X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

হাসিনা-মোদি একান্ত বৈঠকই এই সফরের মূল আকর্ষণ

মাসুদা ভাট্টি
মাসুদা ভাট্টি
০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৮:৪১আপডেট : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২২:১০

ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি তার চোস্ত হিন্দি উচ্চারণে যখন হলভর্তি মিডিয়া কর্মীদের সামনে বলতে শুরু করলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্ব একটি স্থায়ী এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের বিষয় তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাথা নেড়ে তাতে সায় দিচ্ছিলেন। এর আগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সফরকৃত দলটি আয়োজক ভারতীয় দলটির সঙ্গে আলোচনা-বৈঠক শেষে সাতটি সমঝোতা স্মারকের বিষয়ে একমত হয়েছেন এবং তাতে স্বাক্ষরও করেছেন। দুই প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসের সামনে সেগুলো উত্থাপনের আনুষ্ঠানিকতাই কেবল হয়েছে আজ ৬ সেপ্টেম্বর দিল্লি সময় দুপুর একটার দিকে।

কুশিয়ারা নদীর পানির হিস্যা বুঝে নেওয়া, রেলপথ, বিজ্ঞান/মহাকাশ/পারমাণবিক গবেষণা, রেলপথে নতুন সংযোজন এবং ভারতের সঙ্গে টেলিভিশন অনুষ্ঠান বিনিময় সংক্রান্ত এসব সমঝোতা স্মারক সইয়ের জন্য দু’দেশের দুই ক্ষমতাবান প্রধানমন্ত্রীর দেখা করার প্রয়োজন নেই বলে মনে করেছেন অনেক বিশ্লেষক, যে কথা কালকেই লিখেছিলাম। তাহলে কেন এই সফর এবং কেনই বা দু’জন ক্ষমতাবান মানুষের কর্মঘণ্টা ব্যয়? এসব প্রশ্নই আসলে ছিল আজকের দুই নেতার প্রেস ব্রিফিং-আয়োজনের সভাকক্ষে উপস্থিত সবার মনে। যদিও সেসব প্রশ্নের কোনও আনুষ্ঠানিক উত্তর পাওয়ার সুযোগ কারোরই হয়নি এবার। তাই কেবল দূর থেকে সূত্রদের দেওয়া তথ্য হতেই এই বিশ্লেষণ।

আজ ৭ সেপ্টেম্বর সফররত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দিন শুরু হয় দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে এসে সাঁজোয়া গাড়ি বহর থেকে নামার মাধ্যমে। যেখানে তাকে স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এটাই এই দেশের দস্তুর। বিমানবন্দরে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা গণ্যমান্য অতিথিদের স্বাগত জানান প্রোটোকল অনুযায়ী কোনও প্রতিমন্ত্রী বা নির্দিষ্ট পদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া ব্যক্তিবর্গ। আর তার পরদিন আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতির অতিথিকে বরণের মাধ্যমে। এমনটি কেন? একজন ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক জানালেন, এমনটি এ কারণেই যে যাতে বারবার রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রীকে নিরাপত্তাজনিত হাঙ্গামা পেরিয়ে বিমানবন্দরে যেতে না হয়, যেখানে রাষ্ট্রপ্রধানদের একবার যাওয়ার অর্থই হলো দিনের জন্য ট্রাফিকের সমস্যা তৈরি হওয়া এবং পরিণামে সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তি। ফলে যেকোনও রাষ্ট্রপ্রধানের জন্যই মূল সফর শুরু হয় পরদিন রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে থেকে যেখানে অতিথিকে স্বাগত জানানো হয় এবং যোগ্যতা অনুযায়ী গার্ড অব অনারসহ বাকি আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হয়নি। ফলে যারা এ নিয়ে খুশি হয়েছিলেন যে শেখ হাসিনাকে ভারত আর পাত্তা দিচ্ছে না, তাদের জন্য বিষয়টি নিঃসন্দেহে আশাহত হওয়ার মতোই বটে।

রাষ্ট্রপতি ভবনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে দুই নেতা তাদের পারিষদবর্গসহ উপস্থিত হন বিখ্যাত হায়দারাবাদ হাউজে। হায়দারাবাদ সর্বশেষ নিজাম মীর ওসমান আলী খাঁ’র একদা বাসভবন; এই ভবনটি ইন্দো-ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতিতে তৈরি এবং বর্তমানে সরকারি বিশেষ অতিথিদের জন্য বরাদ্দকৃত এবং রাষ্ট্রীয় ব্যাংকোয়েটের আয়োজনও এখানেই হয়, তাও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কিংবা পুতিনের মতো অতিথিদের জন্য। সকাল ১১টা থেকে শুরু হয়ে বৈঠক চলে প্রায় সাড়ে ১২টা পর্যন্ত। এরমধ্যে দুই নেতার মধ্যে রুদ্ধদ্বার বৈঠক এবং দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, যত খুশি সমঝোতা স্মারক সই হোক না কেন, মূল আলোচনা আসলে হয়েছে এই রুদ্ধদ্বার ও দুই নেতার একান্ত বৈঠকেই, আর সিদ্ধান্ত যা হওয়ার তা হয়েছে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকেই।

