X
বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪
২৫ বৈশাখ ১৪৩১

যুক্তরাষ্ট্রে রাশেদ চৌধুরীর পক্ষে দেওয়া রায় সংশোধনের সুযোগ এসেছে: ড. মিজানুর রহমান

শেখ শাহরিয়ার জামান
০৫ আগস্ট ২০২০, ১১:২০আপডেট : ০৫ আগস্ট ২০২০, ২০:০২

ড. মিজানুর রহমান

‘বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন বোর্ড যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেটিকে তখন চ্যালেঞ্জ করা হলেও ভুল প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার। ২০০৪ এবং ২০০৬ সালে সেদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস যে ভুলটা করেছিল, ১৫ বছর আগের সেই ভুল সংশোধনের এখন সুযোগ এসেছে’, বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক প্রধান মিজানুর রহমান।

জানা গেছে, ২০০৪ সালের ৩১ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন বোর্ড রাশেদ চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন মঞ্জুর করলে এর বিরুদ্ধে আপিল করে ওই দেশের সরকার। ২০০৬ সালের ২৯ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রানসিসকো অভিবাসন কোর্ট রাশেদ চৌধুরীর পক্ষে রায় দেয় (রায়ের কপি বাংলা ট্রিবিউনের কাছে আছে)।

কোনও ব্যক্তি রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করলে সেটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া রাষ্ট্রের অধিকার। কিন্তু যদি রাষ্ট্র মনে করে যে, ভুল কারণে এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তবে সেটি তারা বাতিল করতে পারে বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক মিজানুর রহমান।

রাশেদ চৌধুরীর মামলার রায়টি খুবই ইন্টারেস্টিং জানিয়ে মিজানুর রহমান বলেন, ‘যে পরিমাণ খুঁটিনাটি বিষয় বিবেচনা করে কোর্ট রায় দিয়েছে, সেটি দেখে বোঝা যায় তাদের ম্যাচিউরিটি লেভেল অনেক বেশি।’

রাশেদ চৌধুরীর মামলার রায় বিশ্লেষণ করে মিজানুর রহমান বলেন, ‘২০০৪ এবং ২০০৬ সালে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস যে ভুলটা করেছিল, সেটির সংশোধনের সুযোগ এসেছে। সেই সময়ে তাদের কাছে যথেষ্ট তথ্য হয়তো ছিল না বা পুরো প্রস্তুতি নিয়ে মামলাটিতে লড়েনি। এখন মনে হচ্ছে, তারা পুরো প্রস্তুতি নিয়ে নামছে এবং যুক্তিতর্কগুলো উপস্থাপন করার সুযোগ আছে।’

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের যত ভুল

রাশেদ চৌধুরীকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে অভিবাসন বোর্ড যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করা হলেও ভুল প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার। এর জন্য প্রস্তুতির অভাব এবং পর্যাপ্ত প্রমাণাদি না থাকাকে দায়ী করেছেন ড. মিজানুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘কোর্টের কাছে যে তথ্য এবং যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে কোর্ট রায় দিয়েছে।’

রাশেদ চৌধুরী সন্ত্রাসী কিনা, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর কিনা, ইমডেমনিটি আইন, রাজনৈতিক অপরাধ, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ ইত্যাদি অনেক বিষয়ে কোর্টকে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তার পক্ষে রায় গেছে বলে মনে করেন মিজানুর রহমান। 

তিনি বলেন, ‘কোর্টে যে বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়েছিল সেগুলো হচ্ছে—রাশেদ চৌধুরী সন্ত্রাসী কিনা এবং সন্ত্রাসী হলে  যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তিনি ক্ষতিকর কিনা।’

এর বিপক্ষে পাল্টা যুক্তি দিতে সরকারের আইনজীবীরা ব্যর্থ হয়েছেন জানিয়ে ড. মিজান বলেন, ‘এখন অ্যাটর্নি জেনারেল বলতে চাইছেন যে, ওই সময়ে কোর্ট ও ইমিগ্রেশন বোর্ড যে তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটি ঠিক হয়নি এবং বোর্ড তখন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

এখন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ডকে ভিন্নভাবে দেখতে চাইছে এবং রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার সুযোগকে সীমিত করতে চাইছে জানিয়ে অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘অ্যাটর্নি জেনারেল এখন মনে করছেন—রাশেদ চৌধুরী একজন সন্ত্রাসী এবং ১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ড গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য করা হয়নি বরং হত্যাকারীদের নিজেদের স্বার্থের জন্য করা হয়েছে।’

এই আইন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘অভিবাসন বোর্ড যখন রাশেদের পক্ষে সিদ্ধান্ত দিয়েছিল, তখন তারা বলেছিল—১৯৭৫ এর হত্যাকাণ্ড করা হয়েছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু এর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন তখন বলতে পারেনি, কোথায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলো। কারণ, ১৯৭৫ সালের পরের ১৫ বছর বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘এর বিরুদ্ধে শক্ত কোনও যুক্তিতর্ক তারা দেখাতে পারেনি।’

ইমডেমনিটি আইন বিষয়ে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, এটি সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে সংসদে বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের আইনজীবীরা বলেননি, ইমডেমনিটি আইন করার মাধ্যমে একটি হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এবং এটি যুক্তরাষ্ট্রের আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

