নিজের ছবিতে বঙ্গবন্ধুর মুখ লাগিয়ে পোস্টার তৈরি ও তা টাঙানোর কারণে বিতর্কের মুখে পড়েছেন চট্টগ্রামের এমপি এম এ লতিফ। কিন্তু তিনি বিষয়টি গণমাধ্যমের কাছে পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন।
মঙ্গলবার বাংলা ট্রিবিউনের কাছেও তিনি দম্ভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘ওটা যে আমারই ছবি তার প্রমাণ কী’। তবে একদিন পরই প্রমাণ হয়েছে মূল ছবিটি তারই এবং তার ছবিতেই ফটোশপ করে বঙ্গবন্ধুর মুখ বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
লতিফের সেই আসল ছবি আমাদের হাতে এসেছে। যে ছবিতে দেখা যাচ্ছে ওই একই পোশাকে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।
ছবি বিকৃতির ঘটনায় লতিফ দাবি করেছিলেন, ‘অহেতুক বিতর্ক তৈরি করতে এসব কথা বলা হচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে মঙ্গলবার মোবাইলে ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করে কথা বললেও বুধবার সকাল থেকেই তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
মঙ্গলবার বাংলা ট্রিবিউনে বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে ছবিটি এমপি লতিফের কি না তা নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তবে যারাই এম এ লতিফকে কাছ থেকে দেখেছেন তারা মৌখিকভাবে স্বীকার করেছিলেন মূল ছবিটি লতিফের। তাতে শুধু বঙ্গবন্ধুর মুখ লাগানো হয়েছে। বুধবার লতিফের মূল ছবি বাংলা ট্রিবিউনের হাতে এসেছে।
একটি জনপ্রিয় পাক্ষিক পত্রিকার গ্রাফিক ডিজাইনার খন্দকার শফিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ফটোশপে যে কারও শরীরের সঙ্গে অন্য কারও মুখ-মাথা লাগিয়ে দেওয়া খুবই সহজ একটি কাজ। এটা নিখুঁতভাবেই করা যায়। এ বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছাড়া সাধারণ মানুষের পক্ষে বিষয়টি বোঝা একেবারেই অসম্ভব।’
এম এ লতিফের ছবি বিকৃতি প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের প্রবীণ নেতা মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম আসার আগে দেখলাম রাস্তার সব বিলবোর্ড সরিয়ে ফেলা হয়েছে। হঠাৎ দেখি, প্রায় আট থেকে দশ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে বঙ্গবন্ধুর লম্বা লম্বা ছবি এবং তার নিচে লতিফ সাহেবের বিভিন্ন বক্তব্য। মানুষজন বলতে লাগলো, বঙ্গবন্ধু কবে এই স্নিকার পরতেন, বঙ্গবন্ধু তো কখনও এই জুতো ব্যবহার করেন নাই। তখন ভালো করে দেখলাম, এটা লতিফেরই ছবি, তার মাথা সরিয়ে বঙ্গবন্ধুর মাথা বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে যখন চট্টগ্রাম আসেন তখন থেকে তাকে দেখেছি। ১৯৭২ সালে দেখেছি একেবারে সামনে থেকে, সঙ্গে থেকেছি বিভিন্ন জনসমাবেশে। সেই মানুষের দাঁড়ানোর ভঙ্গি এটা নয়।’
বঙ্গবন্ধু কখনও সালোয়ারের মতো পাজামা পরেননি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সবসময় ঢোলা পাজামা এবং খাটো ঝুলের পাঞ্জাবি পরতেন।’
খোরশেদ আলম সুজন আরও বলেন, ‘গতকাল যখন থেকে সংবাদ মাধ্যমে এই বিষয়ে প্রতিবেদন আসা শুরু হলো, তখন তাড়াহুড়ো করে এই ছবিগুলো নামানো শুরু করলো তার বাহিনী। কিন্তু সবশেষ ছবিটা ছিল চট্টগ্রাম চেম্বার অব কর্মাস ভবনের সামনে। সেটাও গতকাল রাতে সাংবাদিকরা ছবি তুলছিলেন বলে। নামিয়ে ফেলা হয়েছে।’
প্রবীণ এই নেতা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা, তার ছবি সংরক্ষণের জন্য আইন রয়েছে। অন্য জনের গলা কেটে সেখানে বঙ্গবন্ধুকে কেন স্থাপন করতে হবে এই জবাব লতিফকে দিতে হবে।’
সুজন বলেন, ‘হঠাৎ করে বাংলাদেশ পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। খালেদা জিয়া, গয়েশ্বর রায় সবাই ৩০ লাখ শহীদ নিয়ে কথা বলছেন। আর উনি (লতিফ) এখন পাকিস্তানি পাজামাওয়ালা বঙ্গবন্ধুকে সবার সামনে উপস্থাপন করলেন।’
তিনি ক্ষোভের সুরে বলেন, ‘এম এ লতিফ ২০০৮ এর ডিসেম্বরে জামায়াতের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়েছিলেন। তিনি জামায়াত নেতা এ কথা চট্টগ্রামবাসী সবাই জানে। জুতা পায়ে শহীদ মিনারে যাওয়ায় সাধারণ জনতা তাকে ধাওয়া দিয়েছিল এটাও চট্টগ্রামবাসী জানে।’
মূল ছবিটির প্রসঙ্গে যুদ্ধাপরাধী বিচার আন্দোলনের অন্যতম কর্মী সাগর লোহানী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যে ছবি পাওয়া গেছে, এরপর তার আর অস্বীকার করার কোনও সুযোগ নেই। এরপর কি আর কিছু বলার প্রয়োজন আছে? কত বড় ভণ্ড প্রতারক হলে সব কিছুকে উপর্যুপরি অস্বীকার করার ধৃষ্টতা দেখানো সম্ভব! এটাকে রুচিহীন বলারও কোনও উপায় নেই। কারণ এটি একটি জঘন্য প্রতারণা।’
সাগর লোহানী আরও বলেন, ‘যে কোনও প্রতারণার পেছনে একটি মোটিভ থাকে। তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে সেই উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা এবং এম এ লতিফ এমপিকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। যত দ্রুত সম্ভব এ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না যে, এই এমপি লতিফ জামায়াত থেকে আসা একজন হাইব্রিড আওয়ামী লীগার।’
বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতি প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা ও মানহানির মামলাও হতে পারে। তাছাড়া ক্ষতিপূরণ চেয়েও মামলা হতে পারে।’
উল্লেখ্য, আগামী ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৯৫ পাকিস্তানি সেনার প্রতীকী বিচার করার লক্ষ্যে গঠিত ‘আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ গণবিচার’ নামের সংগঠনটির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানের মঞ্চে সাংবাদিক আবেদ খানের পাশে বসেছিলেন এম এ লতিফ। তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম ১১ আসনের সংসদ সদস্য এবং বিদ্যুৎ-জ্বালানি ও খনিজসম্পদ, নৌ-পরিবহন ও পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য।
জামায়াত সংশ্লিষ্টতা ছাড়াও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে- মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক সেনাদের নির্যাতন কেন্দ্র চট্টগ্রাম ডালিম হোটেলের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী মাওলানা শামসুদ্দিনের কাছের লোক ছিলেন লতিফ।
আরও পড়ুন: লতিফের শরীরে বঙ্গবন্ধুর মুখ!
/এজে/
/আপ: এইচকে/