বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়ে ফিরে আসার পর শঙ্কায় পড়েছেন র্যাবের নিখোঁজ তালিকায় থাকা ব্যক্তিরা। পুলিশ, গোয়ন্দা পুলিশ, র্যাবের ধারাবাহিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা এখন অজানা ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন।
কেউ কেউ বলছেন, প্রতিবেশীরাও তাদের সন্দেহের চোখে দেখছেন। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষের আস্থা অর্জন, সাহস দেওয়া, মানুষকে নির্ভয়ে রাখা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ। দূর্ভাগ্যজনক হলো, আমাদের সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, র্যাবের তালিকা প্রকাশের কারণে সাধারণ মানুষের ভেতরে যে ভয় তৈরি হয়েছে, তা জঙ্গিনিরোধ কাজে সহায়ক হবে না।
নিখোঁজ হয়ে ছয়মাস আগে বাড়ি ফিরে আসলেও র্যাবের নিখোঁজ তালিকায় নাম ওঠায় নতুন করে শঙ্কায় পড়েছেন চাঁদপুরের সানাউল্লাহ। র্যাবের প্রকাশিত নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকার ৫৩ নম্বরে নাম রয়েছে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার চিলারচর এলাকার সানাউল্লাহর।
জানুয়ারি মাসে ঢাকায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে তিনি প্রায় দুদিন নিখোঁজ ছিলেন। গত ৫ জানুয়ারি রমনা থানায় তার পরিবার জিডি করে। এর একদিন পর সানাউল্লাহ বাড়িতে ফিরে আসেন। তারপরও তার নাম রয়েছে র্যাবের নিখোঁজ তালিকায়।
কেবল সানাউল্লাহই নন, নানা শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন ইতোমধ্যে ফিরে আসা অনেকেই। অভিভাবকরা কী করবেন, তা নিয়েই ব্যতিব্যস্ত তারা ।
রংপুরে বাসায় না জানিয়ে ঘুরতে যাওয়া এক সন্তানের অভিভাবক বলেন, সন্তান চলে যাওয়ার পর থানায় জিডি করেছিলাম। ফিরে আসার পর জিডির কপিও থানা থেকে তুলে এনেছি। তারপরও কেন তালিকায় নাম উঠলো জানি না।
এদিকে, অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঝিনাইদহ ও রংপুরের ৩৮ জনের মধ্যে ৩০ জনই বাড়িতে আছেন। র্যাবের তালিকায় ঝিনাইদহের ২৯ জনের নাম পাওয়া গেছে। তার মধ্যে পাঁচজন বাদে সবাই নিজ নিজ বাড়িতে আছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে নাচোলের একজন ঈদের আগের দিন নিখোঁজ হন। এক সপ্তাহ পর ফিরে আসলে জানা যায়, তাকে অপহরণ করে টেকনাফে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এখন কী অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিবেশীরা ঠিক কীভাবে দেখছেন, সবাই বিশ্বাস করছেন কিনা জানি না। কিন্তু এ কয়দিন আমার ওপর যে অত্যাচার নির্যাতন হয়েছে, তা আমি সবাইকেই জানিয়েছি। নিজে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু এখনও ভয় কাটেনি।
এদিকে, র্যাবের তালিকায় ফেনীতে নিখোঁজ ১১ জনের মধ্যে আটজনের পরিবার ফেনী মডেল থানায় জিডি করেছিল। তার মধ্যে সাতজনই উদ্ধার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন ফেনী মডেল থানার ওসি মাহবুব মোর্শেদ।
১ জুলাই ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি ও ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলার পর জানা যায়, নিহতরা দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। এরপর দেশ জুড়ে শুরু হয় নিখোঁজদের তালিকা ধরে অনুসন্ধান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ভাড়াটিয়াদের তথ্য ও তালিকা চাওয়া হয়।এর পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব দেশজুড়ে ২৬২ জনের একটি নিখোঁজ তালিকা প্রস্তুত করে প্রকাশ করে। পরে এ তালিকার সঠিকতা নিয়ে সৃষ্টি হয় বিভ্রান্তি।
নিজেদের তালিকাকে সঠিক দাবি করে র্যাবের মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এসব নিখোঁজের ঘটনা সব অফিসিয়াল ডকুমেন্ট। সেভাবেই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তালিকা প্রকাশে আরও যাচাই-বাছাই করা যেতো কি না প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যে যাচাই-বাছাইয়ের কথা বলা হচ্ছে, তা করতে হলে আমাদের একবছর সময় লেগে যেতো।
আইন ও শালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সব থানার জিডির সূত্র ধরে একটি তালিকা করে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এই তালিকার অনেকেই বাড়ি থেকে বিভিন্ন কারণে পালিয়েছেন। আবার কেউ জঙ্গিপনার জন্যও পালিয়ে থাকতে পারেন। যে জিনিসটা করা দরকার ছিল, এই জিডির সূত্র ধরে অনুসন্ধান পরবর্তীতে বলা উচিত ছিল, এই জিডির মধ্যে কাদের সন্দেহ তালিকায় রাখা হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমার জানা মতে, এই কাজটি পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ করেছিল।কিন্তু হঠাৎ করেই র্যাব তালিকা প্রকাশ করে ফেললো।
নূর খান মনে করেন, কাজ শেষ না হতেই এ ধরনের তালিকা প্রকাশ করায় যাদের নাম এসেছে, তারা সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছেন,সন্দেহের চোখ পড়ছে তাদের দিকে। এমন কী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমন প্রশ্ন করছে তাতে ফিরে আসা মানুষগুলো ও তাদের অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন ও ভীত হয়ে পড়ছেন।
/ইউআই/এবি/