শেখ হাসিনা পরেছিলেন হালকা সবুজ রঙের জামদানি আর নরেন্দ্র মোদি যথারীতি সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। মোদি তার বক্তৃতায় বিশাল দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নের কথা বলে মূলত একাত্তরের যে চেতনা তাকে সঙ্গে করেই ভারত ভবিষ্যতেও চলতে চায় বলে স্পষ্ট বলে দেন। সঙ্গে এ কথাও বলেন যে বাংলাদেশের মতো বন্ধু যার সঙ্গে জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদ দমনে তার সরকার একত্রে কাজ করে একাত্তরের চেতনাকে পাথেয় করেই ভারতের স্বাধীনতার ‘কুম্ভ’টি তিনি ‘অমৃত’ দিয়ে ভরতে চান। এ কথার যদি ভিন্ন অর্থ ধরতে চাই তাহলে এটাও বলা যায় যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আসলে তার নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কাছ থেকে ভারতের সামান্য ক্ষতিও চান না, একজন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে এই চাওয়া প্রাসঙ্গিক ও সঙ্গত। তিনি যোগাযোগ সংযোগের ওপর জোর দিয়ে বলেন, ‘তারিক্কি’ বা উন্নতি একা একা হয় না, সকলকে সঙ্গে নিয়েই করতে হয়, আর এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, শেখ হাসিনার কারণে বাংলাদেশ বিশ্বসভায় যে সুনাম অর্জন করেছে তা সত্যিই অভাবনীয়। তিনি আবারও শেখ হাসিনার সঙ্গে একত্রে কাজ করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এবং তিনি যে এটি কথার কথা হিসেবে বলছেন না, তা তার শব্দচয়ন, শব্দ প্রয়োগ ও উচ্চারণ দিয়েই বুঝিয়ে দেন।

অপরদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার লিখিত বক্তব্যে বাংলাদেশ-ভারতের ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের কথা তুলে ধরে ভবিষ্যতেও এই বন্ধুত্ব যেন অটুট থাকে সে বিষয়ে জোরারোপ করেন। তিনি স্বাক্ষরকৃত সমঝোতা স্মারকের কথা উল্লেখ করে বলেন, এগুলো ছাড়াও তাদের মধ্যে আলোচনায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের বাইরে বৃহৎ দক্ষিণ এশিয়ার কথা। যেখানে অর্থনীতি থেকে নিরাপত্তা, ব্যবসা থেকে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ সব ক্ষেত্রেই ভারত ও বাংলাদেশ নিরবচ্ছিন্নভাবে একযোগে ও পারস্পরিক যোগাযোগ ও বিনিময়ের মাধ্যমে কাজ করবে এই অঞ্চলের বাকি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে। লিখিত ইংরেজি বক্তব্যের শেষে  দু’মিনিট শেখ হাসিনা বাংলায়ও বক্তব্য রাখেন, যার সরল অর্থ করলে এটুকুই বলা যায় যে এই সফরে আসলে আলোচনার বিষয়বস্তুতে বিভিন্নতা ছিল এবং তা নিয়ে দুই নেতা হয়তো কোনও সমঝোতায়ও পৌঁছে থাকবেন।

শুরুতেই বলেছিলাম, কী হতে পারে এসব অলিখিত বিষয়বস্তু? কালকে ইঙ্গিতে সাংবাদিক হিসেবে আমার বিভিন্ন সূত্র বলেছিল যে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অনিশ্চয়তার বিষয়টি যেমন থাকার কথা, তেমনই চীন ইস্যুটি দুই নেতার আলোচনায় বেশ প্রাধান্য পেয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য এই দাবিও করেছেন যে চীনকে বঙ্গোপসাগর থেকে দূরে রাখতে ভারতের সঙ্গে মার্কিন যে বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে তাতে বাংলাদেশের ভূমিকা কী হবে, কেমন হবে তা আলোচনায় সন্দেহাতীতভাবেই থাকবে। এমনকি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে গঠিত সামরিক, বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত একাধিক জোট, চুক্তি এবং পরিকল্পনাপত্রে বাংলাদেশের অবস্থান, অংশগ্রহণ এবং ভূমিকা কোনোটিই এখন পর্যন্ত নিশ্চিত ও নির্ধারিত হয়নি। শেখ হাসিনা এমন এক প্রধানমন্ত্রী, যিনি প্রকৃত অর্থে সব পরাশক্তি, আঞ্চলিক শক্তিবলয়কে নিয়ে একযোগে, একসঙ্গে কাজ করে চলেছেন এবং সফলও হয়েছেন। অপরদিকে নরেন্দ্র মোদির সরকার রাশিয়ার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখেও সবচেয়ে মিত্রতার প্রকাশ দেখিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তার এই মুহূর্তের পরম মিত্র ভারতের হাতে এই ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দায়িত্ব অনেকটাই ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিত থাকার ভান করছে।

ফলে শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির একান্ত আলোচনায় এসব প্রসঙ্গ আসবে না, তা কি হয়? অবশ্যই হয় না, হতে পারে না। দুই নেতার একান্ত আলোচনায় এসব প্রসঙ্গ এসেছে কি আসেনি তা এখন নিশ্চিত করার কোনও উপায় যদিও আমাদের নেই, কিন্তু আগামী মাস খানেকের মধ্যেই আমরা বুঝতে পারবো কে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে ইন্দো-প্যাসিফিক রিজিয়নের বিভিন্ন কৌশলগত পরিকল্পনায়। তখনই কেবল নিশ্চিত হওয়া যাবে, হাসিনা-মোদির দিল্লি বৈঠকে আসলেই কি এসব প্রসঙ্গ উঠেছিল বা ওঠেনি।

লেখক: এডিটর ইনচার্জ, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি
 
/এসএএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য খালাস করে গেলেন যে নারী ট্রাকচালক
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
সর্বশেষ খবর
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ ডিসি ও এসপিদের
উপজেলা নির্বাচনমন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ ডিসি ও এসপিদের
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা