ইটভাটায় কাজ করা শ্রমিকরা অমানবিক শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের মধ্যে জীবন কাটান। ৮ ঘণ্টার বেশি কায়িক শ্রম, সাপ্তাহিক ছুটি নেই। কম বেতন হওয়া সত্ত্বেও কাজ হারানোর শঙ্কায় কোনও দাবির আওয়াজ তোলেন না। দশকের পর দশক একই কাজ করে চলা এই শ্রমিকরা নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার কথা জানেন না। কেবল জানেন এই টাকায় পেট চলে না। সাভারের কয়েকটি ইটভাটায় সরেজমিন গিয়ে একই চিত্র দেখা যায়। শ্রমিকরা বলছেন, তারা বিচ্ছিন্নভাবে দিনমজুর। কোনও সংগঠনের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের কথা বলার বিষয়ে তাদের জানা নেই।
ঢাকা থেকে সাভার ট্যানারির দিকে যাওয়ার পথে যত ইটভাটা দেখা যায়, তার বেশিরভাগেই সাংবাদিক বা বাইরের কোনও মানুষের প্রবেশাধিকার নেই। এমনকি গাড়ি যাওয়ারও পথ নেই। রবিবার এই পথে একটি মাত্র ইটভাটায় ঢোকার সুযোগ হয়। সেখানে কথা হয় ইটভাটায় নানা স্তরে কর্মরত নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে। যাদের বেশিরভাগই কাজ করতে করতে কথা বলেন। কাজের মধ্যে সামান্য সময় অন্য কথায় বা কাজে ব্যয় করলে দিনের মজুরির ওপর প্রভাব পড়ে।
ইটভাটায় তিন ধরনের কাজ ও মজুরি দেখা যায়। মাঠে রোদে শুকানো ইট ভ্যানে করে ভাটার চেম্বার পর্যন্ত আনা। পোড়ানোর জন্য কাঁচা ইট ভাটায় সাজানো, পোড়ানো হয়ে গেলে বিক্রির জায়গা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। তিন স্তরে তিন ধরনের মজুরি দেওয়া হয়।
মজুরি কেমন জানতে চাইলে আলম বলেন, শুরুর যে কাজ রোদে শুকানো ইট ভাটার কাছে আনা, সেই কাজে মজুরি প্রতি হাজার ইটে ১৩০ টাকা। প্রতি চেম্বার ১৬ হাজার ২০০ ইট দিয়ে সাজানোর জন্য অন্তত ৮ জন শ্রমিক দরকার হয়। অর্থাৎ জনপ্রতি ২৫০ টাকা করে মেলে। সেই হিসাবে দিনে ৫০০ থেকে ৮৫০ টাকা আয় হয় এই স্তরের শ্রমিকদের।
পোড়ানোর আগে চেম্বারে ইট সাজানোর কাজ যারা করেন তাদের মিস্ত্রি বলা হয়। এখানে অন্তত চার জন কাজ করে প্রতি হাজার ইটের বিনিময়ে মজুরি পান ৭৫ টাকা। অর্থাৎ এক চেম্বার ইটের (১৬ হাজার ২০০) জন্য মোট মজুরি ১২০০ টাকা। সেটা ৪ জনে ভাগাভাগি করে নিতে হয়। দিনে তিনটি চেম্বার সাজাতে পারলে তবে একেকজন ৯০০ টাকা করে পাবেন।
ভাটার চেম্বার থেকে আগুনে পোড়া ইট সরানোর জন্য প্রতি হাজারে ১৫০ টাকা মজুরি দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে এক চেম্বার মানে ১৬ হাজার ২০০ ইট সরাতে মজুরি পড়ে ২৪০০ টাকা। সেই ইট সরিয়ে বিক্রির জন্য নির্ধারিত জায়গায় টেনে নিতে ৮ জন শ্রমিক দরকার। সে ক্ষেত্রে ৪০০ টাকা করে পান একেক জন। তারাও প্রতিদিন দুই থেকে তিন চেম্বার ইট সরিয়ে ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা আয় করেন।
সাভারের বালিয়াপুর এলাকায় একটি ইটভাটায় কাজ করছেন নারী-পুরুষ শ্রমিক। সবাই সমান কাজ করলেও এই কাজে নারী শ্রমিক কম মজুরি পান। সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কাজ করে নারী ৪০০ টাকা পেলেও পুরুষ শ্রমিক ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা মজুরি পান। একই কাজ করে কেন পুরুষের থেকে মজুরি কম সে উত্তর কেউ জানেন না।
এখানে এক নারী শ্রমিক বলেন, ‘কাজের মধ্যে পুরুষরা তাও এদিক ওদিক যায়। আমরা মেয়েরা দুপুরের বিরতি ছাড়া পুরো সময়টাতেই কাজ করি। তারপরও ওদের মজুরি আমাদের চেয়ে বেশি। সাপ্তাহিক কোনও ছুটি নেই উল্লেখ করে শ্রমিক অঞ্জনা বেগম বলেন, ‘ছুটিছাটা নেই। কাজে না এলে মজুরি নেই। বাজার, কেনাকাটা, থাকা, সব নিজেদের। বছরে ৫-৬ মাস এই কাজ চলে। কিছু সময় শরীরের অবস্থা এত নাজুক থাকে যে বাকি সময় অন্য কোনও কাজ করার ক্ষমতা থাকে না।’
অঞ্জনা বলেন, ‘শুনে মনে হতে পারে দিনে ১২০০ টাকা বেতন। কিন্তু বছরের অর্ধেক সময় কাজ করে বাকি অর্ধেক বসে থাকা এবং নানা রোগবালাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সেই হিসাবে দিনের মজুরি কত হয় বোঝেন। এই টাকায় একটা সংসার কীভাবে চলে? আর আমাদের মেয়েদের তো সব কাজ করতে দেওয়া হয় না। যে কাজ করি সেটা পুরুষদের সমানই করি, কিন্তু মজুরি কম।’
শ্রমিক অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন তারা এখনও অনানুষ্ঠানিক এই সেক্টর নিয়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারছেন না স্বীকার করে নিয়ে শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিনুল হক আমিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ইটভাটা, ইট ভাঙা, চাতালে যারা কাজ করছেন তাদের অধিকার বিষয়ে যতটা কাজ হওয়া দরকার তা হচ্ছে না। তাদের জীবন মানবেতর। তারা যে ভাটায় কাজ করছেন, তাদের শ্রমিক হিসেবে কোনও পরিচিতি নেই, নেই নিয়োগপত্র। নেই নির্দিষ্ট কোনও বেতন কাঠামো। তাদের আবাসস্থল নিয়ে কারোর কোনও দায় নেই। একরের পর একরজুড়ে ভাটা তৈরি হচ্ছে কিন্তু সেখানে এই শ্রমিকদের থাকার একটা জায়গা করে দেওয়া হচ্ছে না।’
তিনি আরও যোগ করেন, ‘এই শ্রমিকদের বছরে ৫-৬ মাস কাজ থাকে। বাকি মাসগুলো তাদের কীভাবে চলবে সেই দায়দায়িত্ব কেউ নেয় না। ফলে তাদের অবস্থা বেশ করুণ।’
ছবি: নাসিরুল ইসলাম