সরকারের বর্তমান মেয়াদে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের কাজ আর করা হচ্ছে না। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল নির্বাচনের জন্য আপাতত সরকারের এই মেয়াদে তালিকা প্রণয়নের জন্য কোনও উদ্যোগও নেওয়া হবে না। জাতীয় নির্বাচনের পর নতুন করে তালিকা করা হবে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) কর্মকর্তারা।
অন্যদিকে, আগামীতে তালিকা প্রণয়নের স্থানীয় যাচাই-বাছাই কমিটিতে বর্তমানে অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত কাউকে রাখা হবে না বলে জানিয়েছে মুক্তিযুক্ত বিষয়ক মন্ত্রণালয়। অভিযোগ ওঠা এলাকায় নতুন কমিটি করে দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, তালিকা থেকে বাদ পড়া মুক্তিযোদ্ধা এবং যারা কখনও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি—এমন বঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এজন্য অনলাইনে আবেদন করতে বলা হলে এক লাখ ৭০ হাজার আবেদন জমা পড়েছিল। আমরা আবেদনগুলো ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য স্থানীয় কমিটির কাছে পাঠাই। তারা ২৫ হাজারেরও বেশি আবেদন তালিকায় অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করে।
মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, পরে আমাদের কাছে বিভিন্ন এলাকা থেকে এসব আবেদনের বিপরীতে অভিযোগ আসে। এমনকি গোয়েন্দা রিপোর্টেও স্থানীয় কমিটির সুপারিশে অনিয়ম ধরা পড়ে। এরপর গত ১১ মার্চ তালিকা প্রস্তুত স্থগিত করা হয়।
৪৭ বছরে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ছয়বার সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে। একই সময়ে মুক্তিযোদ্ধার বয়স, সংজ্ঞা ও নির্ণয় করার প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা হয়েছে ১১ বার।
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল জানিয়েছে, ২০১৭ সালের ১২ জানুয়ারি মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে ৪৮০টি কমিটি করার গেজেট প্রকাশ করা হয়। কমিটিগুলো কাজ শুরু করে গত বছরের ২১ জানুয়ারি থেকে। এর মধ্যে ৩৬৫টি কমিটি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ২৫ হাজার নাম সুপারিশ করে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জানিয়েছেন, এর মধ্যে অন্তত একশ’টি কমিটির প্রতিবেদন ত্রুটিপূর্ণ ছিল।
মন্ত্রী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা যে নীতিমালার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য অনুরোধ করেছিলাম, সেই নীতিমালা অনুসরণ করেনি অধিকাংশ কমিটি। মোট সুপারিশ করা তালিকার ১০ শতাংশ ঠিক হয়েছে, বাকিগুলো ঠিক নেই। এসব কারণে কমিটির এই কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে।’
এদিকে, তালিকা প্রণয়ন স্থগিত থাকার পরও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা আবেদন ও আপিল নিয়ে আসছেন।
শনিবার (৩১ মার্চ) রাজধানীর কাকরাইলে অবস্থিত স্কাউট ভবনে জামুকা কার্যালয়ে এমনই এক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে দেখা হয়। নাম নওয়াজ আলী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার সেজামুড়া গ্রামের মধু মিয়ার সন্তান।
নওয়াজ আলী বলেন, ‘আমি ৩ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছি। আমার বাবা মধু মিয়াকে পাকিস্তানি দালালরা হত্যা করেছে। আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে একবার ২০ হাজার টাকার সহায়তাও পেয়েছিলাম। কিন্তু ইউনিয়ন কমান্ডারের সঙ্গে আমার পারিবারিক দ্বন্দ্ব থাকায় তিনি আমার নামের তালিকায় পাঠাননি। তাই আমি এখানে আপিল করতে এসেছি।’
জামুকা কর্মকর্তারা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী বঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধার আওতায় আনার জন্য এই তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি চান প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা মুক্তিযোদ্ধারাও যেন সব সুবিধা পান। কিন্তু অনেক অনিয়ম হওয়ায় সেই উদ্দেশ্য বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কমিটি কাজ করছে।
তালিকার কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনিয়মের অভিযোগ আসতে থাকে। গত বছরের ২১ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে তালিকা প্রণয়নে অনিয়মের অভিযোগ এনে প্রতিবাদ সমাবেশ করে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের অভিযোগ ছিল, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি—এমন ব্যক্তিদের টাকার বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে স্থানীয় কমিটি। এমন অসংখ্য অভিযোগ মন্ত্রণালয় ও জামুকার দফতরে এসেছে গত এক বছরে।
এসব অনিয়মের কারণেই মূলত গত ১১ মার্চ মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির কাজ স্থগিত করা হয়। মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের নির্বাচনের কারণে দ্রুত আর তালিকা তৈরির কথা ভাবছে না সরকার। যেসব এলাকার কমিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, সেগুলো বাদ দিয়ে নতুন করে কমিটি করে যাচাই-বাছাই কার্যক্রম চালানো হবে। এসব কার্যক্রম নতুন করে শুরু করতে বিলম্ব হবে। তাড়াহুড়ো করে তালিকা প্রণয়ন করে কোনও ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না সরকার।
নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই তালিকা প্রণয়নের কাজ স্থগিত করা হয়েছে উল্লেখ করে জামুকা মহাপরিচালক মিজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা যেসব ক্যাটাগরি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য দেওয়ার অনুরোধ করেছিলাম, তা কমিটিগুলো অনুসরণ করেনি। মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চেয়ে যত আবেদন জমা পড়েছে, প্রকৃতপক্ষে এত মুক্তিযোদ্ধা তালিকার বাইরে নেই। এ বিষয়ে আরও স্বচ্ছতার প্রয়োজন রয়েছে। পরে বৈঠক করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও স্বীকৃতি চায় জানিয়ে মিজানুর রহমান বলেন, ‘জোট সরকারের আমলে অসংখ্য ব্যক্তি যুদ্ধ না করে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।’
তালিকা প্রণয়নের কাজ আবার কবে শুরু হবে—জানতে চাইলে মন্ত্রী মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমি এখনই কোনও মন্তব্য করতে চাই না। কমিটি এ বিষয়ে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে আমরা বাদ পড়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্ত করতে চেয়েছিলাম। ১০ থেকে ১৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আসত বলে আমাদের ধারণা ছিল। তবে সেটা স্বচ্ছভাবে করা যায়নি।’
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিষয়ে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। আমরা আগামীতে যখন স্থানীয় পর্যায়ে কমিটি করব, তখন তাদের রাখব না। নতুন কমিটি করে যাচাই-বাছাই করা হবে।’
