দীর্ঘদিনের স্বপ্ন একটি সেতুর, সব কিছু যেন থমকে আছে! একদিন ঠিকই হবে কাঙ্ক্ষিত সেতুটি; সেই অপেক্ষায় কয়েক যুগ পার করা। অবশেষে ২০০৮ সালে প্রতিশ্রুতি মিললো সেতুটির। মধুর অপেক্ষা, কাজ শুরু হচ্ছে কবে? ২০১৫ সালে এসে স্থাপিত হলো ভিত্তিপ্রস্তর। অপেক্ষায় থাকা স্বপ্নে আশার গতি সঞ্চার করলো। চোখের সামনে চললো সেতুটির নির্মাণযজ্ঞ। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে সেতুর উপর দিয়ে যাওয়ার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ধরা দিয়েছে আজ। বুক বাঁধলেন সবাই, এবার ভাগ্যবলের বদল হবে। হ্যাঁ, দেশের প্রথম ৬ লেন বিশিষ্ট মধুমতি সেতুর কথাই বলছি। স্থানীয়ভাবে কালনা সেতু নামে পরিচিত এটি।
নড়াইলের লোহাগড়ায় মধুমতি নদীর কালনা পয়েন্টে নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশে ইতিহাস সৃষ্টিকারী সেতুটি। ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্কের আওতায় তৈরি মধুমতি সেতু আজ সোমবার (১০ অক্টোবর) উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিন দুপুর ১২টায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সেতুটির উদ্বোধন করেন তিনি। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে ৬৯০ মিটার দীর্ঘ সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৯৬০ কোটি টাকা।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর নড়াইলে সুলতান মঞ্চের জনসভায় কালনা পয়েন্টে একটি সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। সেই নির্বাচনে জিতে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তিনি। আজ এই সেতুর উদ্বোধন করলেন টানা তৃতীয় মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মধুমতি নদীর নামে এই সেতুটির নামকরণও করেছেন তিনি।
নড়াইল-২ আসনের তারকা সংসদ সদস্য (এমপি) মাশরাফি বিন মুর্তজা বলেন, নড়াইলসহ এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের চাওয়া ছিল কালনা পয়েন্টে একটি সেতু হোক। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তাদের সেই চাওয়া পূরণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে এজন্য আমার এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এই সেতুর সুফল পাবে এই অঞ্চলের লাখো মানুষ। যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ভূমিকা রাখবে।
মধুমতি সেতুর কালনার প্রান্তে জড়ো হওয়া স্থানীয়রা বলেছেন, নড়াইল-যশোরের মানুষকে ঢাকায় যেতে কালনা ফেরিঘটে দীর্ঘ যানজটের কবলে পড়তে হতো। বিকল্প পথে মাগুড়া ঘুরে আরিচা ফেরি হয়ে রাজধানীতে পৌঁছাতে হয়। এখন মধুমতি সেতু হওয়ায় নড়াইল-যশোরসহ এই অঞ্চলের মানুষ ভোগান্তি ছাড়াই কম সময়ে সরাসরি ঢাকায় যেতে পারবে। এ ছাড়া অঞ্চলটির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও এই সেতু অবদান রাখবে। মধুমতি সেতুর উভয় প্রান্তের ঢাকা থেকে কলকাতার যোগাযোগ ব্যবস্থায় ইতিবাচক হবে।
স্বপ্নের কালনা সেতু (মধুমতি সেতু) উদ্বোধনের মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী হতে দূর্গাপুর থেকে এসেছেন শেখ পলাশ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এই সেতু আমাদের অনেক সমস্যার সমাধান করবে। ঢাকা যেতে আর ফেরিতে যনজটে পরতে হবে না। বাড়ি ফিরতেও ভোগান্তি পোহাতে হবে না। স্বপ্নের এই সেতুটি হওয়ায় আমরা খুব খুশি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ।
নড়াইল সদরের লোহাগড়ার বাসিন্দা রহিমুন্নেসা বলেন, বাড়ির কাছে কত বড় সেতু হয়েছে। এটাই তো আমাদের জন্য আনন্দের। চিকিৎসার জন্য প্রায়ই ঢাকায় যেতে হয়। পথে ফেরির কারণে অনেক ঝামেলায় পরতে হতো। এখন সেতু দিয়ে সরাসরি ঢাকায় যেতে-আসতে পারবো।
