ওয়াজ মাহফিল নিয়ন্ত্রণ না করে পরিশীলিত করার পক্ষে দেশের আলেমরা। তারা ওয়াজ মাহফিলের বক্তাদের মধ্যেও সমন্বয় চান। ধর্মীয় এ অনুষ্ঠান নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও পর্যালোচনার পর আলেমরা অভিযোগ করছেন, সরকার ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের (ইফাবা) মাধ্যমে ওয়াজ মাহফিল নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। যদিও ইফাবা বলছে, কোনও নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগই তারা নেয়নি।
ওয়াজ মাহফিলে ১৫ বক্তার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভিযোগ ও ব্যবস্থা নিতে সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে নড়েচড়ে বসেছেন আলেমরা। শুক্রবার (৫ এপ্রিল) এ বিষয়টি নিয়ে মাহফিলের বক্তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছেন। শনিবারও (৬ এপ্রিল) আলেমদের একটি বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ওয়াজ-মাহফিলের বক্তাদের বয়ানের বিভিন্ন বিষয় আমলে নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক অধিশাখা-২ থেকে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এতে মাহফিলের ১৫ বক্তার নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এই বক্তারা সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মবিদ্বেষ, নারীবিদ্বেষ, জঙ্গিবাদ, গণতন্ত্রবিরোধী ও দেশীয় সংস্কৃতিবিরোধী বয়ান দেন। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা গ্রহণের অংশ হিসেবে ছয়টি সুপারিশও করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ইফাবা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও সব বিভাগীয় কমিশনারের কাছে এটি পাঠানো হয়েছে।
ওয়াজ মাহফিলের বিশৃঙ্খলা বন্ধ করাতে আলেমদের সমন্বয়ে বোর্ড গঠনের কথা বলেছেন চরমোনাই পীর ও ইসলামী আন্দোলনের আমির মাওলানা সৈয়দ রেজাউল করীম। তিনি বলেন, ‘আলেমদের সমন্বয়ে একটি বোর্ড গঠন করে ওয়াজ মাহফিলে বিশৃঙ্খলা বন্ধ করা প্রয়োজন। তবে আলেমদের অংশগ্রহণ ছাড়া শুধু সরকারের তত্ত্বাবধানে করলে এটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হওয়ার শঙ্কা আছে ‘
ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, ওয়াজ প্রচলিত আরবি শব্দ, যার অর্থ, উপদেশ, আবেদন, প্রচার, সতর্কীকরণ ইত্যাদি। সব আম্বিয়ায়ে কেরামের মূল মিশন, মূল সুর ও মূল আবেদন ব্যাপকতা পেয়েছে এই ওয়াজ, তাবলিগ, দাওয়াতের মাধ্যমে। ওয়াজে আলেমরা মানবতার, ইনসাফ, সাম্য, দেশপ্রেম, নারী অধিকার, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলবেন। এই দায়িত্ব পালন থেকে তাদেরকে কেউ সরিয়ে দিতে পারেন না। তেমনিভাবে আলেমরাও এই কর্তব্য পালন থেকে অব্যাহতি নিতে পারেন না।’
তিনি বলেন, ‘যারা দ্বীনি ওয়াজকে বিনোদনের মাধ্যম বানিয়ে নিচ্ছেন তাদের ব্যাপারে হাক্কানি (সঠিক) আলেমদের সমন্বয়ে ভাববার অবকাশ তো রয়েছে। সময় ও ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয় নিয়েও ভাবা যেতে পারে।’
হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক বলেন, ‘ওয়াজ মাহফিল ও বক্তাদের নিয়ন্ত্রণের সরকারি চেষ্টা দেশের সংবিধান, গণতন্ত্র, ধর্মীয় চেতনা ও মূল্যবোধবিরোধী। যদি কোনও বক্তার আলোচনায় সরকার বিব্রত হন, তবে সরকার তাকে সতর্ক করতে পারেন এবং বয়ানের ব্যাখ্যা তলব করতে পারেন। তা না করে পুরো ওয়াজের মাঠকে দোষারোপ করা গভীর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত বহন করছে।’
তিনি বলেন, ‘সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতা রয়েছে। ইসলামের প্রচারার্থে ওয়াজ মাহফিলে বাধা প্রদান বা শরিয়তসম্মত কোনও বক্তব্যকে হেয় করা বা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা প্রকারান্তরে ইসলামেরই বিরোধিতা করার শামিল। আলেমরা যদি কুরআন হাদিসের বিধানের কথা বলে আর তা সরকারের বিরুদ্ধে যায় তাতে বক্তার অপরাধ কোথায়? যেমন, ছবি টানানো, ভাস্কর্য তৈরি, ঘুষ, সুদ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, অন্যায়ভাবে গুম ও খুন করা, ইসলামের বিধান মতে হারাম। এগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলা আলেমদের জন্য ফরজ। আর মাহফিলে এসব বললে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কারও গায়ে লাগে। এতে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে বক্তা ও মাহফিলের ওপর আঘাত করার চেষ্টা করেন।’
জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে যে প্রস্তাবনা তৈরি করেছে তা ইসলামকে নিয়ন্ত্রণ করার শামিল। এটা একটা গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। ইসলামবিমুখ করতেই এ ধরনের প্রস্তাবনা। সরকার এ ধরনের চক্রান্ত থেকে ফিরে না আসলে দেশের আলেম-ওলামাদের ঐক্যবদ্ধ করে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
ওয়াজ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে আলেমদের অভিযোগ প্রসঙ্গে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গবেষণা বিভাগের পরিচালক নূর মোহাম্মদ আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পর্যালোচনা, পরামর্শ পেয়েছি। এসব পর্যালোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। আমাদের ডিজি স্যার বিদেশ থেকে ফেরার পর আলোচনা করব। এখন যারা বলছেন সরকার ওয়াজ মাহফিল নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তারা ঠিক বলছেন না। নিয়ন্ত্রণের কোনও চিন্তা আমাদের নেই। যারা এমন বলছেন, তারা প্যানিক সৃষ্টি করছেন।’
এ সংক্রান্ত নিউজ
ওয়াজ মাহফিলে যে বক্তাদের নিয়ে আপত্তি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের
ওয়াজ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৬ সুপারিশ, বক্তাদের ওপর কর আরোপের প্রস্তাব