ড. মিজান বলেন, ‘ইমডেমনিটি আইনটি যে একটি খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয়েছে—এটি প্রমাণের পক্ষে যুক্তিতর্ক দেওয়া হয়নি।’

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু কোনও জাতীয় দাবি ছিল না এবং এটি যে গুটি কয়েক সেনা কর্মকর্তার উচ্চাভিলাষ পরিকল্পনা ছিল—এটি যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি আইনজীবীরা ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পারেননি বলে জানান ড. মিজান।

নতুন করে তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করলে অগের রায় পরিবর্তন হতে পারে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মামলা চলাকালীন সময়ে প্রমাণাদি না থাকার কারণে যে রায় হয়, পরবর্তীতে প্রমাণাদি উপস্থাপন করলে রায় পরিবর্তন হতে পারে।’

রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব কিনা

যুক্তরাষ্ট্র থেকে রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন অধ্যাপক মিজানুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘‘১৯৯৬ সালে বজলুল হুদা যখন  থাইল্যান্ডে ধরা পড়েছিল, তখন তৎকালীন আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু আমাকে ডেকেছিলেন এবং বললেন, ‘আমাদের সাহায্য করতে হবে।’ কারণ, হুদা ওই সময়ে দাবি করছিল যে, ১৯৭৫ সালের ঘটনা রাজনৈতিক অপরাধ এবং এ কারণে তাকে ফেরত দেওয়া যাবে না।’’

মিজান বলেন, ‘আমি তখন একদল  ছাত্র নিয়ে একটি গবেষণা করেছিলাম। তখন বড় শক্তিগুলোর দূতাবাসে গিয়েছিলাম। তাদের কাছে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তারা যে প্রত্যাবর্তন চুক্তি করেছে, তার কপি চাইলাম গবেষণার জন্য।’

তিনি বলেন, ‘বেশ কয়েকটি চুক্তি বিশ্লেষণ করার পর দেখলাম, ১৯৮৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইটালির মধ্যে প্রত্যাবর্তন চুক্তিতে বলা হয়েছে—‘রাজনৈতিক অপরাধীরা এই চুক্তির বাইরে থাকবে। তবে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানের হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না এবং এটি ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। তাদেরকে প্রত্যাবর্তন করা যাবে। ১৯৮৬ সালে একই ধরনের প্রভিশন রেখে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে প্রত্যাবর্তন চুক্তি করা হয়।’

ড. মিজান আরও বলেন, ‘আমার সেই গবেষণা প্রতিবেদন আইন মন্ত্রণালয়কে দিয়েছিলাম। এই যুক্তিতর্কের ওপর বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস থাইল্যান্ডের সঙ্গে প্রত্যাবর্তন চুক্তি করে এই প্রভিশন রেখে। পরবর্তীতে বজলুল হুদাকে থাইল্যান্ড থেকে দেশে ফেরত আনা হয়।’

রাশেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করতে পারে, অথবা সে মূল হোতা হতে পারে। কিন্তু যেহেতু রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সে জড়িত, সেজন্য এটি রাজনৈতিক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না এবং তাকে প্রত্যাবর্তন করা যেতেই পারে, বলে মনে করেন মিজানুর রহমান।

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কিশোরগঞ্জের তিন উপজেলায় বিজয়ী হলেন যারা
কিশোরগঞ্জের তিন উপজেলায় বিজয়ী হলেন যারা
কদমতলীতে গলায় ফাঁস লেগে দশ বছরের শিশুর মৃত্যু
কদমতলীতে গলায় ফাঁস লেগে দশ বছরের শিশুর মৃত্যু
জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত উৎসব শুরু আজ থেকে
জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত উৎসব শুরু আজ থেকে
আজিজ মোহাম্মদসহ ৯ জনের মৃত্যুদণ্ড চায় রাষ্ট্রপক্ষ, খালাসের দাবি আসামিপক্ষের
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যাআজিজ মোহাম্মদসহ ৯ জনের মৃত্যুদণ্ড চায় রাষ্ট্রপক্ষ, খালাসের দাবি আসামিপক্ষের
সর্বাধিক পঠিত
শনিবারে স্কুল খোলা: আন্দোলন করলে বাতিল হতে পারে এমপিও
শনিবারে স্কুল খোলা: আন্দোলন করলে বাতিল হতে পারে এমপিও
‘চুন্নু স্বৈরাচারের দোসর’, বললেন ব্যারিস্টার সুমন
‘চুন্নু স্বৈরাচারের দোসর’, বললেন ব্যারিস্টার সুমন
এক লাফে ডলারের দাম বাড়লো ৭ টাকা
এক লাফে ডলারের দাম বাড়লো ৭ টাকা
ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর ইস্যুতে ন্যাটোকে রাশিয়ার সতর্কতা
ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর ইস্যুতে ন্যাটোকে রাশিয়ার সতর্কতা
ইউক্রেনে পাঠালে ফরাসি সেনাদের নিশানা করার হুমকি রাশিয়ার
ইউক্রেনে পাঠালে ফরাসি সেনাদের নিশানা করার হুমকি রাশিয়ার