(বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ১৯৭৩ সালের ৩১ জানুয়ারির ঘটনা।)
বিশ্ব ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট বে জি ন্যাপ বলেছেন, স্বাধীনতার পর এত অল্প সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় অগ্রগতি সাধন করেছে। এনা বাসস পরিবেশিত এই খবরে বলা হয়, এ দিন (৩১ জানুয়ারি) বিকালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আধা ঘণ্টাব্যাপী এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের কাছে এ মন্তব্য করেন তিনি।
ন্যাপ বলেন, ‘বাংলাদেশের বিধ্বস্ত অর্থনীতি যতদূর পুনর্গঠিত হয়েছে, গত তিন বছরের যুদ্ধ-অনাবৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতি চরম প্রতিকূল অবস্থার কথা ধরলে, সত্যিই প্রশংসা করার মতো।’ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষ করে বেরিয়ে আসার পর অপেক্ষমান সাংবাদিকদের তিনি জানান, বাংলাদেশের যুদ্ধোত্তর সাধারণ অর্থনৈতিক অবস্থা ও যুদ্ধকালীন ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসিত করার জন্য গৃহীত প্রচেষ্টা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার অত্যন্ত ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তার কাছে এ সম্পর্কে এক বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরেন। ন্যাপ বলেন, ‘বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে, বাংলাদেশকে অগ্রগতির পথে প্রতিষ্ঠিত করতে আগ্রহী।’ বিশ্ব ব্যাংক যে পাঁচ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে, তা উল্লেখ করে তিনি এই আশ্বাস দেন যে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন হলে বিশ্ব ব্যাংক আরও ঋণ দেবে। বে জি ন্যাপ বলেন, ‘বাংলাদেশকে কৃষি, পানিসম্পদ, শিক্ষা, ক্ষুদ্র শিল্প প্রভৃতি জরুরি খাতে মূল্যবান সাহায্য দিতে পারে বিশ্বব্যাংক।’ বাংলাদেশকে তার প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনার আওতা ও পরিকল্পনায় নির্ধারিত অগ্রাধিকার অনুযায়ী তারা প্রয়োজনীয় সাহায্য দেবে উল্লেখ করে পরিশেষে তিনি আরও জানান যে, বিশ্বব্যাংকের হাতে যা আছে, তা থেকে বাংলাদেশকে সম্ভাব্য সর্বাধিক পরিমাণ সাহায্য দেওয়া হবে।
নির্বাচনের কর্মসূচি ঘোষণা
নির্বাচন কমিশনের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ১৯৭৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মনোনয়নপত্র জমা, ৬ ফেব্রুয়ারি জামানত জমা ও ৮ ফেব্রুয়ারি প্রার্থীর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। ৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে হবে। রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে এই মনোনয়নপত্র পাওয়া যাবে। প্রার্থী ও সমর্থক ব্যতীত অন্য কেউ মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারবেন না। বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয় যে, কোনও নির্বাচনি এলাকার ভোটার, পার্লামেন্ট সদস্য হওয়ার যোগ্য যে কোনও ব্যক্তি প্রস্তাবক কিংবা সমর্থক হতে পারবেন, অর্থাৎ প্রস্তাবককে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি এলাকার তালিকাভুক্ত ভোটার হতে হবে। একজন কেবলমাত্র একটি মনোনয়নপত্রের প্রস্তাবক অথবা সমর্থক হতে পারবেন। যদি কোনও ব্যক্তি একাধিক মনোনয়নপত্রের প্রস্তাবক ও সমর্থক হন, তাহলে সেই মনোনয়নপত্র বাতিল বলে ঘোষিত হবে। প্রত্যেক মনোনয়নের জন্য এক হাজার করে টাকা জামানত হিসেবে জমা দিতে হবে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় রিটার্নিং অফিসারের কাছে জামানত জমা দেওয়া যাবে। রিটার্নিং অফিসার টাকা জমা নিয়ে একটি প্রাপ্তি রশিদ দেবেন।
আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চের সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য দলীয় প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত করার উদ্দেশ্যে এক দিন বিরতির পর এদিন আবারও এক অজ্ঞাত স্থানে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি বোর্ডের অধিবেশন শুরু হয়। এনা পরিবেশিত খবরে বলা হয়, দুই-একদিনের ভেতরে আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হতে পারে। দুই হাজারের বেশি আবেদনকারীর মধ্য থেকে তিনশ’ দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের ব্যাপারে শহরের বাইরে কোনও এক স্থানে পার্লামেন্টারি বোর্ডের দীর্ঘ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ব ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের পর পরই দলের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণভবন থেকে অজ্ঞাত স্থানে যাত্রা করেন। চূড়ান্ত প্রার্থী মনোনয়নের জন্য ওই স্থানে তিনি পার্লামেন্টারি বোর্ডের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।
বঙ্গবন্ধু বাংলার পথ নির্দেশক
জাতীয় শ্রমিক লীগের উদ্যোগে আয়োজিত জনসভায় সংগঠনের অস্থায়ী সভাপতি আব্দুল হান্নান সভাপতিত্ব করেন। বক্তৃতা দেন আওয়ামী যুবলীগের আহ্বায়ক শেখ ফজলুল হক মনি, জাতীয় শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নানসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। বঙ্গবন্ধুর প্রতি অশালীন উক্তি, গণহত্যা, আসন্ন নির্বাচন, শিল্প উৎপাদন, কাঁচামাল সরবরাহ, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি, ওষুধ কেলেঙ্কারি, করপোরেশনগুলো পরিচালনা, পাট ও পাটজাত দ্রব্য রফতানিসহ চলমান বিভিন্ন ইস্যুতে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। শেখ ফজলুল হক মনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী আন্দোলন ও সশস্ত্র বিপ্লব গড়ে তুলে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে এনেছেন স্বাধীনতা। বাংলার মেহনতী মানুষকে নির্দেশ দেওয়ার অধিকার বঙ্গবন্ধুর রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, তা ভিক্ষালব্ধ নয়।’ জনগণকে সতর্ক করে দিয়ে মনি বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে নসাৎ করার চেষ্টা চলছে। এ বছরের গোড়ার দিকেই স্বাধীনতা নসাৎ করার চেষ্টা হয়।’
মনি আরও বলেন, ‘স্বাধীনতার সঙ্গে চক্রান্তের এই বহিঃপ্রকাশ গুপ্তহত্যা। চক্রান্তকারীরা জনগণের শান্তি বিঘ্নিত করতে চায়। এর বহিঃপ্রকাশ শ্রমিক হত্যা।’