মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মুসলিম গ্রামগুলোয় দেশটির সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর এখন সেখানে সুনসান নীরবতা। আর বাতাসে শুধুই মানুষের লাশ পচা গন্ধ। সেখান থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নারী-পুরুষরা এই কথাই জানাচ্ছেন। তাদের দাবি, এখনও গ্রামগুলোতে সেনাবাহিনী ও মগরা পাহারা দিচ্ছে। বুধবার পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষরা বাংলা ট্রিবিউনকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
মংডুর পূর্ব পাশের একটি গ্রামের নাম খাইন্দা পাড়া। সেখানের বাসিন্দা নূর আলম (৪০)। তারা চার ভাই পরিবার নিয়ে বুধবার নাফ নদী পাড় হয়ে শাহপরীর দ্বীপ হয়ে টেকনাফে প্রবেশ করেন। নূর আলমের অন্য ভাইরা হলেন- আবুল হাশেম, নূর হাকিম ও ইসমাইল। বড় তিন ভাই বিবাহিত। ছোট ভাই এখনও বিয়ে করেনি।
নূর আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের গ্রামের নাম খাইন্দা পাড়া। এ মাসের ৭ তারিখে মিয়ানমার সেনাবাহিনী আমাদের গ্রামে আগুন দেয়। তখন আমরা আমাদের পাশের গ্রাম মগ্নিপাড়ায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এরপর তিনদিন আগে আমরা বাংলাদেশের দিকে রওনা হই। মগ্নিপাড়া থেকে নাফ নদীর পাড় দিয়ে আসতে দুইশ গ্রাম আমাদের সামনে পড়েছে। এগুলো সবই পুড়ে গেছে। আমরা যখন গ্রামের জঙ্গল দিয়ে হাঁটছিলাম তখন পচা ও পোড়া গন্ধ পাচ্ছিলাম। মানুষের লাশ, রক্ত, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি মরে পচে এমন গন্ধ ছড়াচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নাসাকার লোকজন এখনও গ্রামে আছে। তবে আগের মতো দলে দলে নেই। এখন আর পোড়ানোর কিছু নেই। সেনাবাহিনী এখন খালি গ্রাম পাহারা দিচ্ছে।’
কাদির বিল এলাকার বাসিন্দা আবু তালেব (৫২)। তার বাবার নাম মো. ইয়াকুব। তার বাবা বেঁচে নেই। এক ভাই ও চার বোন তার। বোনরা সবাই বিবাহিত। তার স্ত্রীর নাম হামিদা খাতুন। চার ছেলে ও তিন মেয়ে নিয়ে তিনি বুধবার বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের গ্রামে ১৬ সেপ্টেম্বর আগুন দেওয়া হয়। এরপর রাতেই বাড়ি থেকে বের হয়ে অন্য গ্রামে চলে যাই। নলবুনিয়া নামক গ্রামে ৭/৮ দিন ছিলাম। সেখানেও আগুন দেয়, তারপর বাংলাদেশে চলে আসি।’
তিনি বলেন, ‘যেসব গ্রামে আগুন দিয়েছে সেসব গ্রামে কোনও মানুষ নেই। সব খালি। ঘর বাড়ি কিছু নেই। সব মাটির সঙ্গে মিশে আছে। চাল, ডাল, পরে আছে। গরু মরা খালে ভাসছে, মানুষের লাশ পরে আছে। সেগুলো এখনও পরিষ্কার করা হয়নি। সারা গ্রামে গন্ধ।’
আরাফা খাতুন (২৫) নামে এক নারী বলেন, ‘আমার গ্রামের নাম খাইল্যাপাড়া। আমাদের গ্রামে প্রথম আগুন দেওয়া হয়। এরপর আমি আমার স্বামী, চার ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে পালিয়ে আমার বোনের বাড়ি চলে যাই। সেখানে কোনও আগুন দেয়নি। আমাদের এক পরিবারে ৮ জন। আমরা ১৯ সেপ্টেম্বর সকালে টেকনাফে আসি। আসার পথে আমরা তিনদিন শুধু পানি খেয়ে হেঁটেছি।’
তিনি গ্রামগুলোর বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘কোনও গ্রামে মানুষ নেই। মনে হচ্ছে একটু আগে সব তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষের খাবার পরে আছে। গরু মরে আছে, মানুষের শরীরের অঙ্গ পড়ে আছে। শুধু পচা গন্ধ।’
এদিকে, এখনও বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন রোহিঙ্গারা। নাফ নদী পার হয়ে আসা রোহিঙ্গারা টেকনাফে জমা হয় প্রতিদিন রাতে। সেখান থেকে সকালে তারা ক্যাম্পে চলে যায়। এখন টেকনাফের সীমান্ত এলাকায় বিজিবি ও মিয়ানমারের বিজিপি টহল শিথিল করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ২৪ আগস্ট রাতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কিছু চৌকিতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর দেশটির সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে অভিযান শুরু করে। রাখাইন রাজ্যের গ্রামগুলোতে আগুন দেওয়ার অভিযোগ করেছেন রোহিঙ্গারা। গুলি ও আগুনে পুড়ে কয়েক হাজার রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় চার লাখ ৯০ হাজার রোহিঙ্গা। যাদের প্রায় প্রত্যেকেরই স্বজন হারিয়েছেন।
আরও পড়ুন:
এখনই স্কুলে যাওয়ার যোগ্য বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া এক লাখ রোহিঙ্গা শিশু
নাইক্ষ্যংছড়িতে ত্রাণবাহী ট্রাক উল্টে ৬ জন নিহত
অপুষ্টির শিকার হচ্ছেন গর্ভবতী রোহিঙ্গা নারীরা