X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

মে হবে আরও ভয়ঙ্কর!

জাকিয়া আহমেদ
০১ মে ২০২০, ২০:০৮আপডেট : ০২ মে ২০২০, ১৩:০৯

করোনা পরীক্ষা দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। সে মাসে মোট শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ৫১ জন। এপ্রিলে শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় সাত হাজার ৬১৬ জনে। গত কয়েক দিনে প্রতিদিনই নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে চার-পাঁচশ বা তারও বেশি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিদিন যে হারে পরীক্ষা হচ্ছে সেটাও যথেষ্ট নয় এবং এটা পুরো দেশের চিত্রও নয়। এখনও দেশ সংক্রমণের চূড়ায় নয়। পরীক্ষা সংখ্যা বাড়ালে এবং সাধারণ ছুটি শিথিল করে আনা হলে মে মাসে অবস্থা আরও ভয়ঙ্কর হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী ১৪ দিন কঠিন সময়। তাই ভীষণ সতর্কতা নিয়ে পরিকল্পিতভাবে পার করতে হবে। যদি সেটা না হয় তাহলে সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যু এবং রোগী দুটোই দেখা যাবে মে মাসে।

গত ৮ মার্চ প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ৮ এপ্রিল পর্যন্ত এক মাসে শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ২১৮ জন। এরপর রোগী বাড়তে থাকে। ১৮ এপ্রিল রোগী শনাক্ত হয় ৩০৬ জন। এরপর সংখ্যা শুধুই বেড়েছে। ২০ এপ্রিল ৪৯২ জন, ২৪ এপ্রিল ৫০৩ জন, ২৮ এপ্রিল ৫৪৯ জন এবং গত ২৯ এপ্রিল ৬৪১ জন। তবে ৩০ এপ্রিল শনাক্ত হওয়া রোগী সংখ্যা তার আগের দিনের চেয়ে কমে দাঁড়িয়েছিল ছিল ৫৬৪ জন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে জানান, আগামী ৩১ মে পর্যন্ত ৪৮ হাজার থেকে ৫০ হাজার মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন এবং মারা যেতে পারেন ৮০০ থেকে এক হাজার মানুষ। গত ২১ এপ্রিল করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও প্রতিকারে গৃহীত কার্যক্রম পর্যালোচনা এবং পরবর্তী করণীয় বিষয়ে আন্তমন্ত্রণালয় সভায় তিনি এ তথ্য জানান।

জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কোনও মডেলিংই প্রকৃতপক্ষে বাস্তবের সঙ্গে মেলে না। কিন্তু মডেলিং করা হয় প্রস্তুতিতে সাহায্য করার জন্য। তবে মে মাসের মাঝামাঝিতে করোনার ‘পিক টাইম’ দেখা দিতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন ডা. আলমগীর।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরুতে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) কোভিড-১৯-এর নমুনা পরীক্ষা করা হলেও বর্তমানে দেশে পরীক্ষা হচ্ছে ২৮টি ল্যাবরেটরিতে। এরমধ্যে রাজধানী ঢাকায় ১২টি ও ঢাকার বাইরে ১৬টি প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি তিনটি হাসপাতালকে করোনা পরীক্ষার জন্য অনুমতি দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। যদিও এই হাসপাতালগুলো কেবল তাদের ভর্তি হওয়া রোগীদের পরীক্ষা করাতে পারবে।

সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইন (এসইউটিডি)-এর ডেটা ড্রাইভেন ইনোভেশন ল্যাবের গবেষকরা পূর্বাভাস দিয়েছেন, মে মাসে বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ ৯৯ শতাংশ কমে যেতে পারে। তবে বাংলাদেশ থেকে ভাইরাসটির পুরোপুরি বিদায় নিতে সময় লাগতে পারে ১৫ জুলাই পর্যন্ত। আর সারা বিশ্ব থেকে করোনা পুরোপুরি বিদায় নিতে পারে ৮ ডিসেম্বরের মধ্যে। যদিও এরসঙ্গে একমত নন বাংলাদেশি চিকিৎসকরা।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘লকডাউন শিথিল করলে রোগী সংখ্যা বেড়ে যাবে। কিন্তু লকডাউন লম্বা করে দেওয়া হলে কেসগুলোকে সেটেল ডাউন করে ডিলে করে দেওয়া হবে। এভাবে যদি ডিলে করে দেওয়া হয় তাহলে আর সংক্রমণের চূড়ায় না যাওয়া হলেও এ পরিস্থিতি চলতে থাকবে।’ সিঙ্গাপুরের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে একমত নন অধ্যাপক রোবেদ আমিন।

