাও নিজেদের পরিচয় এভাবেই জানতাম। তবে সামরিক শাসন শুরুর পর রোহিঙ্গাদের জন্য পারিবারিক পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। এসময় আমাদের পরিচয় লেখা হয় এভাবে— ‘মো. জোহার, বাঙালি, ইসলাম।’ একইভাবে হিন্দুদের বেলায় নামের সঙ্গে পরিচয় লেখা হয় ‘ইন্ডিয়া, হিন্দু’ এভাবে।’’
পরিচয়পত্র হাতে সোনা মিয়া; নতুন এই পরিচয়পত্রে মুছে ফেলা হয়েছে ছবি মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের পরিচয়কে এভাবে মুছে ফেলার প্রচেষ্টা নিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে দানা বাঁধে ক্ষোভ। নিজের আইডি কার্ড দেখিয়ে সোনামিয়া বলেন, ‘আমাদের পরিচয় বাঙালি হবে কেন, আমরা তো রোহিঙ্গা।’ সঙ্গে থাকা পারিবারিক পরিচয়পত্রে দেখান, তার গ্রামের বাড়ি সাব্রেডং, থানা রাসিডং এবং জেলা আকিয়াব।
পরিচয়পত্র হাতে মেম্বার মওলানা এজাহারুল হক রাখাইনের জুফারাং গ্রামের মৌলানা আব্দুল গাফ্ফার ছিলেন মাদ্রাসার শিক্ষক। বয়স জিজ্ঞাসা করলে বলেন, ‘ত্রিশ তিন’। পাশেই বসা একই ইউনিয়নের মেম্বার মৌলানা এজাহারুল হক জানালেন, বয়স ৩৩ বছর বলে বোঝানোর চেষ্টা করছেন আব্দুল গাফফার। তারা দু’জনেই বললেন, সামরিক শাসন শুরু হওয়ার পর থেকেই রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের সূত্রপাত। কয়েক দশক ধরেই তাদের ওপর চলে আসছে এমন বঞ্চনা।
২ লাখ বর্মি টাকা খরচ করে বিয়ের এই অনুমতিপত্র পেয়েছিলেন মো. জোহার রোহিঙ্গাদের কী ধরনের বঞ্চনা-অত্যাচারের মুখোমুখি হতে হয়— জানতে চাইলে চেয়ারম্যান জোহার বলেন, ‘বিয়ে করতে হলে অনুমতিপত্র নিতে হয়।’ বর-কনের ছবিসহ একটি কাগজ দেখিয়ে বলেন, ‘এটি আমার বিয়ের অনুমতিপত্র। এটি নিতে দুই লাখ বর্মি টাকা দিতে হয়েছে সরকারকে। আমাদের এলাকার সব মাদ্রাসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মসজিদে নামাজ পড়তে দেওয়া হয় না। স্কুল-হাসপাতাল তো একেবারেই নেই।’
পারিবারিক পরিচয়পত্র হাতে সোনামিয়া রোহিঙ্গারা জানালেন, ২০১২ সালে রোহিঙ্গা-বর্মি দাঙ্গার পর রোহিঙ্গাদের ছবিযুক্ত আইডি কার্ড ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এর বদলে দেওয়া হয় অন্য একটি কার্ড, যাতে কোনও ছবি নেই। পরিচয়পত্র থেকে ছবি মুছে ফেলার প্রক্রিয়াকে তারা রোহিঙ্গাদেরই মিয়ানমারের মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার প্রক্রিয়া হিসেবে দেখছেন।
জোহার, আব্দুল গাফ্ফার, এজাহারুল হকরা বললেন, ২০১৫ সালের পর থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীসহ সরকারি বাহিনীর সদস্যরা তাদের বলতে থাকেন, তারা মিয়ানমারের বংশোদ্ভূতই নয়, তারা রাখাইনে গিয়েছেন বাংলাদেশ থেকে।
(বাঁ থেকে) মওলানা এজাহারুল, মওলানা আব্দুল গাফফার ও মো. জোহার; সামনে রাখা পরিচয়পত্র ও দলিলপত্রে ছড়িয়ে আছে জাতিসত্তার সংকট এই ধরনের আত্মপরিচয় আর জাতিগত অস্তিত্বের সংকট নিয়েই রোহিঙ্গাদের কেবল জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য আশ্রয় নিতে হয়েছে বাংলাদেশে। তারা নিজেরাও জানেন না, মিয়ানমার সরকার তাদের পূর্বপুরুষের জাতিসত্তার পরিচয় আর কখনও মেনে নেবে কিনা।
আরও পড়ুন-
তবু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নতুন জীবনের আলো
প্রতিবেশীদের মমতায় বেঁচে আছে ওরা দুই ভাই

/টিআর/টিএন/
সম্পর্কিত
ভূমিধস আতঙ্কে রোহিঙ্গারা, ক্যাম্পে বাড়তি সতর্কতা
আবারও রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি টেরোরিস্ট’ ট্যাগ
রাখাইনে নতুন সংঘাতে উদ্বাস্তু দুই লাখএপারে অস্থিরতায় দিন কাটছে স্বজনদের 
সর্বশেষ খবর
বেইজিং যাচ্ছেন পররাষ্ট্র সচিব
বেইজিং যাচ্ছেন পররাষ্ট্র সচিব
নদী রক্ষার যুদ্ধে আমরা জয়ী হবো: নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী
নদী রক্ষার যুদ্ধে আমরা জয়ী হবো: নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী
সেপটিক ট্যাংক নির্মাণ করতে গিয়ে প্রাণ গেলো ২ শ্রমিকের
সেপটিক ট্যাংক নির্মাণ করতে গিয়ে প্রাণ গেলো ২ শ্রমিকের
বিমান বাহিনীর নতুন প্রধান হাসান মাহমুদ খাঁন
বিমান বাহিনীর নতুন প্রধান হাসান মাহমুদ খাঁন
সর্বাধিক পঠিত
এমপি আনার হত্যা: কে এই সিলিস্তা রহমান?
এমপি আনার হত্যা: কে এই সিলিস্তা রহমান?
ঘূর্ণিঝড় রিমাল: পায়রা ও মোংলায় ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত
ঘূর্ণিঝড় রিমাল: পায়রা ও মোংলায় ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত
জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে গেলো সুন্দরবন
জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে গেলো সুন্দরবন
বেনজীরের বাঁচার উপায় কী
বেনজীরের বাঁচার উপায় কী
সান ফার্মার নতুন কারখানা উদ্বোধন করলেন সালমান এফ রহমান
সান ফার্মার নতুন কারখানা উদ্বোধন করলেন সালমান এফ রহমান