X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘দেড় হাজার স্প্লিন্টার মনে করিয়ে দেয় প্রতিনিয়ত’

এমরান হোসাইন শেখ
২১ আগস্ট ২০২২, ১৪:৫৪আপডেট : ২১ আগস্ট ২০২২, ১৭:১০

নারকীয় গ্রেনেড হামলার পেরিয়েছে দেড়যুগ। ঘটনার সময় ২৪ জন নিহত ছাড়াও আহত অনেকেও পরে মারা গেছেন। শরীরে হাজারো স্প্লিন্টার বহন করে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চলে গেছেন তারা। যারা বেঁচে আছেন তাদেরও রয়েছে বুকচাপা কষ্ট। ২১ আগস্ট এলেই ভয়াল সেই স্মৃতি জাপটে ধরে তাদের। আপ্লুত হয়ে পড়েন স্বজন হারানো পরিবারের সদস্যরাও।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি ও আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে গ্রেনেড হামলা চালানো হয় রাজধানীর জনসভায়। মুহুর্মুহু গ্রেনেড হামলায় ঝরে যায় ২৪টি তাজা প্রাণ। আহত হয় ৫ শতাধিক। বছর ঘুরে আবার ফিরে এসেছে সেই দিন।

২১ আগস্টের ঘটনার সময় ঢাকা মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন নাসিমা ফেরদৌসী। ঘটনার দিন ট্রাকমঞ্চের নিচে আইভি রহমানের পাশেই ছিলেন।

গ্রেনেড হামলায় পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া নাসিমাকে লাশের গাড়িতে করেই ঢাকা মেডিক্যালে নেওয়া হয়। একপর্যায়ে তার জ্ঞান ফেরায় মর্গে না নিয়ে মেডিক্যালের করিডোরে রেখে দেওয়া হয় প্রাথমিক চিকিৎসা। পরে দেশে-বিদেশে দীর্ঘ চিকিৎসার পর এখন দুই পায়ে ভর করে হাঁটতে পারছেন তিনি।

স্মৃতিচারণ করে নাসিমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওই ঘটনা ভোলার নয়। ভুলতে চাইলেও দেড় হাজার স্প্লিন্টার ঘটনা মনে করিয়ে দেয় প্রতিনিয়ত।’

তিনি মনে করেন, ওই দিন খুনি চক্রের টার্গেট ছিল জননেত্রী শেখ হাসিনা। আল্লাহ সেদিন রহমতের চাদর দিয়ে তাঁকে ঢেকে রেখেছিলেন। অনেকেই রক্ত ও প্রাণ দিয়ে রক্ষা করেছিলেন তাঁকে।

ওই সময়কার ঘটনা বর্ণনা করে নাসিমা বলেন, আমার শরীরে দেড় হাজারের মতো স্প্লিন্টার বিঁধে। শরীর ক্ষতবিক্ষত। পা টুকরো টুকরো হয়ে যেন উড়ে যাচ্ছিল। ওই অবস্থায় সেগুলো কুড়িয়ে রাখলাম। পাশে আইভি আপা মা মা বলে চিৎকার করছেন। ট্রাকে নেত্রীকে দেখতে পাচ্ছি না। ডানে-বামে লাশ আর রক্ত দেখে অজ্ঞান হয়ে যাই।

জ্ঞান ফিরলে দেখি আমি লাশের ট্রাকে। জ্ঞান আছে দেখে আমাকে ঢাকা মেডিক্যালের এক করিডোরে ফেলে রাখা হয়। জ্ঞান না ফিরলে হয়তো আমার জায়গা হতো মর্গে।

তিনি আরও জানান, এক সাংবাদিকের সহযোগিতায় কয়েক দফা চেষ্টা করে ছেলের মোবাইলের নম্বর বলতে পারি। পরে খবর পেয়ে ছেলে ধানমন্ডি থেকে এসে আমাকে মৃতপ্রায় অবস্থায় পায়। কোনও চিকিৎসা নেই। ডাক্তার আসছে না। গজ কাপড় দিয়ে পায়ের খণ্ডিত অংশগুলো কোনোমতে পেঁচিয়ে রাখা।

‘ওই সময় আমার পা ডাক্তার কেটে ফেলতে চাইলেও ছেলে দিল না। ততক্ষণে আইভি আপার পা কেটে ফেলা হয়েছে। আমার ছেলে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করার কথা বললো। এরপর সারা রাত আমাকে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে নেওয়া হলো। কেউ রাখতে চাইলো না। সিএমএইচ থেকেও ফেরত পাঠানো হলো। পরে রাত ৪টার দিকে ডাক্তার রুহুল হকের অনুরোধে শুধু রাতটুকুর জন্য একটি হাসপাতালে রাখা হলো।

পরের দিন বাংলাদেশ মেডিক্যালে আমার অপারেশন হয়। এরইমধ্যে আমার মুমূর্ষু হওয়ার খবর নেত্রী পান। তিনি লোক পাঠিয়ে আমার খোঁজ নেন। একদিনের মধ্যে পাসপোর্ট ভিসা করিয়ে অন্য আরও নেতার সঙ্গে আমাকেও দিল্লির অ্যাপলোতে পাঠানো হয়।

