X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

‘নিষিদ্ধ শ্রমে’ নির্যাতনের শিকার শিশুরা

জাকিয়া আহমেদ
১৪ অক্টোবর ২০১৭, ১১:০৯আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০১৭, ১১:৪০

‘নিষিদ্ধ শ্রমে’ নির্যাতনের শিকার শিশুরা (ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত) নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে যাত্রামুড়া এলাকায় ‘জোবায়দা টেক্সটাইল’ মিলে শিশু শ্রমিক সাগর বর্মণের পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছিল গত বছরের ২৪ জুলাই। সাগরের মৃত্যুর পর জানা যায়, কারখানার প্রশাসনিক কর্মকর্তা নাজমুল হুদার কাজই ছিল শ্রমিকদের হেনস্তা করা ও শাস্তি দেওয়া।

গত ১৫ জুলাই সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার ভদ্রঘাটে এসিআই-গোদরেজ এগ্রোভেট ফিড মিলে শিশু শ্রমিক কাইয়ুমের পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। কাইয়ুমকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে অংশ নিতে বললে সে রাজি হয়নি। এই কারণে শিশুটির পায়ুপথে ভ্যাকুয়াম মেশিনের নল দিয়ে বাতাস দিতে থাকলে তার পেট ফুলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে তাকে উদ্ধার করে বগুড়া শজিমেক হাসপাতালে পাঠানো হয় এবং দীর্ঘ চিকিৎসার পর সে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে।

শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পরও দেশে প্রতি ছয় জন শ্রমিকের একজন শিশু। শুধু তাই নয়, জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজের ২৫ শতাংশই করে শিশুরা। বাসাবাড়িতে যারা কাজ করে তাদের ৩৭ শতাংশও শিশু। এই শিশুদের বেশির ভাগেরই বয়স পাঁচ থেকে ১৪ বছর।  বাসাবাড়িতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, টেম্পু হেলপার, ময়লা ফেলার কাজ, মাদক ও অস্ত্র আনা নেওয়া করা, ইটভাটার কাজ, জাহাজ ও পাথর ভাঙা, লেদ মেশিন কারখানায় ও ওয়েল্ডিং কারখানায় ঝালাই এর কাজসহ নানা ধরনের কাজে যুক্ত শিশুরা। আর কর্মক্ষেত্রে শিশুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা বলতে গেলে অহরহ বিষয়ে পরিণত হয়েছে।    

কাঁঠালবাগান ঢালে একটি ওয়েল্ডিং কারখানায় কাজ করে ৯ বছরের শাহিন। বগুড়ার ধুনট থেকে আসা শাহিন বাংলা ট্রিবিউনকে জানায়, দেড় বছর আগে সে চাচার হাত ধরে ঢাকায় আসে। তারপর থেকে কাঁঠালবাগানের এই ঢালেই একটি ওয়েল্ডিং কারাখানায় ঝালাইয়ের কাজ করছে। শাহিন বলে, ‘সবসময় কাজ করতে ভালো লাগে না। কিন্তু কাজে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। আবার এমন হইছে, শরীরে অনেক জ্বর কিন্তু এরপরও কাজে আসতে হইছে। মালিক কাজ না করলে খুব খারাপ ভাষায় গালি দেয়, বাবা-মা তুলে বকা দেয় এমন ঘটনাও আমাদের দোকানে ঘটছে।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিশুশ্রম বিষয়টাই এক ধরনের নির্যাতন। তাই প্রথমত শিশুশ্রম বন্ধ করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি আইনের প্রয়োগ বাড়াতে হবে। যতক্ষণ না শিশুকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য মালিক পক্ষ এবং শিশুকে কাজে পাঠানোর জন্য অভিভাবকদের আইনের আওতায় আনা যাবে ততক্ষণ শিশুশ্রম বন্ধ হবে না।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম থেকে জানা যায়, গত পাঁচ বছরে পাশবিক নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ১৩ হাজার ১২টি শিশু। এরমধ্যে হত্যার শিকার হয়েছে এক হাজার ৫২৬ শিশু। আত্মহত্যা করেছে ৭২৭ জন এবং ধর্ষণের শিকার হয়েছে এক হাজার ৪৭৫ শিশু। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত আট মাসে ৩৯৯টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এ সময় হত্যা করা হয়েছে ২২২টি শিশুকে। এছাড়া অপহরণের শিকার হয় ৯৪টি শিশু।

