X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু কন্যাদের প্রবাসের ইতিহাস নির্মমতার

উদিসা ইসলাম
০৬ আগস্ট ২০২২, ০৮:০০আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২২, ০৮:৫৪

ইতিহাসের পাতায় অশ্রু দিয়ে লেখা তারিখ ১৫ আগস্ট। একদিকে পরিবারের সবাই নিহত হওয়ার খবর, অন্যদিকে বিদেশেও জীবন বিপন্ন হওয়ার শঙ্কা। চরম আতঙ্ক নিয়ে আগস্টের দিনগুলো কাটে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার। সঙ্গে শিশু জয় ও পুতুল। ঘটনার দুই সপ্তাহ আগে জার্মানিতে আসার কারণে সেদিন প্রাণে বেঁচে যান দুই কন্যা। জার্মানিতে আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে তাদের কাটাতে হয় দিন-রাত।

ওই ১০টি দিন তাদের কাছে হয়ে উঠেছিল যেন ১০ বছরের সমান। তারা কীভাবে, কোথায় ছিলেন, কারাই বা সেই রুদ্ধশ্বাস সময়ে বিপদের সঙ্গী হয়েছিলেন—বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংবাদপত্র, জার্মানির সেই সময়কার রাজনীতিক ও জার্মানরা বিষয়টি কীভাবে দেখেছিলেন, সেসব অনুসন্ধান করে সম্পৃক্তদের সঙ্গে কথা বলেন জার্মান প্রবাসী লেখক ও গবেষক সরাফ আহমেদ। এ নিয়ে তার বই—‘প্রবাসে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার দুঃসহ জীবন’। সম্প্রতি দেশে এসে তিনি মুখোমুখি হন বাংলা ট্রিবিউনের। কীভাবে সেই সময়ের মানুষদের খুঁজে বেড়িয়েছিলেন; কারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন; সেসব অজানা নিয়ে কথা বলেছেন বাংলা ট্রিবিউনের প্রধান প্রতিবেদক উদিসা ইসলামের সঙ্গে।

বাংলা ট্রিবিউন: ঠিক কখন মনে হলো ১৯৭৫ সালের সেই সময়টায় বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের প্রবাস জীবন অনুসন্ধান করা প্রয়োজন?

সরাফ আহমেদ: আমি জার্মানি যাওয়ার পর থেকে গত প্রায় ৪০ বছর নানাভাবে জানতে চেয়েছি দুই বোন কীভাবে নিরাপদে ছিলেন। তাদের বয়ানে খুব সামান্য শুনতে পাই— তাদের কেউ না কেউ হেল্প করেছিলেন। খুঁজতে গিয়ে প্রথমত বঙ্গবন্ধুর জামাতা ওয়াজেদ মিয়ার লেখা বইতে কয়েকজন মানুষের নাম জানতে পারি। এরপর শুরু হয় অনুসন্ধান।

‘প্রবাসে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার দুঃসহ জীবন’ বইটির লেখক সরাফ আহমেদ

বাংলা ট্রিবিউন: কারা জীবিত আছেন, সেটা বের করার পাশাপাশি, কারা কথা বলবেন সে সময়টা নিয়ে— সবটা নিশ্চয়ই চ্যালেঞ্জিং ছিল?

সরাফ আহমেদ: একজন সাংবাদিকের খোঁজ পাই। তার পরামর্শে বিভিন্ন জনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করলে একটির পর একটি নতুন সূত্রের সন্ধান পেতে থাকি। বার্লিন, বন, ফ্রাঙ্কফুর্ট, কার্লসরুয়ে, ভিয়েনা, ব্রাসেলস, আমস্টারডাম, ওয়াশিংটন, বেঙ্গালুরু, ঢাকা—এসব জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেই সময়ের ঘটনার সাক্ষী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বের হতে থাকেন। পুরনো ছবি, চিঠিপত্র দিয়ে অনেকেই সহযোগিতা করেন। তাদের মর্মস্পর্শী স্মৃতিচারণে অনেক অজানা বেরিয়ে আসে।