ওই সময় নেত্রী এগিয়ে আসায় আল্লাহর রহমতে আজ আমি দু’পায়ে ভর করে হাঁটছি। উনার কারণে আজ আমিসহ অনেকেই স্প্লিন্টার নিয়ে হলেও বেঁচে আছি। আমরা ওয়ান ইলেভেনের সময় সক্রিয়ও ছিলাম। এখনও আছি, আগামীতেও থাকবো।

নাসিমা ফেরদৌস জানালেন, ‘ফুসফুসের কাছে, হাতে পায়ে এক থেকে দেড় হাজার স্প্লিন্টার। কী যে অসহ্য যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছি সেটা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না।’

‘শরীরে অনেক যন্ত্রণা হয়, চুলকায়। গরমের দিনে গরম আর শীতের দিনে পা দুটো ঠান্ডা হয়ে যায়। জ্বালাপোড়া করে।’

তিনি বলেন, হামলাকারীদের বিচারের রায় অনতিবিলম্বে কার্যকর চাই। আমি আশাবাদী যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মতো ২১ আগস্ট হামলাকারীদের বিচার বাংলার মাটিতে হবে।

সেদিনের ভয়াল গ্রেনেড হামলায় আহত হন ইঞ্জিনিয়ার সেলিম চৌধুরী। দেশে বিদেশে দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে ২০১৯ সালের ১৬ নভেম্বর তিনি মারা যান। তার শরীরে মোট ২২ বার অপারেশন করতে হয়েছিল।

বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা হয় সেলিম চৌধুরীর ছেলে আবদুল্লাহ চৌধুরী তপুর। ২০০৪ সালে তার বয়স ছিল ৭ বছরের মতো। তিনি বলেন, ঘটনা পুরোটা মনে নেই। যতটুকু মনে পড়ে, বাবাকে রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাকার বাসায় নিয়ে আসা হয়। শার্ট রক্তে ভরে গেছে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে কাটাছেঁড়া। রক্ত ঝরছে। এরপর মাসহ অন্যরা হাসপাতালে নিয়ে গেলো।

‘২০১৯ সালের নভেম্বরে বাবা মারা যান। এই সময় দেখেছি তিনি কত শারীরিক কষ্ট নিয়ে চলেছেন। সারা রাত ঘুমাতে পারতেন না। ব্যথায় কাতরাতেন। রাতে পায়চারী করতেন। কয়েক দফা ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন। ২২টি অপারেশন হয়েছিল। ওষুধের ওপরই ছিলেন। সবসময়ই শরীর খারাপ থাকতো। সুযোগ পেলে আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে অংশ নিতেন। শেষের দিকে শ্বাসকষ্ট হতো। ওই শ্বাসকষ্টেই ২০১৯ সালের ১৬ নভেম্বর মারা যান।’

তপু আরও বলেন, ‘বাবাকে আগস্ট মাসে অন্যরকম দেখাতো। কেমন যেন উদাসীন থাকতেন। উনি সবসময়ই প্রধানমন্ত্রীর ওপর কৃতজ্ঞ ছিলেন। আমরাও তার প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি আমাদের সাধ্যমতো সহায়তা করেছেন। আমাদের ভাইবোনদের নামে এফডিআর করেছেন। আমার বোন এখনও ট্রাস্ট থেকে বৃত্তি পাচ্ছেন। আমাদের মিরপুরে একটি ফ্ল্যাট দিয়েছেন।’

আক্ষেপ করে সেলিম চৌধুরীর ছেলে বলেন, ‘বাবার ইচ্ছা ছিল খুনিদের বিচারের রায় কার্যকর দেখে যাবেন। কিন্তু তা না দেখেই তিনি চলে গেছেন।’

স্বামী নিরুদ্দেশ হওয়ার পর কাজের সন্ধানে দুই সন্তানসহ ঢাকায় এসেছিলেন রাজিয়া খানম। স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেত্রীর সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে অংশ নিতেন। ২১ আগস্টও বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সমাবেশে। সেখানে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন রাজিয়া। পরে প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে এক লাখ টাকা দেওয়া হলে নানা-নানীর সঙ্গে গ্রামে চলে যায় রাজিয়ার দুই সন্তান হারুন ও নুরনবী। এখন তারা সেখানেই আছেন।

গত দেড়যুগ শেখ হাসিনার কাছ থেকে তারা আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। জমি কিনে পাকা ঘর তৈরির পাশাপাশি গরুর খামারও করছেন নুরনবী। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দুই ভাই এখন ভালোই আছেন।

নুরনবী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের অনেক সহায়তা করেছেন। তবে, আমাদের অভাব মায়ের। মায়ের জীবনের বিনিময়ে আজ আমরা সুখে আছি। কিন্তু সুখের দিনে মাকে কাছে পাচ্ছি না। বিশেষ করে এই আগস্ট মাসে আপনারা (সাংবাদিকরা) যখন খোঁজ নেন তখন মায়ের অভাব আরও মনে পড়ে।

তিনি বলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীর ওপর সন্তুষ্ট। তবে অসন্তুষ্টি হচ্ছে আমার নানা-নানির ইচ্ছা ছিল বিচার দেখে যাবেন। কিন্তু তারা না দেখেই চলে গেছেন। আমরা চাই প্রধানমন্ত্রী বিচারটি যেন দ্রুত করেন।’

/এফএ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
দেশের জন্য কাজ করতে আ.লীগ নেতাকর্মীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
সর্বশেষ খবর
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
‘শো মাস্ট গো অন’
চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি‘শো মাস্ট গো অন’
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!