X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জগদীশচন্দ্র হালদারের স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু

রক্তিম দাশ, কলকাতা
২০ জুন ২০২২, ১০:৩২আপডেট : ২০ জুন ২০২২, ১০:৪৪

সমাজসেবার জন্য ২০২১ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পদ্মশ্রী সম্মান পেয়েছেন ডা. জগদীশ চন্দ্র হালদার। কিন্তু অনেকেই জানেন না তিনি ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পারিবারিক চিকিৎসক। ৭৪ বছর বয়সী এই চিকিৎসক এখন থাকেন কলকাতার অদূরে উত্তর ২৪ পরগনার পলতায়।

বাংলা ট্রিবিউনকে একান্ত সাক্ষাৎকারে ডা. জগদীশ চন্দ্র হালদার বলেন, ‘আমার বয়স এখন ৭৪। মনে পরে সেসব দিনের কথা, বঙ্গবন্ধুকে আমি কাছ থেকে দেখেছি। আমি বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক চিকিৎসক ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর পিতার চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলাম। ডাক্তারি পাস করেছিলাম ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে। ১৯৬৫ সাল থেকে ৬৯ পর্যন্ত ঢাকা মেডিক্যালের ছাত্র ছিলাম। এর মধ্যেই যুদ্ধ এসে গেলো। তাই রেজাল্ট বেরোলো না। তখন আমি ঢাকা মেডিক্যালে ছাত্রলীগের কর্মী।’

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আজও মনে আছে তার। তিনি বলেন, ‘‘১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনা মাঠে আমরা সবাই দল বেঁধে গিয়েছিলাম— বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ শুনতে। মঞ্চের একদম সামনে থেকে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ শোনার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ওই ভাষণের মধ্য দিয়ে সেদিন সমগ্র জাতির মতো আমিও দিক নির্দেশনা পেয়ে ছিলাম। এখনও মনে পড়ে বঙ্গবন্ধুর সেই ১৯ মিনিটের বজ্রনির্ঘোষ।’’

২৫ মার্চের কালরাত্রির কথা উল্লেখ করে জগদীশ চন্দ্র হালদার বলেন, ‘২৫ মার্চ রাত দুটোর সময় পাকবাহিনী নেমে পড়লো ঢাকার রাজপথে। অবরুদ্ধ হলো ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে পাক হানাদাররা নৃশংসভাবে হত্যা করলো ছাত্রদের। সেই রাতের কথা আমার আজও  মনে আছে। যখন দিনটির কথা স্মরণ করি ভয়ে শিউরে উঠি। সেই রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেল থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম আমি বন্ধুদের সঙ্গে। যদি হোস্টেলে থাকতাম, তাহলে হয়তো পাক হানাদার বাহিনীর হাতে জগন্নাথ হলের ছাত্র- শিক্ষকদের যে পরিণতি হয়েছিল, তা আমার ভাগ্যেও তা-ই ঘটতো।’

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগের রাজনীতি করার জন্য আমরা তখন ঘনঘন বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাড়িতে যেতাম। সেখানে বিভিন্ন আলোচনায় এটা বুঝতে পারতাম— এবার কিছু হতে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ একটা কথাই বলতো, এই দেশ আমাদের। আমরা কোনোভাবেই পাকিস্তানিদের বরদাস্ত করবো না। ২৫ মার্চের সেই ভয়াবহ রাতের পর ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে লুকিয়ে ছিলাম। এই সময় নির্দেশ এলো— নিরাপদ জায়গায় সরে যাও। সময় হলে আবারও সংগঠিত হতে হবে। আমি অনেক কষ্ট করে গোপালগঞ্জে চলে এলাম। গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি টুঙ্গিপাড়ার কাছে মুকসুদপুর থানা এলাকার টেংরা গ্রামে আমার বাড়ি ছিল। যদিও বেশিরভাগ সময় আমি গোপালগঞ্জ টাউনে থাকতাম। পাক হানাদার বাহিনী গোপালগঞ্জে চলে আসলে, আমি পালিয়ে ভারতে চলে আসি। প্রথমে আসি কলকাতায় সেখানে এসে দেখা হয়ে যায়— আমাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে। আমরা তখনও ডাক্তারি ফাইনাল রেজাল্ট পাইনি। কিন্তু প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে বারাসাত স্টেশনের সামনে আমবাগানে একটি অস্থায়ী হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়। সেখানে আমি চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলাম। বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করবো বলে। কিন্তু চিকিৎসা শাস্ত্রের ছাত্র হওয়ার কারণে আমাকে ফ্রন্টে পাঠানো হয়নি। দায়িত্ব দেওয়া হলো যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং শরণার্থীদের সেবা করার। সেই কাজ আমি নিরলসভাবে করার চেষ্টা করেছিলাম। আমি জানতাম, আমাদের দেশ একদিন স্বাধীন হবে। সেই স্বাধীনতা এলো ১৬ ডিসেম্বর। ঢাকার রমনার মাঠে পাক হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করলো যৌথবাহিনীর হাতে। সেদিন আমাদের কী আনন্দ। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র আর আকাশবাণী থেকে বাংলাদেশের বিজয়ের ঘোষণা শুনে ধরে উচ্ছ্বাস ধরে রাখতে পারছিলাম না। এরপর ফিরে গেলাম দেশে।’