শিশুশ্রম বন্ধের করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) এর নির্বাহী পরিচালক সুলতান উদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিশুরা প্রথম নির্যাতনের শিকার হয় তাদের বয়স্ক সহকর্মীদের মাধ্যমে। কাজ শেখানোর নামে চড়-থাপ্পড়সহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয় শিশুরা। এটা আমাদের একটি স্বাভাবিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। শিশুরা একদিকে যেমন মালিকদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়, তেমনি হয় তাদের বয়স্ক সহকর্মীদের দ্বারাও।’

‘শিশুকে যখনই কাজের জন্য বাড়ি থেকে বের করা হয়, তখন পুরো পরিবেশটাই তার জন্য নির্যাতনের পরিবেশে পরিণত হয় এটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে’ বলেও মন্তব্য করেন সুলতান উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আর এই বিষয়টাই ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে যখন সে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। আমাদের দেশে মেয়েদের যৌন নির্যাতন নিয়ে অনেক কথা হলেও ছেলে শিশু শ্রমিকরাও যে অনেক জায়গায় যৌন নির্যাতনের শিকার হয় সেটা উপেক্ষিত থেকে যায় সমাজে।’

দেশে ছেলে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৭৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মেয়ে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ বলেও জানান তিনি।

শিশুশ্রম নিরসনে আইনের প্রয়োগ নেই জানিয়ে সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কোনও শিশুকে কাজে নিয়োগ করার জন্য কোনও মালিকের শাস্তি বা জরিমানা হয়েছে এটা আমার জানা নেই। শিশুশ্রমকে পুঁজি করে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করে নিজেদের চাকরি, ভালো থাকা, বিদেশ যাওয়ার ব্যবস্থা করছি আমরা।’

সম্প্রতি শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু জানান, দেশে বর্তমানে ১৫ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে জড়িত। মন্ত্রী আরও জানান, ৪২টি ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্যে ৩৮টি কাজকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর এই ৩৮টি কাজে দেশের প্রায় ১২ লাখ শিশু জড়িত।

শিশু অধিকার ফোরামের সভাপতি এমরানুল হক চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০২৫ সালের মধ্যে কোনও শিশুশ্রম থাকবে না বলে সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে। এর মধ্যে ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধ করতে হবে। এজন্য সরকার বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা নিয়েছে। কিন্তু সেটা কতটুকু সফল হবে সেটা ভিন্ন বিষয়। আগে এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলোকে চিহ্নিত করে এসব শিশুরা কোথা থেকে আসছে, কেন আসছে-সেগুলো আগে বের করতে হবে। শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ দেওয়া যাবে না, তাই যারা শিশুদেরকে নিয়োগ দেন তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে সরকারকে বাজেট করে শিশুশ্রমিক, তাদের অভিভাবক ও নিয়োগকর্তাদের চিহ্নিত করে পরিকল্পিত কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। তাহলে ২০২১ সালের মধ্যে ১৩ লাখ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে বের করা কোনওভাবেই কঠিন কিছু নয়। এজন্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা খুব জরুরি। আইনের পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগ করতে হবে। তাহলেই শিশুশ্রম বন্ধ হবে এবং বন্ধ হবে কর্মক্ষেত্রে শিশুদের ওপর নির্যাতন।’

আরও পড়ুন- শিশুশ্রম নিরসন: টার্গেট কাগজে কলমেই

/জেএ/এফএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
রেল ও সড়ক বিটের রিপোর্টারদের সংগঠনের নতুন কমিটি
রেল ও সড়ক বিটের রিপোর্টারদের সংগঠনের নতুন কমিটি
কঙ্গোর বাস্তুচ্যুত শিবিরে হামলা, নিহত ৯
কঙ্গোর বাস্তুচ্যুত শিবিরে হামলা, নিহত ৯
প্রতীক বরাদ্দের আগেই পোস্টার ও প্রচারণা
প্রতীক বরাদ্দের আগেই পোস্টার ও প্রচারণা
বিসিএসে সফলতায় এগিয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা
বিসিএসে সফলতায় এগিয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা
সর্বাধিক পঠিত
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
নদীতে ধরা পড়ছে না ইলিশ, কারণ জানালেন মৎস্য কর্মকর্তা
নদীতে ধরা পড়ছে না ইলিশ, কারণ জানালেন মৎস্য কর্মকর্তা