হ্যানোভারের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির মহাফেজখানায় যোগাযোগ করে জার্মান পত্রিকায় ১৯৭৫ সালের খবরের সন্ধান করে কীভাবে কোন পত্রিকায় রিপোর্টিং হয়েছে, কোন সাংবাদিক রিপোর্ট করেছেন, সেই সাংবাদিকের নাম দেখে তাদের খুঁজে বের করেছি। এই বইয়ে ইন্দিরা গান্ধীর চিঠি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। আছে ওয়াজেদ মিয়া, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার অপ্রকাশিত কয়েকটি চিঠিও।

বাংলা ট্রিবিউন: শুনেছি জার্মান মিডিয়া সে সময় পক্ষে ছিল না...।

সরাফ আহমেদ: জার্মান সাংবাদিক যারা ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট বন শহরে বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি। তখন মিডিয়া মহলে রটে গেলো, শেখ হাসিনা-শেখ রেহানাদের বনে রাষ্ট্রদূতের বাসায় বন্দি করে রাখা হয়েছে।

কিন্তু তাদের যে বন্দি করা হয়নি, তা প্রমাণ করতে দুই বোনকে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করতে হলো রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে। সাংবাদিকরা পরে বর্ণনা করেছেন যে তারা সেদিন না গেলে অনেক ভুল বোঝাবুঝি হতে পারতো।

তারা বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন, কীভাবে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী প্রায় একা পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনার বইতে বারবার ড. শহীদ হোসেনের কথা এসেছে। তার সঙ্গে কেমন অভিজ্ঞতা হলো? তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কন্যাদ্বয়কে কেমন দেখেছিলেন?

সরাফ আহমেদ: এই মানুষটার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর অন্তত ৫০ বার ফোনে আলাপ হয়েছে। তাকে নিয়ে নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে দেখেছি।

তিনি বলেন, এনগেসার সড়কের ৩ নম্বর অতিথি ভবনের বাড়িটি হঠাৎ করেই বেদনার্ত এক বাড়ির রূপ নিয়েছিল। শেখ রেহানা প্রায়ই ডুকরে কেঁদে উঠতেন। ওই সময় নানাভাবে তিনি সান্ত্বনা দিতেন। তিনি শেখ হাসিনাকে ডায়েরিতে কিছু দোয়া-দরুদ লিখে দিয়েছিলেন।

শেখ হাসিনা শক্ত থাকার চেষ্টা করতেন। শেষ কয়দিন তারা কেউ অজানা ভয়ে ওই সময় ঘর থেকে বের হতেন না। তখন ড. শহীদ টুকটাক কাজ করে দিতেন। বাজার করে আনতেন। রান্নায় সহযোগিতা করতেন।

তিনি বলেন, সবাই ভেঙে পড়লেও হাসিনা আপাকে দেখতাম শোকে ভেঙে না পড়ে ধকল সহ্য করার অদ্ভুত ক্ষমতা যেন বিধাতা তাকে দিয়েছেন। সবার অভিভাবক হিসেবে হয়তো তিনি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করতেন। তবে ওয়াজেদ ভাইয়ের মধ্যে একটা আতঙ্ক কাজ করতো। ওয়াজেদ ভাই আমাকে বলেছিলেন, আমার কেমন ভয় ভয় করছে। তুমি  ক’দিন আমাদের সঙ্গে থাকো। শেখ হাসিনা দিল্লি পৌঁছানোর তিন দিন পর ২৭ আগস্ট তাকে চিঠি লিখেছিলেন। আমি যখন নানা বিষয়ে খুঁটিনাটি জানতে চাইছিলাম, তখন তিনি পুরনো কাগজপত্র ঘেঁটে ৪৫ বছর আগের দিল্লি থেকে লেখা চিঠি, খাম ও কার্লসরুয়েতে লেখা শেখ রেহানার অন্তরের আবেগময় কষ্টের কথামালার তিনটি ছিন্ন পাতা উদ্ধার করে আমাকে দেন।

প্রতিবেদকের সঙ্গে সরাফ আহমেদ

বাংলা ট্রিবিউন: শেখ হাসিনা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের দিল্লিতে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি কীভাবে জানলেন?

সরাফ আহমেদ: ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তা সি ভি রঙ্গনাথনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে। ড. কামাল হোসেনকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসার পর রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ওয়াজেদ মিয়াকে কার্লসরুয়েতে যেতে বলেন তার জরুরি জিনিসপত্র ও বইপুস্তক নিয়ে আসার জন্য। সেই মতো ওয়াজেদ মিয়া কার্লসরুয়ে যান।

কিন্তু ওই দিন শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র বন্ধ ছিল। ফলে তিনি বইপত্র সংগ্রহে ব্যর্থ হন। সন্ধ্যার কিছু পরেই তিনি বন শহরে ফিরে আসেন। ওয়াজেদ মিয়া কার্লসরুয়ে থেকে ফিরে আসার পর রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ফোন করেন তারিক এ করিমকে। তাকে বলা হয়, তিনি যেন তার গাড়িটি নিয়ে আসেন।

ফোন পেয়ে তারিক এ করিম গাড়ি নিয়ে আসেন। বেশ রাতে ওই গাড়িতে তার স্ত্রী ও ওয়াজেদ মিয়াকে নিয়ে পূর্বনির্ধারিত এক স্থানে যান। পথে ওয়াজেদ মিয়াকে জানানো হয়, ওখানে ভারতীয় দূতাবাসের এক কর্মকর্তা গাড়ি নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছেন। ওই কর্মকর্তা তাকে ভারতের রাষ্ট্রদূতের কাছে নিয়ে যাবেন।

তারা ভারতীয় কর্মকর্তার অবস্থানের কাছে ওয়াজেদ মিয়াকে নামিয়ে দিয়ে সেখান থেকে চলে আসেন। সেদিন পূর্বনির্ধারিত স্থানে ওয়াজেদ মিয়ার জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তা সি ভি রঙ্গনাথন। আমি তার সঙ্গে কথা বলেছি।

ওয়াজেদ মিয়া তার গাড়িতে ভারতের রাষ্ট্রদূতের বাসভবন অভিমুখে রওনা হন। সেখানে ঠিক হয় কীভাবে কী হবে। তাদের ২৪ আগস্ট যাওয়া ঠিক হলেও কোথায় যাবেন সেটা জানানো নিষেধ ছিল। যদিও ড. শহীদ বিশেষ ব্যবস্থাপনায় প্লেনে উঠে দেখে এসেছিলেন শেখ হাসিনা ও রেহানা প্লেনে বসেছেন।

ড. শহীদ আমাকে বলেছেন, তারা দিল্লি যাওয়ার ক’দিন পর হুমায়ুন রশীদের নেতৃত্বে জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা এসে তার কাছে জানতে চান বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে কোন দেশে পাঠানো হয়েছে। তিনি পরে ভেবে নিয়েছেন এটা সম্ভবত বাংলাদেশ থেকে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে জিজ্ঞাসা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

বাংলা ট্রিবিউন: এই যে এত রকমের মানুষ খুঁজে বের করলেন, মনে হয়নি বইটি যাদের নিয়ে লেখা তাদের কাছে পৌঁছে দেই?

সরাফ আহমেদ: নিশ্চয়ই। অনেকবার মনে হয়েছে। এটাও মনে হয়েছে, এই বইতে যদি শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার বয়ানটা যুক্ত করা যেতো তবে আরও সমৃদ্ধ হতো। তবে আমি শুনেছি বইটি তাদের কাছে পৌঁছেছে এবং তারা সেই সময়ের দুঃসহ স্মৃতির দিনে ফিরে গেছেন।

/এফএ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ গিনেস বুকে ওঠানোর উদ্যোগ
বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা
টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে ৪১তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারদের শ্রদ্ধা
সর্বশেষ খবর
ওঠানামা করছে মুরগির দাম, বাড়ছে সবজির
ওঠানামা করছে মুরগির দাম, বাড়ছে সবজির
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