কীভাবে বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক চিকিৎসক হলেন, তা বলতে গিয়ে ডা. জগদীশ চন্দ্র হালদার বলেন, ‘‘ঢাকায় যাওয়ার পর আমাদের রেজাল্ট বেরোলো। ডাক্তারি পাস করলাম, কিন্তু তখন গ্রামে-গঞ্জে হাসপাতালগুলো বিধ্বস্ত। ডাক্তার নেই। আমাদের মতো বেঁচে থাকা কয়েকজন ডাক্তারকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো মফস্বল এলাকায়। আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ বলে আমাকে পাঠানো হলো দেশের বাড়িতে। গোপালগঞ্জ টিবি হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে পরিকাঠামো না থাকায় আমাকে পাঠানো হলো টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে রেডক্রসের হাসপাতালে। এই হাসপাতালের চেয়ারম্যান ছিলেন বঙ্গবন্ধুর শ্বশুরমশাই মোশারফ হোসেন। আমার থাকার ব্যবস্থা হলো আমার স্বপ্নের নায়ক বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। সারাদিন হাসপাতালে কাজ করার পর বিকালে বাড়িতে ফিরে আসতাম। বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমান সাহেবের সঙ্গে আড্ডা মেরে, আর উনার চিকিৎসা করে সময় ভালোই কাটছিল। এই আড্ডায় বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ আসলেই দেখতাম, লুৎফুর সাহেবের চোখে পানি। উনি বলতেন, ‘খোকা (বঙ্গবন্ধুর ডাক নাম) আমার ছেলে শুধু নয়, ও দেশের ছেলে। ও কখনও বেশি দিন বাড়ি থাকতো না। রাজনীতি করার জন্য।’ আর ঠিক এই কারণেই লুৎফর সাহেবের মনে একটা চাপা দুঃখ ছিল। বঙ্গবন্ধু দেশের দায়িত্ব নেওয়ার পর ঘনঘন টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতে আসতে পারতেন না। কিন্তু তিনি যখন আসতেন জনতার ঢল নামতো। ১০ মাইল দূর থেকে গোপালগঞ্জের মানুষরা তাদের আদরের খোকাকে দেখতে ছুটে আসতো।’’

দেশ ছাড়ালেন কেন? কান্না জড়ানো কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেই ভয়াল দিনটির কথা আমি আজও  ভুলতে পারি না। যেদিন জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়েছিল সপরিবারে। আমি সেদিন আর বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ফিরে না গিয়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলাম। আর  ফিরতে পারিনি আমার প্রিয় বাংলাদেশে। মীরা জাফররা আঘাত হানলো স্বাধীনতার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ওপরে। এপারে চলে আসার পর শুরু করলাম চিকিৎসক জীবন। ভারত সরকারের সরকারি চিকিৎসক হিসেবে অবসর নিয়েছি অনেকদিন। সমসাময়িক রাজনৈতিক ও চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আমার লেখা প্রকাশিত হয়েছে অনেক। সেই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ভারত সরকার আমাকে নাগরিক হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মান পদ্মশ্রী দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন সৈনিক হিসেবে আমি এজন্য গর্বিত। দেশ থেকে দূরে থাকলেও আমি চাই, আমার মাতৃভূমি বাংলাদেশ যেন ভালো থাকে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে আমি কাছ থেকে দেখেছি। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নকে তিনি যেন বাস্তবায়ন করতে পারেন, শেষ জীবনে এটাই আমার কামনা।’

/এপিএইচ/ইউএস/
সম্পর্কিত
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
খেলাধুলার মধ্য দিয়ে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি: প্রধানমন্ত্রী
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
সর্বশেষ খবর
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কথা না বলতে আদালতের নির্দেশ
ইমরান খান ও বুশরা বিবিরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কথা না বলতে আদালতের নির্দেশ
বিতর্কিত আউটের ছবি পোস্ট করে মুশফিক লিখলেন...
বিতর্কিত আউটের ছবি পোস্ট করে মুশফিক লিখলেন...
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!
নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি জয়া
নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি জয়া
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী