‘আমি ক্যান চাঁন্দা দিমু, আমিতো কোন খারাপ কাজ করি নাই’। পুলিশের কনস্টেবল ও সোর্সরা যখন বাবুল মাতুব্বরকে ধরে চাঁদার দাবিতে টানাহেঁচড়া করছিলেন, তখন চিৎকার করে এ কথাই বলেছিলেন তিনি। জানিয়েছেন তার মেয়ে রোকসানা।
রোকসানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুলিশ দোকানে এসেই বাবাকে বলে, চাঁন্দা দে। কনস্টেবল, সোর্সরা আব্বাকে ধরে টানা হেঁচড়া করতে ছিল। কিন্তু আব্বা যাবে না, উনি একটা খুঁটি ধইরা দাঁড়ায় ছিল। বারবার বলতেছিল, আমি ক্যান চাঁন্দা দিমু, আমিতো কোনো খারাপ কাজ করি নাই। যখন আব্বা এগুলা বলতেছিল, তখন পুলিশ হাতের লাঠি দিয়া দোকান ভাঙতেছিল।’
চাঁদা না দেওয়ায় পুলিশের টানা-হেঁচড়ার এক পর্যায়ে জ্বলন্ত স্টোভের আগুনে দগ্ধ হন চা দোকানি বাবুল মাতুব্বর। পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
এ ঘটনার দায় অস্বীকার করে পুলিশ। তবে ঘটনার সূত্র ধরে শাহ আলী থানার চার পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
বাবুল মাতুব্বরের মৃত্যুর জন্য তার পরিবার শাহ আলী থানার পুলিশ ও পুলিশের সোর্সকে দায়ী করেছে। তারা পুলিশ সদস্যদের নাম বলতে না পারলেও সোর্স দেলোয়ার, আইয়ুব আলী এবং রবিনের নাম বলেছে। এর সঙ্গে আরও উঠে এসেছে স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ী পারভীনের নামও।
বাবুলের পরিবারের অভিযোগ, মাদক ব্যবসায়ী পারভীনের সঙ্গে আঁতাত করেই পুলিশ বাবুলের কাছে চাঁদা নিতে আসতো।
স্থানীয় কয়েকটি সূত্র জানায়, মীরপুরে যারাই এরকম ছোট ছোট দোকান দিয়ে ব্যবসা করছে, এমনকি রাস্তাতেও যারা চা, সবজি বিক্রি করে, তাদেরও নিয়মিতভাবে চাঁদা দিতে হয় শাহ আলী থানার পুলিশকে।
বৃহস্পতিবার বার্ন ইউনিটের নিচতলায় যখন বাবুল মাতব্বুরের বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা হচ্ছিলো তার মেয়ে রোকসানার সঙ্গে, তখনই ছেলে রাজু এসে বলে, বাবা আর নাই রে...। তখনই সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সূত্রপাত হয়। দুই মেয়ে রোকসানা, লাবনী, ছেলে রাজু, ছেলে বউ মনি এবং ছোট ভাইয়ের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। ছেলে-মেয়েরা বিলাপ করে বলতে থাকেন, পুলিশ আমার বাবাকে মেরে ফেলেছে, আমার বাবার মৃত্যুর জন্য পুলিশই দায়ী।
মেয়ে লাবনী চিৎকার করে বলতে থাকেন, আমার বাবার মৃত্যুর জন্য মাদক ব্যবসায়ী আর পুলিশ দায়ী। বাবারে জোর জবরদস্তি করতে থাকে, অথচ গাড়ির ভেতরে পুলিশরা বইসা ছিল, তারা কিচ্ছু বলে নাই।
মৃত্যুর খবর পাওয়ার আগে মেয়ে রোকসানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাত সাড়ে নয়টার দিকে একটি বড় মাইক্রাতে করে পুলিশ আসে। তিনজন একেবারে পুলিশের পোশাকেই ছিল, বাকি পুলিশসহ সোর্সেরা ছিল গাড়িতে বসা। পুলিশ দোকানে এসেই বাবাকে বলে, চাঁন্দা দে। কনস্টেবল, সোর্সরা আব্বাকে ধরে টানা-হেঁচড়া করতে ছিল। কিন্তু আব্বা যাবে না, উনি একটা খুঁটি ধইরা দাঁড়ায় ছিল। বারবার বলতেছিল, আমি কেন চাঁন্দা দিমু, আমিতো কোনো খারাপ কাজ করি নাই। যখন আব্বা এগুলা বলতেছিল, তখন পুলিশ হাতের লাঠি দিয়া দোকান ভাঙতেছিল। এরপরই পুলিশ হাতে থাকা লাঠি দিয়ে জ্বলতে থাকা স্টোভের ওপর পিটান দেয়, তখন স্টোভই ফেটে যায়। এতেই আব্বার গায়ে আগুন লেগে যায়, আমার বাবার শরীরের কিছু আর বাকি নাই।’
রোকসানা আরও বলেন, ‘রাতে আসার আগে পুলিশ দুপুরের দিকে আরও একবার আসছিল। টানা-হেঁচড়া করতেছিল বাবাকে নিয়ে যাওয়া জন্য। আমাদের বাসা পাশেই হওয়াতে তখন আমরা সবাই চলে আসি দোকানে। আমার মা বলে, ওনারে ধইরা নিতে হইলে আমাদের লাশের ওপর দিয়া যাইতে হইব। সবাই টানা-হেঁচড়া কইরাই তখন বাবাকে রেখে দেই।’
বাবুল মাতুব্বরের ছোট ভাই আব্দুল জলিল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত দুই মাস ধরে তার ভাই এ চায়ের দোকানটিতে বসতেন। তিনি আগে রিকশা চালাতেন। হার্নিয়ার সমস্যার কারণে সব ভাইবোন মিলে তাকে দোকানটি করে দেন। আর তারপর থেকেই চাঁদার জন্য পুলিশ বিভিন্ন সময়ে এসে বিরক্ত করতো, আর এর সঙ্গে জড়িত স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ী পারুল।’
বুধবার রাতের ঘটনা সর্ম্পকে তিনি বলেন, ‘পুলিশ আসার এক ঘণ্টা আগেও ভাইয়ে সঙ্গে কথা হইছে। এরপরই শুনি এই ঘটনা। ভাইরে দেইখ্যা চিনবার পারি নাই, সব পুইড়্যা গেছে।’
এদিকে, মানবাধিকার কমিশনের চেয়াম্যান মিজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুলিশের বাড়াবাড়ি অসহ্য সীমায় পৌঁছে গেছে। পুলিশকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত।’
বাবুল মাতুব্বরের মৃত্যুর ঘটনায় শাহ আলী থানার চার পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার (ডিসি) মারুফ হোসেন সরদার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এসআই মমিনুর রহমান খান, নিয়াজউদ্দিন মোল্লা, এএসআই দেবেন্দ্রনাথ ও কনস্টেবল জসিম উদ্দিনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে শাহ আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একেএম শাহীন মণ্ডলকে একাধিকবার কল করলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
/এজে/