দেশের ২৮টি জায়গায় নমুনা পরীক্ষা হলেও প্রত্যন্ত অঞ্চল, উপজেলা এবং অনেক জেলায়ও পরীক্ষা করানো যাচ্ছে না মন্তব্য করে অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, ‘তাহলে পুরো দেশের চিত্র তো এখনও আমরা পাচ্ছি না। বাংলাদেশে আসলে মোট কতজন আক্রান্ত সেটা এখনও আমরা জানি না। কেবল পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে একটা অঙ্ক করে যাওয়া হচ্ছে।’

‘চীনের উহানের চেয়ে ঢাকার অবস্থা খারাপ মনে হচ্ছে’ মন্তব্য করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘মানুষ লকডাউন মানছে না। ঢাকা শহরের সংক্রমিত মানুষের হার এর সঙ্গে মেলালেই সেটা বোঝা যায়।’

চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানী ও গবেষক আতিক আহসান বলেন, ‘মে মাস আমাদের জন্য ভালো কিছু আনবে না। খারাপ যা হতে পারে সেটা মে মাসের মধ্যেই দেখবো। এর পরে ধীরে ধীরে রোগীর সংখ্যা কমতে শুরু করবে।’

মে হবে আরও ভয়ঙ্কর! তিনি বলেন, ‘সারা দেশে রোগী ছড়িয়েছে এবং সবাইকে শনাক্ত করা যায়নি। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে রোগী বাড়বে একথা আগেই বলা হয়েছিল। সে অনুযায়ী মধ্য এপ্রিল থেকেই রোগী বাড়তে থাকে। আর অন্যান্য দেশের ট্রেন্ড বলছে, রোগী বাড়তে শুরু করলে সেটা ৩০ দিন পর্যন্ত বেড়েই যায়, তবে আমাদের দেশে এই ৩০ দিনের সঙ্গে অন্য রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে সাধারণ ছুটি শিথিল, পোশাক কারখানা এবং রেস্টুরেন্ট খুলে দেওয়ার কারণে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ সর্বোচ্চ রোগী বা পিক টাইমটা দেখা যাবে। সেটা রোগী শনাক্ত এবং মৃত্যু- দুই ক্ষেত্রেই। তাই মে মাস আমাদের জন্য ভয়ঙ্কর। তবে আশার কথা, তার পরের মাস থেকেই রোগী কমতে শুরু করবে।’

বর্তমানে যেভাবে রোগী প্রতিদিন রিপোর্ট হচ্ছে তাতে সংক্রমণটা নিয়ন্ত্রণে নেই মন্তব্য করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বেনজির আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বর্তমানে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ব্যবস্থা রয়েছে সেটা যথেষ্ট নয়। লকডাউন যদি ধীরে ধীরে তুলে নেওয়া হয় তাহলে সংক্রমণ বাড়বে এবং বাড়তেই থাকবে। পুরো মে মাসেই সংক্রমণ হতেই থাকবে।’

লকডাউন শিথিল নিয়ে প্রশ্ন

রোগীর সংখ্যা যখন ক্রমাগত বাড়ছে তখন দেশের সাধারণ ছুটি তুলে নিয়ে পোশাক কারখানা, দূরপাল্লার ট্রেন চলাচলের ভাবনা, রেস্টুরেন্ট খুলে দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, লকডাউন তুলে নেওয়ার ধাপ না মানা হলে বড় মূল্য দিতে হতে পারে। চীন প্রথমে ব্যবস্থা নেয়নি বলে পরে তাদের কঠোরতম ব্যবস্থায় যেতে হয়েছে। ইতালিকে আরও বেশি মূল্য দিতে হয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রকে আরও অনেক বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি কোথায় যাবে সেটা বলা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও লকডাউনের বিষয়ে যদি উদাসীনতা দেখানো হয়, তাহলে তার মূল্য কত বেশি দিতে হবে সেটা বলা মুশকিল এবং নিশ্চয়ই সেটা শঙ্কার বিষয়।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বেনজির আহমেদ বলেন, ‘রোগী সংক্রমণ ঠেকানোর একমাত্র এবং কার্যকর পন্থা ছিল কঠোর লকডাউন, সেটা ঢাকার বাইরে এবং ঢাকার ভেতরেও। লকডাউন না তুলে নেওয়াই উচিত। কলকারখানা যেভাবে খুলে দেওয়া হচ্ছে সেখান থেকে সরে আসা উচিত। সাধারণ মানুষের কাছে সিগন্যাল যাচ্ছে, লকডাউন প্রত্যাহার করা হচ্ছে এবং বাইরে চলাচল করা যায়- এ ভাবনা অশনি সংকেত। এটা শঙ্কার নির্দেশনা দেয়। লকডাউন যদি খুলতেই হয় তাহলে পরিকল্পিতভাবে সেটা করতে হবে। একইসঙ্গে কারখানা কর্মীদের তালিকা করে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে যারা এ থেকে মুক্ত, তাদের বাসা থেকে কারখানায় যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে অন্য কারও থেকে তাদের মধ্যে সংক্রমণ না ঘটে।’

অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জে গার্মেন্টস কারখানা খুলে গেছে, তার জন্য আলাদা টাস্কফোর্স করতে হবে। কোথাও যদি কোনও ব্যত্যয় পাওয়া যায়, তাহলে সে পোশাক কারখানা লকডাউন করে দিতে হবে। এসব পোশাক কারখানার কর্মীদের জন্য রেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। এসব কর্মীর প্রতিদিন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে এবং কারও কোনও সমস্যা হলে তাকে কোয়ারেন্টিনে পাঠাতে হবে। এটা মানতে হবে। কোয়ারেন্টিন শেষে তাদের আবার পরীক্ষা করে কারখানায় কাজ করতে দিতে হবে।’
এদিকে, লকডাউন তুলে দেওয়ার কতগুলো ধাপ রয়েছে জানিয়ে অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, ‘অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেসব ধাপ ফলো করা হচ্ছে না। আর এ ধাপ মানা না হলে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন অনেক বেশি হবে এবং মে মাসে অনেক বেশি রোগী হবে। মে মাসে আমরা সমস্যাতে থাকবো’

তিনি বলেন, ‘পোশাক কারখানাগুলোতে পরীক্ষা করে কারখানায় প্রবেশ করাতে হবে। একজনও পরীক্ষার বাইরে থাকা মানেই ঝুঁকিতে থাকা। তাদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে রেখে গ্রুপ ধরে কাজ করাতে হবে, নয়তো হবে না।’

একই কথা বলেন আতিক আহসান। রোগীর সংখ্যা কত হবে সে বিষয়টি নির্ভর করছে লকডাউন কতটা শিথিল হবে মন্তব্য করে গবেষক আতিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি না মেনে পোশাক কারখানা খুলে দেওয়া মানে সাধারণভাবে রোগী যা হওয়ার কথা, তার দ্বিগুণ বেড়ে যাবে।’

গ্রাফ: আতিক আহসান

/এফএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ঘরের মাঠে পিএসজিকে হারিয়ে এগিয়ে থাকলো ডর্টমুন্ড
চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনালঘরের মাঠে পিএসজিকে হারিয়ে এগিয়ে থাকলো ডর্টমুন্ড
ইজিবাইক ছিনতাইয়ের সময় স্থানীয়দের পিটুনিতে একজনের মৃত্যু
ইজিবাইক ছিনতাইয়ের সময় স্থানীয়দের পিটুনিতে একজনের মৃত্যু
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শ্রমিকরাও অংশীদার হবে: এমপি কামাল
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শ্রমিকরাও অংশীদার হবে: এমপি কামাল
মোস্তাফিজের শেষ ম্যাচে চেন্নাইয়ের হার
মোস্তাফিজের শেষ ম্যাচে চেন্নাইয়ের হার
সর্বাধিক পঠিত
শিশু ঝুমুরকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ মুছলেন র‌্যাব কর্মকর্তা
শিশু ঝুমুরকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ মুছলেন র‌্যাব কর্মকর্তা
মিল্টন সমাদ্দার আটক
মিল্টন সমাদ্দার আটক
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা
সিয়াম-পরীর গানের ভিউ ১০০ মিলিয়ন!
সিয়াম-পরীর গানের ভিউ ১০০ মিলিয়ন!