রাজধানী ঢাকায় আবারও শুরু হয়েছে প্রাইভেট সিএনজি অটোরিকশার (ধূসর রংয়ের) দৌরাত্ম্য। মিটার নেই, যাত্রী-পরিবহনের অনুমতিও নেই, তবু চলছে প্রতাপের সঙ্গে। ৮০ টাকার ভাড়া হাঁকছেন ২০০ টাকা। প্রাইভেট সিএনজির ড্রাইভারদের সাফ কথা, ‘পুলিশের কাছে নালিশ করে লাভ নেই। পুলিশকে মাসিক চাঁদা দিয়েই গাড়ি চালাই।’ কথা বলে জানা গেল, এই প্রাইভেট সিএনজি’র বড় একটি অংশের মালিকই হলেন পুলিশ সদস্যরা।
শুক্রবার দুপুর ১২টার একটু বেশি। তেজগাঁওয়ের লুকাস মোড়। সেখান থেকে পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতাল পর্যন্ত একজন সিএনজি চালক ভাড়া হাঁকলেন ২০০ টাকা। মিটারে না গিয়ে তিনি চুক্তিতে ভাড়া চাইছেন কেন—জানতে চাইলে জবাব দেন, ‘আমার সিএনজি প্রাইভেট।’ মিটার ছাড়া কোনও প্রাইভেট সিএনজিতে ভাড়ায় যাত্রীবহন তো বেআইনি—এর জবাবে তিনি বললেন, ‘মালিকের সঙ্গে পুলিশের মাসিক চুক্তি আছে। পুলিশের কাছে নালিশ করে কোনও লাভ হবে না।’
তারপরও ৮০ টাকার ভাড়া ২০০ টাকা চাইছেন কেন—ড্রাইভারের সাফ জবাব, ‘যাইলে যাইবেন, না যাইলে না যাইবেন।’
ততক্ষণে সেখানে হাজির হন আরও কয়েকজন ড্রাইভার। তাদের একজন ভালোভাবে বিষয়টি বুঝিয়ে দিলেন। তিনি জানালেন, ‘পুলিশ চাঁদা নেয় রুট-ভিত্তিক। আর সেই রুটের মধ্যেই চালাতে হয়। এর বাইরে গিয়ে চালাতে হলে আরও বেশি চাঁদা দিতে হয়। যেমন, লুকাস মোড় থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত মাসিক চাঁদা ৫০০ টাকা। আবার ফার্মগেট থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত মাসিক চাঁদা এক হাজার টাকা।’
তারা জানালেন, নভেম্বরের শুরুতে প্রাইভেট সিএনজির ব্যাপারে কড়াকড়ি করা হলে দুই-এক সপ্তাহ তারা কিছুটা ঝামেলায় ছিলেন। এরপর সব ঠিক হয়ে যায়। পুলিশের সঙ্গে আবার মাসিক চাঁদার ভিত্তিতে মালিকরা সমঝোতা করে ফেলেন।
কথা বলতে-বলতে আরও অনেক তথ্য বেরিয়ে এলো। মিটারযুক্ত অটোরিকশার (সবুজ রংয়ের) একজন চালক বললেন, ‘ঢাকা শহরে সাত হাজারের মতো প্রাইভেট সিএনজি চলে এখন। এরমধ্যে কমপক্ষে অর্ধেকের মালিক পুলিশ কর্মকর্তারা ( ট্রাফিক সার্জেন্ট)। এ সব অটোরিকশার দৌরাত্ম্যে আমরা কোণঠাসা। তাদের মিটার নেই রুট পারমিট নেই তারপরও তারা রাজা। কারণ, পুলিশের গাড়ি। তাই কয়েক সপ্তাহ মিটারে গাড়ি চালিয়ে হতাশ হয়ে এখন মিটারে চালাই না। মিটারে চালানো লোকসান।’
সাত হাজার প্রাইভেট অটোরিকশার হিসাব সঠিক ধরলে পুলিশ এসব অটোরিকশা থেকে মাসে প্রায় এক কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে।
আরেকজন ড্রাইভার লুকাস মোড়েই জানালেন নতুন এক তথ্য। তিনি বললেন, ‘এখন প্রাইভেট সিএনজি অটোরিকশাকে গোপনে বাণিজ্যিক লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। টাকা খরচ করলেই রং পাল্টে প্রাইভেট হয়ে যায় যাত্রী পরিবহন।’ এ কাজের জন্য কিভাবে লাইন-ঘাট কী—তাও প্রকাশ করলেন।
তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, চুক্তি করা প্রাইভেট সিএনটি অটোরিকশার ড্রাইভারের কাছে সংশ্লিষ্ট ট্রাফিক পুলিশ সার্জেন্ট-এর ফোন নম্বর থাকে। কোনও ঝামেলা হলে ফোন করলে তারাই ঝামেলা মিটিয়ে দেন।
এইসব অনিয়ম আর মাসিক চাঁদার ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক পূর্বজোনের পুলিশ উপ-কমিশনার (ডিসি) মাইনুল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রাইভেট সিএনজি অটোরিকশা পেলেই আমরা সেগুলোকে ধরছি, মামলা দিচ্ছি। পুলিশের কোনও সদস্য চাঁদার বিনিময়ে প্রাইভেট অটোরিকশাকে যাত্রী পরিবহনের সুযোগ করে দিচ্ছে বলে কোনও অভিযোগ আমরা পাইনি।’ আর পুলিশের মালিকানায় রাজধানীতে প্রাইভেট অটোরিকশা চলার অভিযোগও তিনি অস্বীকার করেন।
গত নভেম্বর থেকে সিএনজি অটোরিকশার নতুন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। আর মিটারে না চললে কঠোর শাস্তির কথা বলে বিআরটিএ। প্রাইভেট অটোরিকশা আইন অনুযায়ী ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করতে পারবে না বলেও জানানো হয়। কিন্তু বাস্তবে ভাড়া বাড়ানো ছাড়া আর কিছুই কার্যকর হয়নি।
/এইচইউআর/এসটি/এমএনএইচ/