(বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ১৯৭৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারির ঘটনা।)
জাতিসংঘ মহাসচিব কুট ওয়াল্ডহেইম বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার রাজনৈতিক সমস্যা, পারস্পরিক স্বীকৃতি, মানবিক প্রশ্ন, বেসামরিক লোক বিনিময় ও যুদ্ধবন্দি ইত্যাদি সমস্যার একটা সন্তোষজনক সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব ১৯৭৩ সালের এই দিনে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দুই ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা শেষে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার অত্যন্ত ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। উপমহাদেশের সমস্যা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বিভিন্ন সমস্যা অনুধাবনের পক্ষে এই আলোচনা অত্যন্ত সহায়ক হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। মহাসচিব বলেন, আলোচনা শেষে সর্বজনবিদিত একটা সন্তোষজনক সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।
বেগম মুজিবের সঙ্গে ওয়াল্ডহেইমের স্ত্রী
বেগম শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের আটক চার লাখেরও বেশি বাঙালির অপরিসীম দুঃখ-দুর্দশা ও মর্মান্তিক দুর্ভোগের কথা জানিয়ে ওয়াল্ডহেইমের স্ত্রীর কাছে তার মর্মবেদনা প্রকাশ করেন। এই দিন সন্ধ্যায় তার ধানমন্ডির বাসভবনে তিনি সাক্ষাৎ করতে এলে বেগম মুজিবুর রহমান তার এই উদ্বেগ ও মর্মবেদনা প্রকাশ করেন।
পাকিস্তানে আটক অসহায় বাঙালিদের উদ্ধারে তিনি জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের আবেদন জানান। বেগম মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তিনি প্রায় আধঘণ্টা আলোচনা করেন। পরে বাইরে এসে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আলোচনা সৌহার্দ্যপূর্ণ এবং ঘনিষ্ঠ হয়েছে।
সেদিন প্রতিবাদও ছিল
জাতিসংঘ মহাসচিব তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণের পর একদল নারী ভিআইপি লাউঞ্জে ও বিমানবন্দরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। আটক বাঙালিদের ফিরিয়ে আনার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন তারা। এ ব্যাপারে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য তারা জাতিসংঘ প্রধানের প্রতি আহ্বান জানান। নারীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আশ্বাস প্রদান করে মহাসচিব বাঙালিদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে জাতিসংঘ সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থা করবে বলে জানান। বিক্ষোভকারীরা ‘বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দাও’, ‘আটক বাঙালিদের ফিরিয়ে আনো’ ইত্যাদি লেখা পোস্টার বহন করছিলেন।
শ্রমিকদের প্রতি বঙ্গবন্ধু
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রামের আর আর জুটমিলের শ্রমিকদের কাজে পুনরায় ফিরতে ও শিল্প এলাকায় শান্তি বজায় রাখতে আহ্বান জানান। বিপিআইয়ের খবরে বলা হয়, এই দিনে প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনাকালে প্রধানমন্ত্রী তাদের আশ্বাস দেন, সরকার ইতোমধ্যে সংঘটিত ঘটনাটি গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেছে এবং যথাযথ তদন্ত কাজ শুরু হয়েছে। তিনি শ্রমিক প্রতিনিধিদের বলেন, অপরাধীদের অবশ্যই শাস্তি দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী পূর্ণ উদ্যমে কাজ শুরু এবং সর্বোচ্চ মাত্রায় উৎপাদন বৃদ্ধির নিশ্চয়তা বিধানে শ্রমিকদের প্রতি আহ্বানও জানান।
বাংলাদেশে আসার আগে ওয়াল্ডহেইম ভারত ও পাকিস্তানের সফর করেন এবং সেখানকার নেতাদের সঙ্গে উপমহাদেশের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উপমহাদেশের সমস্যাগুলো সমাধানের ব্যাপারে উভয়পক্ষেরই আন্তরিকতা লক্ষ করা গেছে। জাতিসংঘ প্রধান বলেন, এই উপমহাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ব্যক্তিগতভাবে দেখার জন্য তিনি সফরে এসেছেন। তিনি আরও বলেন, সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে সর্বপ্রথম বিশ্বাসের পরিবেশ সৃষ্টি করা গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে সকল সমস্যা সমাধানের জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর সদিচ্ছা রয়েছে উল্লেখ করে বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপারে জাতিসংঘের সম্ভব সাহায্য সম্পর্কেও তিনি ঢাকায় অবস্থানরত জাতিসংঘ অফিসারদের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
জাসদের অভিযোগের জবাব
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান এই দিন একটি বিবৃতি দেন। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সম্পাদক কর্তৃক নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারি হস্তক্ষেপ এবং প্রার্থী অপহরণের কিছু হাস্যকর অভিযোগের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বপ্রথম সাধারণ নির্বাচনে গণতন্ত্রের বিকাশের সুযোগ দেওয়ার পরিবর্তে অগণতান্ত্রিক পন্থায় প্রতিবাদী মনোভাব নিয়ে বিভিন্ন সুপরিকল্পিত মিথ্যা অভিযোগ এনে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চলছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু নয় মাসের মধ্যে সংবিধান উপহার দিয়ে গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল বলে জনগণের যাচাই করবার জন্য বাংলাদেশের জনসাধারণ এবং প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে নিয়ে নিজের জনপ্রিয়তা যাচাই করার সুযোগ দিয়েছেন। কিন্তু তা গ্রহণ না করে আগামী নির্বাচন বর্জন করার জন্য অনেকে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেন তিনি।