শেখ পলাশ ও রহিমুন্নেসার মতো হাজারো মানুষ এদিন মধুমতি সেতুর উদ্বোধন দেখতে আসেন। স্থনীয় আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের বিপুল সখ্যক নেতাকর্মী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোন দেন। অনেকে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বা মিছিল নিয়ে আসেন অনুষ্ঠানস্থলে। সেতুটি নিয়ে স্থনীয় মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ্য করা গেছে।
এদিকে, সেতুর ভাটিয়া পাড়া প্রান্তের বাসিন্দাদের মধ্যেও আনন্দ-উচ্ছ্বাস দেখা গেছে। আতাউল গণি নামে একজন স্থানীয় বৃদ্ধ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বহু বছর ধরে আমাদের একটা দাবি ছিল কালনা সেতুটা হোক। অতীতের কোনো সরকার সেটি করেনি। এখন শেখ হাসিনা সেতুটা করে দিলেন। এখন আমরা নড়াইল-যশোর-খুলনায় সহজেই যেতে পারবো।
এখানকার আরেকজন বাসিন্দা হাবিবুর রহমান, যিনি বলছিলেন, ব্যবসায়িক কাজে তাকে প্রায়ই ভারতের কলকাতায় যেতে হয়। সেখানে যাতায়াতের সুবিদার ক্ষেত্রেও সেতুটি অবদান রাখবে। কলকাতায় যাতায়াত করা দেশের অন্য মানুষেরাও এর সুফল পাবে।
প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই সেতু নড়াইল, গোপালগঞ্জ, খুলনা, মাগুরা, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, যশোর ও ঝিনাইদহ জেলাকে সংযুক্ত করেছে। এই সেতুর সরাসরি সুফল পাবে খুলনা বিভাগের ১০টিসহ আরও কয়েকটি জেলার লাখ লাখ মানুষ। সেইসঙ্গে সেতুটি বাংলাদেশকে সাব-রিজিওনাল কানেক্টিভিটির মাধ্যমে মিয়ানমার ও ভারতের সাথে যুক্ত করবে। ফলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের সঙ্গে উন্মোচিত হবে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত।
তারা আরও জানান, সেতুটির কারণে ঢাকা থেকে নড়াইলের দূরত্ব কমে আসবে ১১৫ কিলোমিটার। একইভাকে ঢাকার সঙ্গে কলকাতার দূরত্বও কমবে। আশপাশের অন্যান্য জেলার ক্ষেত্রে দূরত্ব কমবে ৯০-৯৮ কিলোমিটার। এই সেতু দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতে সময় ও অর্থ বাঁচাবে। এ ছাড়া দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোলের সঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রামের দূরত্বও কমবে, সাশ্রয় হবে সময়। এর ফলে দেশের অভ্যন্তরে এবং প্রতিবেশী দেশে ভ্রমণ ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে।
রবিবার (৯ অক্টোবর) সেতু উদ্বোধনের প্রস্তুতি দেখতে এসে নড়াইলের জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, এই সেতু পুরো দেশের আর্থ-সামাজিক, ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভূত উন্নতি সাধন করবে। এই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সকল অংশীজন, মধুমতি নদীর দুই পাড়ের ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সোমবারের সকালের জন্যে অপেক্ষা করছে। সেতুটি তাদের জীবনমান বদলে দিবে। ঢাকাসহ সারাদেশের যোগাযোগের ক্ষেত্রে নড়াইল হাব হিসেবে পরিচিতি পেতে যাচ্ছে।
এদিন সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এবং প্রকল্পটির পরিচালক শ্যামল ভট্টাচার্য বলেন, ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্কের আওতায় ১৭টি সেতুর কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে এটি প্রথম চালু হচ্ছে। মধুমতি সেতুর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো—এটি ধনুক আকৃতির ও দৃষ্টিনন্দন। সেতুতে ১৫০ মিটার স্প্যান রয়েছে, বড় স্প্যান দিয়েছি আমরা। যে ট্র্যাডিশনাল পিসি গার্ডার আই সেকশন দিয়ে ৪৫-৪৮ মিটারের বেশি বসানো যায় না। নদীর স্রোতধারা যাতে বাঁধাগ্রস্ত না হয়, সে জন্য আর্কস টাইপ স্প্যান দেওয়া হয়েছে। এর ফলে নৌ চলাচলের কোনও সমস্যা নেই।
একই দিন নারায়ণগঞ্জের সদর ও বন্দর উপজেলাকে সংযুক্ত করা তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম নাসিম ওসমান তৃতীয় শীতলক্ষ্যা নামকরণ করা সেতুটির উদ্বোধন হয়। সেতুটি নারায়ণগঞ্জের পাশাপাশি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।