জঙ্গি হামলায় শিকার গুলশান-২ এর ৭৯ নাম্বার সড়কের ৫ নাম্বার বাড়িটির একটি ভবনে রয়েছে ‘হলি আর্টিজান বেকারি’ এবং ‘ও কিচেন’ রেস্টুরেন্ট। সবুজে ঘেরা এই রেস্টুরেন্টে বেশি আসেন বিদেশিরা। যদিও এই রেস্টুরেন্টের বেশির ভাগ কর্মী বাংলাদেশের নাগরিক। শুক্রবার রাতে হলি আর্টিজান বেকারিতে অস্ত্রধারী জঙ্গিরা হামলা চালিয়ে ভেতরের মানুষদের জিম্মি করে। শনিবার সকালে অভিযান চালিয়ে সেখান থেকে ২০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। অভিযানে নিহত হয় ৬ জঙ্গি ও আটক হয় একজন । শুক্রবার রাতে সেখানে কমপক্ষে ৫০ জন মানুষ ছিলেন। এর মধ্যে রেস্টুরেন্টের প্রায় ৩০ জন জন স্টাফ ও ২০ জনের মতো কাস্টমার ছিলেন। কাস্টমারদের মধ্যে প্রায় ১৫ জন বিদেশি ও পাঁচ থেকে ছয়জনের মতো বাংলাদেশি ছিলেন। রেস্টুরেন্টটির একাধিক কর্মীর সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
আর্টিজান বেকারির কর্মী মাইনউদ্দিন বলেন, রেস্টুরেন্টের মূল গেট দিয়ে ঢুকেই গুলি চালাতে শুরু করে হামলাকারীরা। গুলি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রাণ বাঁচানোর জন্য দৌড় দিয়ে নিচ তলা থেকে তৃতীয় তলায় চলে আসি। সেখান থেকে লাফ দিয়ে পাশের বিল্ডিং দিয়ে বের হয়ে আসি। হামলাকারীদের হাতে বন্দুক ছিল। আমরা কয়েকজন ছাদ থেকে লাফ দেই। এর মধ্যে কয়েকজনের হাত-পা ভেঙেছে এবং ছিলে-কেটে গেছে।
রেস্টুরেন্টের আরেক কর্মী শামসু জানান, দেশি-বিদেশি কাস্টমার ছিল রেস্টুরেন্টে। হামলাকারীদের হাতে বন্দুক ছিল। তারা ভেতরে ঢুকে গুলি শুরু করলে আমরা ভয়ে ছাদে চলে যাই, সেখান থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে আসি। হামলার সময় রেস্টুরেন্টে মোটামুটি ভালোই কাস্টমার ছিল। খাওয়া-দাওয়া চলছিল।
মাইনুদ্দিন ও শামসু দুজনেই জানান, রেস্টুরেন্টে ওইসময় কর্মরত দুই ব্রিটিশ কুকও তাদের সঙ্গে পালাতে পেরেছেন।
শুক্রবার রাতে হলি আর্টিজান বেকারির কর্মী মিরাজ ছিলেন দ্বিতীয় তলায় বেকারি কিচেনে। শনিবার সকালে তাকে জীবিত উদ্ধার করে সেনা সদস্যরা। সেখান থেকে দুপুরে নিয়ে যাওয়া হয় গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মুক্ত হয়ে ঘরে ফেরেন মিরাজ।
তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, হামলাকারীরা আমাকে দ্বিতীয় তলায় বেকারি কিচেনে সারা রাত আটকে রাখে। তারা (হামলাকারীরা) বলে, তোদের কিছু করব না চুপচাপ বসে থাক। তারা আমার কাছে থাকা মোবাইলটিও নিয়ে যায়। আমি খুব ভয় পেয়েছি। হামলাকারীদের কারোর বয়স ২৫ বছরের বেশি হবে না। বেকারি কিচেনে পাঁচ জন আসলেও আমি তিনজনকে দেখেছি। বাকি দুজন একটু দূরে ছিল। তাদের হাতে রামদা ও বন্দুক ছিল। রাতভর গুলির আওয়াজ শুনেছি। তারা সারারাত খুবই স্বাভাবিক ছিল। বাংলা, উর্দু মিশিয়ে কথা বলেছে। তারা খুব ইসলামপ্রিয় এমন ভাব প্রকাশ করেছে। তারা বলে, ইহুদি,খ্রিস্টানরা খুব খারাপ। আমাকে দ্বীনের পথে চলতে বলেছে তারা। মদ, জুয়া, নেশা এসব ভালো না। এসব থেকে দূরে থাকতে বলেছে।
মিরাজ বলেন, হলি আর্টিজান বেকারি এবং ও কিচেন রেস্টুরেন্ট দুটিতে মিলিয়ে প্রায় ২৫-৩০ জনের মত কর্মী ছিলেন। অনেকে রাতে দেয়াল টপকে, ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পালাতে পেরেছেন বলে শুনেছি। প্রায় ৭-৮ জন বাথরুমে ছিলেন। সকালে সেনাবাহিনী তাদের উদ্ধার করেছে। সকালে আমাদের প্রায় ৯ জনকে পুলিশের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে আরও অনেককে আনা হয়। সব মিলিয়ে প্রায় ১৯ জনকে ডিবি পুলিশের অফিসে দেখেছি। পুলিশ আমাদের কাছে সেখানে কি ঘটেছিল তা জানতে চেয়েছে। আমরাও যা দেখেছি তা জানিয়েছি পুলিশকে।
আর্টিজানের হিসাবরক্ষণ শাখায় কাজ করেন সিজান চৌধুরী নামের একজন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, হামলার সময় তিনি নিচ তলায় ছিলাম। ওই সময় রেস্টুরেন্টে প্রায় ২৫ জন স্টাফ ও ২০ জনের মতো কাস্টমার ছিলেন। কাস্টমারদের মধ্যে প্রায় ১৫ জন বিদেশি ও পাঁচ থেকে ছয়জনের মতো বাংলাদেশি ছিলেন। আমি পালিয়ে আসার সময় একজনের হাতে অস্ত্র দেখেছি। আমার অন্য সহকর্মীরা জানিয়েছেন, হামলাকারীর সংখ্যা সাত থেকে আট জনের মতো হবে। তাদের সবার বয়সই হবে ২০ থেকে ২৬ বছরের মধ্যে। রেস্টুরেন্টে ঢুকেই তারা এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। আমি পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে দেয়াল টপকে পালিয়ে আসতে পেরেছি। হামলা শুরুর পর পালাতে ২০ মিনিটের মতো লেগেছে আমার। দেয়াল টপকানোর সময় কাটাতারে লেগে হাত ছিড়ে গেছে বলেও জানান সিজান।
প্রাণে বেঁচে যাওয়া হলি আর্টিজান বেকারির জুসবারের এক কর্মী জানান, প্রথমে হামলা হওয়ার পর কেউ বুঝেই উঠতে পারেনি কী হতে চলেছে। তবুও তিনি চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সন্ত্রাসীরা গুলি চালালে আমি পেছন দিকে দৌড়ে রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকে পড়ি। ভেতরে সবাইকে বিষয়টি সম্পর্কে জানাই। আমার কাছ থেকে শুনে অনেক পালাতে চেস্টা করেছে। সন্ত্রাসীদের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কেও তখন কেউ বুঝে উঠতে পারেনি। ওনাদের (সন্ত্রাসীদের) যদি ডাকাতির বা লুটপাটের উদ্দেশ্য থাকতো তাহলে তাদের হাতে অনেক সময় ছিল। প্রশাসন তাদের অনেক সময় দিয়েছে। চাইলেই পারতো ওইসময়ের মধ্যেই বের হয়ে যেতে। শুরুতে একটু চিৎকার চেঁচামেচি হয়েছিল। কিন্তু যখন দ্বিতীয় ব্যক্তি ভেতরে ঢুকলো তখনই আমাদের সিকিউরিটিকে গুলি করা হলো। সিকিউরিটি গার্ডকে গুলি করার সঙ্গে সঙ্গে তারা তিন চারজন ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। ভেতরের ২০-২৫ জন গেস্ট ছিল। সন্ত্রাসীরা রেস্টুরেন্টে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর কিছুক্ষণ লাইট জ্বালানো ছিল। তারপর লাইন বন্ধ করে সিসি ক্যামেরাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর কালো পর্দা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। কিন্তু ওই কালো পর্দা কোথায় পেল সেটা তারা জানাতে পারেনি।
প্রসঙ্গত, জিম্মি সংকট অবসানে রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে 'অপারেশন থান্ডারবোল্ট' পরিচালনা করা হয়। শনিবার সকালের এই অভিযানের পর ২০টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের সবাই বিদেশি এবং অভিযানের আগেই তাদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলাকেটে হত্যা করা হয়। মরদেহগুলো ময়নাতদন্তের জন্য সিএমএইচে পাঠানো হয়েছে। অভিযানের সময় ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে তিনজন বিদেশি নাগরিক। এর মধ্যে দুইজন শ্রীলঙ্কার ও একজন জাপানের নাগরিক। তবে চূড়ান্ত অভিযানে অংশগ্রহণকারী কোনও কমান্ডো আহত হননি। অভিযান চলার সময় ৬ হামলাকারী নিহত হয় এবং সন্দেহভাজন একজনকে আটক করা হয়। শুক্রবার রাতে নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তা, জিম্মি ও হামলাকারী মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা ২৮ জন। এক সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্য জানিয়েছেন সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশন্সের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরী।
/সিএ/এপিএইচ/
আরও পড়ুন:
জঙ্গিবাদ সংকটে সম্মিলিত প্রতিরোধ চায় রাজনৈতিকদলগুলো
‘হামলাকারী সাত-আট জন, তখন কাস্টমার ছিল প্রায় ২০ জন’
কমান্ডো অভিযানে মাত্র ১০ ঘণ্টার মধ্যে গুলশানে জিম্মি সংকটের অবসান: প্রধানমন্ত্রী