X
বুধবার, ০৮ মে ২০২৪
২৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশে আসার আগে এত অধিকারের কথা জানতো না রোহিঙ্গারা!

আমানুর রহমান রনি
২৭ আগস্ট ২০১৯, ১০:০৬আপডেট : ২৭ আগস্ট ২০১৯, ১৬:০৩

২৫ আগস্ট কক্সবাজারে সমাবেশ করেছে রোহিঙ্গারা, ছবি: বিবিসি

বাংলাদেশে আসার আগে এত অধিকারের কথা জানা ছিল না মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা মিয়ানমারে কাজ করলেও সেখানে সংগঠিত হয়ে সভা, সেমিনার, মানববন্ধন ও প্রতিবাদ করার কোনও সুযোগ পায়নি তারা। কিন্তু বাংলাদেশে আসার পর রোহিঙ্গারা তাদের দাবি-দাওয়ার বিষয়ে ব্যাপক সোচ্চার হয়েছে। বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে নিজেদের অধিকার, আন্দোলন ও নাগরিকত্ব হারানোর বিষয়ে কথা বলার সময় টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে নেতৃত্বদানকারী একাধিক নেতা এসব তথ্য জানিয়েছেন।

রোহিঙ্গা নেতারা জানান, রাখাইনে জাতিগতভাবে বন্দি অবস্থার মধ্যে যুগের পর যুগ তারা পার করেছেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে ছিল না তাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি। নিজ দেশে নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে যাতায়াতের ওপরে ছিল কড়া বিধিনিষেধ। রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকদের যে অধিকার রয়েছে, সে বিষয়ে তাদের কোনও ধারণাই ছিল না। তারা ছিল সব ধরনের নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত মানুষ।

এই নেতারা বলেন,মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংস হামলার পর বাংলাদেশে এসে রোহিঙ্গারা গত দুই বছরে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায়  নাগরিক অধিকারের বিষয়ে সচেতন হয়েছে। এ কারণেই তারা নাগরিক অধিকার নিশ্চিত হওয়ার পর মিয়ানমারে ফিরতে চায়।

উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৮২ সালের বার্মিজ নাগরিকত্ব আইন অনুসারে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। এরপর থেকে তাদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়। সকল নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। রোহিঙ্গার পরিবর্তে তাদের শরণার্থী বলা শুরু হয়। প্রতিবছর রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর সদস্যদের গণনার পর গ্রুপ ছবি তুলে প্রত্যেকটি পরিবারকে কার্ড দিতো মিয়ানমার সরকার। ছবি ও কার্ডে থাকা ব্যক্তিরাই কেবল এক পরিবারের সদস্য বলে স্বীকৃতি পেতো। এর বাইরের কোনও লোক পরিবারে এলে  তার ওপরে চলতো নির্যাতন। প্রতিমাসে পুলিশ স্টেশনে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের তথ্য দিয়ে আসতে হতো।

২০১৭ সালের আগস্টে মংডুর ৮ কিলোমিটার উত্তরের রোহিঙ্গাদম এলাকা থেকে টেকনাফে আসেন বদলুল আলম। তিনি তার পরিবারের ৯ সদস্য নিয়ে আশ্রয় নেন টেকনাফের শালবন রোহিঙ্গা শিবিরে। তিনি এখন ওই শিবিরের চেয়ারম্যান বা মাঝি। বদলুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল হওয়ার পরও আমি নাগরিক ছিলাম। কিন্তু তারপরও রোহিঙ্গা ও মুসলিম পরিচয়ের কারণে রাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনও সুযোগ-সুবিধা পেতাম না। রাষ্ট্র নাগরিকদের কী কী সুবিধা দেয়, রোহিঙ্গারা তাও জানতো না।’

তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা আসলে তাদের অধিকারের কথা জানতোই না। কারণ, শিক্ষা, চিকিৎসা, চলাফেরা সবকিছুতেই সেখানে তারা ছিল নিয়ন্ত্রিত। তাই তাদের কোনও কিছু জানার সুযোগ ছিল না। যাদের টাকা পয়সা ছিল, তারা এসএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করতে পারতো। মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা এর বেশি পড়াশোনা করতে পারে না।’

বদলুল আলম বলেন, ‘আমার দাদা, মা-বাবা সবাই সে দেশের নাগরিক। আমাদের জায়গা জমির দলিল রয়েছে। সেসবে নামও রয়েছে। তারপরও আমরা অধিকার বঞ্চিত।’

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্যমতে, ১৯৮২ সালের আইনে রোহিঙ্গাদের জাতীয়তা অর্জনের সম্ভাবনা কার্যকরভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ইতিহাসের সন্ধান পাওয়া সত্ত্বেও বার্মার আইন এই সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে জাতীয় নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। এছাড়াও তাদের আন্দোলনের স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় শিক্ষা এবং সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করা হয়।

টেকনাফের জাদুমুরা এলাকার ক্যাম্পে আত্মীয়-স্বজনসহ ১৫৯ জনকে নিয়ে আশ্রিত হয়ে আছ্নে মো. একরাম। তিনি এই ক্যাম্পের সহকারী মাঝি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলা ট্রিবিউনকে একরাম বলেন, ‘বাবা-মা, চাচা-চাচিসহ আমরা ১৫৯ জন এই ক্যাম্পে থাকি। আমার দাদা মিয়ানমারের নাগরিক ছিলেন। সেই কার্ডও আমাদের আছে। কিন্তু নাগরিক আইন পরিবর্তন করার পর বাবা ও চাচার আমল  থেকে আর নাগরিকত্ব পাইনি। আমরা চাষাবাদ ও ছোটখাটো ব্যবসা করে চলতাম। আট ভাই ও দুই বোনের আমরা কেউ লেখাপড়া করতে পারিনি। রোহিঙ্গাদের লেখাপড়ার কোনও সুযোগ নেই। মংডুসহ কিছু শহুরে রোহিঙ্গার সন্তানরা লেখাপড়া করে, তাদের টাকা পয়সা অনেক।’

তিনি বলেন, ‘আমরা জীবন নিয়ে চিন্তা করতাম বেশি। তাই সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে চিন্তা করার সুযোগ ছিল না। এখন আমরা সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না হলে ফিরবো না।’

মিয়ানমারে থাকাকালে রোহিঙ্গারা তাদের অধিকারের বিষয়ে সরকারের কাছে কখনও দাবি তুলতো কিনা, জানতে চাইলে মো. একরাম বলেন, ‘সেখানে বসে মানুষ এতো কিছু বুঝতো না। তাই কেউ কোনও কথা বলতো না। এখন আমরা অধিকারের বিষয় বুঝতেছি। আমাদের অধিকার না থাকলে সেখানে গিয়ে কোনও লাভ নেই। বাড়ি থাকলেও সেখানে আমাদের যেতে দেবে না। ক্যাম্পে রাখবে, তাহলে সেখানে গিয়ে লাভ কী?’

মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা ১৯৭৮, ১৯৯১-১৯৯২, ২০১২, ২০১৫, ২০১৬ এবং সর্বশেষ ২০১৭ সালে সামরিক নির্যাতন এবং দমন-পীড়নের শিকার হয়েছে। জাতিসংঘ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ রোহিঙ্গাদের ওপরে চালানো দমন ও নির্যাতনকে জাতিগত নির্মূলতা হিসেবে অভিহিত করেছে।

রোহিঙ্গারা বলছেন, তারা পশ্চিম মিয়ানমারে অনেক আগে থেকে বসবাস করে আসছেন। তাদের বংশধররা প্রাক-উপনিবেশিক ও উপনিবেশিক আমল থেকে আরাকানের বাসিন্দা ছিলেন। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে নির্যাতন শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত রোহিঙ্গারা আইনপ্রণেতা ও সংসদ সদস্য হিসেবে দেশটির সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তবে তাদের অনেকেই এখন বেঁচে নেই। একজন বেঁচে আছেন, তিনি আমেরিকায় থাকেন। সেখানে বসে রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে কাজ করে যাচ্ছেন।

রোহিঙ্গা তরুণ মো. ইউনুস আরমান। তিনি কুতুপালং নিবন্ধিত ক্যাম্পে থাকেন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন।বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি  বলেন, ‘রোহিঙ্গারা একসময় মিয়ানমারের নাগরিক ছিল। ভোট দিতো। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা তাদের ছিল। তবে তাদের সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গারা তা বুঝতে পারলেও প্রতিবাদ করার সুযোগ ছিল না। কারণ, প্রতিবাদ করলেই তাদের নির্যাতন করা হতো। অনেককে জেলে দেওয়া হয়েছে। আমাদের প্রায় এক লাখ মানুষ এখনও মিয়ানমারের কারাগারে আছে। তাই ভয়ে অধিকার নিয়ে কোনও রোহিঙ্গা কথা বলতো না। এখন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই অধিকার আদায়ে সোচ্চার রোহিঙ্গারা।’

 

/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
স্টার্টআপ বাংলাদেশের সঙ্গে এশিয়াটিক মাইন্ডশেয়ার ও উইন্ডমিলের চুক্তি
স্টার্টআপ বাংলাদেশের সঙ্গে এশিয়াটিক মাইন্ডশেয়ার ও উইন্ডমিলের চুক্তি
হজ কার্যক্রমের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
হজ কার্যক্রমের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
মতলব উত্তরে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার মৃত্যু
মতলব উত্তরে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার মৃত্যু
বিচ্ছেদ নয়, যে কারণে বিয়ের ছবি মুছলেন রণবীর
বিচ্ছেদ নয়, যে কারণে বিয়ের ছবি মুছলেন রণবীর
সর্বাধিক পঠিত
ব্যারিস্টার সুমনকে একহাত নিলেন চুন্নু
ব্যারিস্টার সুমনকে একহাত নিলেন চুন্নু
শেখ হাসিনাই হচ্ছেন ভারতে নতুন সরকারের প্রথম বিদেশি অতিথি
শেখ হাসিনাই হচ্ছেন ভারতে নতুন সরকারের প্রথম বিদেশি অতিথি
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি, বিএনপির প্রস্তুতি কী?
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি, বিএনপির প্রস্তুতি কী?
গ্রাম আদালত বিল পাস, জরিমানা বাড়লো চার গুণ
গ্রাম আদালত বিল পাস, জরিমানা বাড়লো চার গুণ
কেমন আছেন মিল্টনের আশ্রমে আশ্রিতরা
কেমন আছেন মিল্টনের আশ্রমে আশ্রিতরা