X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

উচ্ছেদে অনীহা রাজউকের

শাহেদ শফিক
১৩ নভেম্বর ২০১৭, ১২:৪১আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০১৭, ১৯:৫৫

রাজউক ভবন, ফাইল ছবি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও প্রভাবশালীদের অনৈতিক তদবিরে উচ্ছেদে অনীহা দেখা দিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউকের। এ কাজে পুলিশের সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ প্রতিষ্ঠানটির। আর পুলিশ বলছে, রাজউকের অভিযোগ সঠিক নয়। তাদের চাহিদা মতোই পুলিশ দেওয়া হয়। তবে রাজউকের নথিপত্র বলছে―উচ্ছেদের জন্য পুলিশ চাওয়া হলে চাহিদার এক চতুর্থাংশের বেশি পাওয়া যায় না।
রাজউক সূত্র জানিয়েছে,উচ্ছেদের জন্য প্রতিমাসের কিছু দিন নির্ধারণ করে পুলিশ চেয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বরাবরে আবেদন করা হয়। কিন্তু রাজউকের পক্ষ থেকে যতোদিন পুলিশ চাওয়া হয় তার চারভাগের একভাগও পাওয়া যায় না। অনেক সময় দেখা গেছে,রাজউক উচ্ছেদের যে দিনক্ষণ নির্ধারণ করে সে তারিখে হয় না। আবার কোনও কোনও সময় পুলিশ নিজেই ভিন্ন একটি দিন বা তারিখ নির্ধারণ করে ফোর্স পাঠায়।
নগরীতে আবাসিকের অনুমোদন নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে ভবন পরিচালনা,নকশা বহির্ভূত ভবন নির্মাণ,রাজউকের জমি দখলসহ নানা অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এসব অনিয়মের ফলে বিভিন্ন সময় নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড ও দুর্ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু এ নিয়ে চরম উদাসীনতা দেখায় রাজউক।
গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর ২৫ জুলাই নিরাপত্তার স্বার্থে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক ভবনের বিরুদ্ধে এক যোগে অভিযান শুরু করে রাজউক। রাজউকের ওই অভিযান অনেকের ঘুম হারাম করে দেয়। অভিযানটি ছিল রাজউকের এক ধরনের জেগে উঠা। কিন্তু ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে শুরু করা অভিযানটি বেশি দিন এগোয়নি। এর পেছনে রাজউকের হাতকেই দায়ী করছেন অনেকেই।
রাজধানীর বাসাবোর বাসিন্দা মনছুর আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,আমি রাজউকের সব আইন মেনেই বাড়ি নির্মাণ করেছি। কিন্তু পাশের বাড়িঅলা রাজউক অনুমোদিত নকশা বহির্ভূত ভবন নির্মাণ করছে। তার বাড়ি রাস্তা পর্যন্ত চলে এসেছে। এলাকার অন্তত দুশ’ লোকের স্বাক্ষর নিয়ে রাজউকের অভিযোগ জানিয়েছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা কেউ আসেনি। পরে শুনেছি বাড়ি মালিক মোটা অংকের টাকা দিয়ে উচ্ছেদ বন্ধ করে রেখেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গোড়ানের এক বাড়িমালিক বলেন,‘টাকা দিলেই সব ঠিক হয়ে যায়। আমার বাড়িতে একটু সমস্যা ছিল। রাজউক নোটিশ করেছে। দেখা করে এসেছি। এখন আর ঝামেলা করে না।’
সূত্র জানায়,গুলশানে জঙ্গি হামলার পর নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক ভাবনায় ফেলেছিল প্রশাসনকে। সরকারের উচ্চপর্যায়সহ ওই বছরের ১০ জুলাই সচিবালয়ে আইন-শৃঙ্খলাসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির জরুরি বৈঠকে অনুমোদনহীন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। কিন্তু এরপর হাতে গোনা কয়েকটি অভিযান করে থেমে যায় রাজউক। এর আগেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে রাজধানীর আবাসিক এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী নিজেই এসব ভবন উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
রাজউক সূত্র জানিয়েছে,গুলশান হামলার পর গত বছরের ১৮ জুলাই রাজউক পরিচালক (প্রশাসন) দুলাল কৃষ্ণ সাহা একই মাসের ২৪ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত রাজউকের তিনটি অঞ্চলে সর্বমোট ৬৩ দিন উচ্ছেদ পরিচালনার জন্য পুলিশ ফোর্স চেয়ে পত্র দেন। এর মধ্যে জোন-২ এর উত্তরা আবাসিক এলাকার জন্য ২১ দিন, জোন-৪ এর গুলশান, বনানী ও বারিধারা আবাসিক এলাকার জন্য ২১ দিন এবং জোন-৫ এর ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার জন্য ২১ দিন পুলিশ চাওয়া হয়েছে।
কিন্তু এর মধ্যে জোন-২ এর উত্তরা আবাসিক এলাকা এবং জোন-৪ এর গুলশান বনানী ও বারিধারা জন্য ২১ দিন করে ৪২ দিনের পরিবর্তে মাত্র ৫ দিন করে ১০ দিন পুলিশ ফোর্স বরাদ্দ পাওয়া গেছে। জোন-৫ এর ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার জন্য পাওয়া গেছে ৬ দিন। সর্বমোট ৬৩ দিনের পরিবর্তে পুলিশ পাওয়া গেছে ১৬ দিন।
