পুরুষ সহকর্মীদের পাশাপাশি ২২ নারী সার্জেন্ট রাজধানীর বিভিন্ন ট্রাফিক সিগন্যালে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। যানজট নিরসনে তারা দিন-রাত পুরুষ সার্জেন্টের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছেন। মহানগরীর ব্যস্ততম এলাকা বনানী, গুলশান, মতিঝিল, কাওরান বাজার, বাংলামোটর ও বাড্ডায় তাদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।
মঙ্গলবার দুপুরে ট্রাফিক মতিঝিল জোনের ২৪ তলা পুলিশ বক্সের সামনে কথা হয় সার্জেন্ট তাজিলা খাতুনের সঙ্গে। সাতক্ষীরার মেয়ে তানজিলার স্বপ্নই সেবা। সেই স্বপ্ন থেকেই বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন তিনি। সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ ও ইডেন মহিলা কলেজ থেকে লেখাপড়া করেছেন তিনি। বাবা-মায়ের আট ভাইবোনের মধ্যে তানজিলা সবার ছোট।
তানজিলা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ছোটবেলা থেকেই পুলিশের ইউনিফর্মের প্রতি আকর্ষণ ছিল। যে ইউনিফর্ম পরে সব শ্রেণির মানুষকে সেবা দেওয়া সম্ভব। রাষ্ট্রপতি থেকে সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়া যায়। তাই এই পেশায় আসছি। এছাড়া বড় তিন বোনের স্বামীরাও পুলিশে রয়েছেন। তাদের কাছ থেকেও এই পেশায় আসতে উৎসাহিত হয়েছি।
দায়িত্ব পালন করতে কেমন লাগে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি হেসে বলেন, পেশাটাকে ভালোবেসেই বেছে নিয়েছি। তাই প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করি। সড়কে নিয়মশৃঙ্খলা বজায় রাখতে ভালোই লাগে।
গত একমাসেরও বেশি সময় ধরে ঢাকা মহানগরীতে দায়িত্ব পালন করে আসছেন ২২ নারী সার্জেন্ট। তানজিলা তাদের সবার আগে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি) যোগ দেন। এ নিয়ে তার গর্ববোধ হয়। তিনি বলেন, আমি ১৫ দিন আগে ডিএমপিতে যোগ দিয়েছি। এরপর অন্য নারী সার্জেন্টরা যোগ দিয়েছেন। সব নারী সার্জেন্টই দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। ডিএমপির ট্রাফিকের সিনিয়র কর্মকর্তারা আমাদের নারী সার্জেন্টদের প্রশংসা করছেন। এতে আমাদের খুব ভালো লাগে।
দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোনও তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে সার্জেন্ট তানজিলা বলেন, গণপরিবহনের চালকরা বিভিন্নভাবে চটুল কথা বলে থাকেন। এছাড়া, নারী সার্জেন্ট দেখে সবাই একটু তাকান। তবে, এসব বিষয় হ্যান্ডেলিং করার প্রশিক্ষণ আমাদের নেওয়া হয়েছে। এসব ছোটছোট কিছু বিষয় ছাড়া আর কোনও সমস্যা হচ্ছে না। এসবও আস্তে-আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।
পুরুষ সহকর্মীরা তাদের সহযোগিতা করছেন উল্লেখ করে তানজিলা বলেন, পুরুষ সার্জেন্টরা আমাদের সবকিছু শিখিয়ে দিচ্ছেন। কিভাবে মামলা করতে হবে? কেমন করে চালকদের সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে? তাদের সহযোগিতায় কাজ আরও সহজ হয়ে যাচ্ছে।
একই সময় সেখানে কর্তব্যরত অন্য নারী সার্জেন্ট পান্না আক্তারের সঙ্গে কথা হয়। পান্না আক্তারের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায়। বাবা খোরশেদ ফকির। তিনি ব্যবসা করতেন। ২০০৯ সালে তিনি মারা যান। মা গৃহিনী। তিনভাই ও তিনবোনের মধ্যে পান্না মেজো।
পান্ন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নারী সার্জেন্ট দেখে অনেকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু এসব আমরা পাত্তা দেই না। আমরা আমাদের কাজ করি। এসব এখন আর মাথায় আসে না।
ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করে পান্না আক্তার পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেছেন। তিনি বলেন, অনেকে ভাবেন, নারীরা তেলাপোকা দেখে ভয় পান, গাড়ি কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন? তবে আমরা আমাদের যোগ্যতা দিয়ে নিজেরে প্রমাণ করব।
তানজিলা ও পান্না রাজারাবাগ পুলিশ লাইনের নারী হোস্টেলে থাকেন। শৃঙ্খল জীবন ও সেবাদান নিয়েই তাদের ২৪ ঘণ্টা কাটে।
পুলিশ বাহিনীতে নারী সার্জেন্ট নিয়োগ-প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৪ সালে। সর্বশেষ সার্জেন্ট পদে নিয়োগের পরীক্ষায় অংশ নেন ১ হাজার ৮৩৭ জন। এর মধ্যে নারী প্রার্থী ছিলেন ৪৬ জন। সব প্রক্রিয়া শেষে নিয়োগ পান ২৮ জন। তারা রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে চলতি মাসে ২২ জন নিয়োগ পেয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশে। অন্যদিকে হাইওয়ে পুলিশ ২ জন, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে ২ জন এবং খুলনা মেট্রোতে ২ জন নারী দায়িত্ব পালন করছেন।
রাজধানীর কাকলি ক্রসিংয়ে দায়িত্বপালনকারী জামালপুরের মেয়ে সার্জেন্ট মোর্শেদা। তিনি বলেন, আগে নিজে যানজটের পড়তাম। এখন নিজেই যানজট নিয়ন্ত্রণ করছি। এটাই ভালো লাগে। এখন বুঝতে পারছি কী কারণে লেগে থাকে যানজট। তিনি বলেন, নারী বলে প্রথম প্রথম চালকরা পাত্তা দিত না। তবে অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। আমি পুরোপুরি নতুন। আমার সঙ্গে যারা কাজ করছেন, তারা অনেক সহযোগিতা করছেন। চ্যালেঞ্জ কোনটি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ি থামানোর কাজটি একটু বেশি চ্যালেঞ্জের মনে হয়।
রাজধানীর সোনারগাঁও মোড়ে দায়িত্ব পালনকারী সার্জেন্ট শিল্পী আক্তার বলেন, চ্যালেঞ্জ জেনেই এ পেশায় এসেছি। মাদারীপুরের মেয়ে শিল্পী আক্তার। পড়াশোনাও মাদারীপুরে।
মহাখালী ও আশপাশের এলাকায় দায়িত্ব পালন করছেন চুয়াডাঙ্গার মৌসুমি আহমেদ ও পঞ্চগড়ের জিনাত রেহানা। তারা দুজনই পড়েছেন ইডেন মহিলা কলেজে।
মৌসুমি বলেন, সার্জেন্ট হওয়ার পর বাড়ি গেলে লোকজন নারী পুলিশ দেখার জন্য আসেন। তাও খুব উপভোগ করি।
গুলশান ট্রাফিক জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার নুসরাত জাহান মুক্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নারী সাজেন্টরা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। আমিও গত এক বছর ধরে গুলশান জোনে ট্রাফিক কাজ করছি। নারী বলে কোনও সমস্যা হচ্ছে না।
পুলিশ সদর দফতরের নিয়োগ শাখা থেকে জানা গেছে, পুলিশ বাহিনীতে নারী পুলিশের নিয়োগ-প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৪ সালে। সর্বশেষ সার্জেন্ট পদে নিয়োগের পরীক্ষায় অংশ নেন ১ হাজার ৮৩৭ জন।এর মধ্যে নারী প্রার্থী ছিলেন ৪৬ জন। সব প্রক্রিয়া শেষে নিয়োগ পান ২৮ জন। রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে তারা প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে হাইওয়ে পুলিশে দুজন, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে দুজন এবং খুলনা মেট্রোতে দুজন নারী দায়িত্ব পালন করছেন। বাকি ২২ জন নিয়োগ পেয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশে।
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) খন্দকার গোলাম ফারুক নারী সার্জেন্টদের বিষয়ে বলেন, তারা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তাদের দায়িত্ব পালন পুলিশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জল করবে। আমি তাদের সাফল্য কামনা করছি।
ছবি: নাসিরুল ইসলাম।
/এমএনএইচ/
আপ-এসটি