একই চিত্র দেখা গেছে চলতি বছরের জানুয়ারিতেও। ওই মাসজুড়ে রাজউক তার চারটি জোনে পৃথকভাবে উচ্ছেদের জন্য প্রতিদিন এক প্লাটুন পুলিশ চেয়ে আবেদন করে। এজন্য গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর রাজউকের পরিচালক (প্রশাসন) সুশান্ত চাকমা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার বরাবরে আবেদন করেন। এর মধ্যে ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত রাজউকের জোন-২ এর উত্তরা আবাসিক এলাকায় ১৯টি দিন,২ জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত জোন-৪ এর গুলশান,বনানী ও বারিধারা আবাসিক এলাকায় ১৮ দিন, ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত জোন-৩ এর মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও পল্লবী এলাকায় ১৯ দিন এবং ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত জোন-৫ এর ধানমন্ডি ও লালমাটিয়া আবাসিক এলাকায় ১৮ দিন পুলিশ চাওয়া হয়েছে।
কিন্তু ওই মাসের ৭ তারিখে ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (অপারেশনস) মো. সেলিম খান স্বাক্ষরিত ফিরতি পত্রে প্রতিটি অঞ্চলের জন্য ৪দিন করে পুলিশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি অঞ্চলে উচ্ছেদ কার্যক্রমের জন্য ১৮ থেকে ১৯ দিনের মধ্যে মাত্র ৪ দিন যথেষ্ট নয় বলে মনে করছে রাজউক।
রাজউক বলছে, উচ্ছেদ অভিযানে প্রয়োজনীয় সহায়তা পায় না তারা শুধু গত বছরের জুলাই আগস্ট কিংবা চলতি বছরের জানুয়ারি মাস নয়, প্রতি মাসেই এমন চিত্র দেখা গেছে। কোনও মাসেই ১০টি অঞ্চলের জন্য দুই থেকে ৬ দিনের বেশি পুলিশ পাওয়া যায়নি। আর গত দুই মাসে উচ্ছেদের কোনও তথ্যও পাওয়া যায়নি।
অভিযোগ উঠেছে, উচ্ছেদ কাজে মূলত রাজউকেরই অনীহা বেশি। পুলিশ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু রাজউক পুলিশ চাওয়ার পর চাহিদা অনুযায়ী পাওয়ার জন্য আর কোনও যোগাযোগ রক্ষা করে না। আর যে কয়দিন পুলিশ পায় সে কয়দিনও শুধু ফুটপাতের র্যা ম্প (ওঠা-নামার স্থান) ভাঙা, কিছু টাকা জরিমানা ও আইন ভঙ্গকারীদের কয়েকদিন সময় বেঁধে দেওয়া ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনও অভিযান হচ্ছে না।
নগরীতে শত শত অনুনোমদিত ভবন থাকলেও এ যাবত একটি ভবনও উচ্ছেদ করেনি তারা। উপরন্তু উচ্ছেদের ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বাড়িমালিক থেকে উৎকোচ আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে। কী পরিমাণ অবৈধ ভবন রয়েছে তারও কোনও তালিকা নেই সংস্থাটির কাছে।
তবে উচ্ছেদ বিষয়ে কোনও কথা বলতে রাজি নন সংস্থার এ সংক্রান্ত দায়িত্বে থাকা পরিচালক-১ (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রক) ড. মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,কথা বলার জন্য অথরিটি আমাকে দায়িত্ব দেয়নি। এ জন্য আমি কিছুই বলতে পারবো না।
জানতে চাইলে রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) আসমা উল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রতিমাসে ফোর্স চেয়ে পুলিশের কাছে একটা চাহিদাপত্র দিই। চাহিদাপত্রে অন্তত ১৫ থেকে ২০ দিন উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত থাকে। কিন্তু মাত্র ৪-৫ দিনের বেশি পুলিশ ফোর্স পাওয়া যায় না। এটা আসলে যথেষ্ট নয়।’ তবে আগামীতে এ সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে আশ্বাস পাওয়া গেছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা পুলিশ বাড়ানোর বিষয়ে রাজউকের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়- রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে পুলিশের ব্যস্ততা থাকে। তাছাড়া শুধু রাজউক নয়, অন্যান্য সেবা সংস্থার কাজেও পুলিশ প্রয়োজন হয়। তাদেরকেও পুলিশ দিতে হয়। যে কারণে অনেক সময় চাহিদা মতো পুলিশ দেওয়া সম্ভব হয় না। এখন সব সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে পুলিশ দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (অপারেশন) মো. সেলিম খান অভিযোগ অস্বীকার করে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, রাজউকের অভিযোগ সঠিক নয়। তারাও সরকারি প্রতিষ্ঠান আমরাও সরকারি প্রতিষ্ঠান। তাদের চাহিদা মতোই উচ্ছেদের কাজে পুলিশ দেওয়া হচ্ছে।

/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
একই উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী মা-ছেলে ও নাতি
একই উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী মা-ছেলে ও নাতি
আজকের আবহাওয়া: ঢাকাসহ ৬ বিভাগে ঝড়ো হাওয়াসহ শিলাবৃষ্টির আভাস
আজকের আবহাওয়া: ঢাকাসহ ৬ বিভাগে ঝড়ো হাওয়াসহ শিলাবৃষ্টির আভাস
যশের ছবিটি ছেড়ে দিলেন কারিনা!
যশের ছবিটি ছেড়ে দিলেন কারিনা!
গাম্বিয়ার কৃষি খাতে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির বিষয়ে আলোচনা
গাম্বিয়ার কৃষি খাতে বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির বিষয়ে আলোচনা
সর্বাধিক পঠিত
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
নবম পে-স্কেল বাস্তবায়নসহ সাত দফা দাবি সরকারি কর্মচারীদের
নবম পে-স্কেল বাস্তবায়নসহ সাত দফা দাবি সরকারি কর্মচারীদের
মিল্টনের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতদের এখন কী হবে
মিল্টনের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতদের এখন কী হবে