X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১
বাংলা ট্রিবিউন অনুসন্ধান

কওমি শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য, শীর্ষে হাটহাজারী মাদ্রাসা

সালমান তারেক শাকিল
২৬ জানুয়ারি ২০১৮, ২১:৫০আপডেট : ২৭ জানুয়ারি ২০১৮, ১৩:৩০

কওমি মাদ্রাসায় বেতন কাঠামো

কওমি মাদ্রাসার আট মূলনীতিতে (দারুল উলুম দেওবন্দের উসূলে হাশতে গানা) প্রতিষ্ঠানের আয়ের বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হলেও আর্থিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কোনও নীতিমালা নেই। বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসার ইতিহাস প্রায় সোয়াশ’ বছর হলেও এই সময়ের মধ্যে কোনও প্রতিষ্ঠান বা বোর্ডই বেতনকাঠামো তৈরি করেনি। ফলশ্রুতিতে কওমি ও হেফজ মাদ্রাসা মিলিয়ে প্রায় ১৩ হাজার মাদ্রাসায় শিক্ষকদের বেতনে সৃষ্টি হয়েছে বেহিসেবি বৈষম্য। শহরের বড় মাদ্রাসার প্রধানরা যেখানে ৩০ থেকে ৯০ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসিক বেতন নেন, সেখানে গ্রামের মাদ্রাসার প্রিন্সিপালদের বেতন সাকুল্যে ছয় হাজার টাকা। শহর-মফস্বল ও গ্রামভেদে এই বৈষম্য বিদ্যমান থাকলেও বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক) বলছে, সহসাই কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষকদের বেতন কাঠামো তৈরির কোনও সম্ভাবনা নেই।

কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকরা বলছেন, মাদ্রাসার মুহতামিম (প্রিন্সিপাল) প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন, জমি ক্রয়সহ অন্যান্য উন্নয়নের প্রতি যে জোর দেন, শিক্ষকদের বেতনের বেলায় সেটি অনুপস্থিত। সে কারণে অর্থনৈতিকভাবে কোনও কোনও মাদ্রাসা স্বাবলম্বী হলেও বছরের পর বছর ধরে শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো হয় না।

কওমি মাদ্রাসা সংক্রান্ত বইপত্র ও দায়িত্বশীলদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কওমি মাদ্রাসার আয়ের খাত ব্যক্তিবিশেষের দান এবং চাঁদার ওপর নির্ভরশীল থাকলেও সুনির্দিষ্ট আর্থিক আয়ের খাত অপ্রতুল। কওমি মাদ্রাসাগুলোর মূলকেন্দ্র ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের আট নীতিমালায়ও এ সংক্রান্ত নির্দেশনা নেই। এ কারণে সারাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষকদের বেতন-সংক্রান্ত কাঠামো তৈরি হয়নি। এমনকি ছাত্রদের কাছ থেকে ভর্তি ফি’র বাইরে মাসিক বেতন গ্রহণ করা হলেও এ বিষয়েও কোনও নীতিমালা নেই।

ঢাকার মোহাম্মদপুরে  জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা

উনিশ শতকের শুরুতে এ অঞ্চলে কওমি মাদ্রাসা স্থাপিত হওয়ার পর থেকে কোনও প্রতিষ্ঠান এবং কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠার প্রায় ৪০ বছর পার হলেও  শিক্ষকদের বেতনের নীতিমালা করার প্রয়োজন মনে করেনি।

বাংলা ট্রিবিউনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতন বৈষম্যের নানা চিত্র। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে জেলা, মফস্বল এবং গ্রামাঞ্চলে মাদ্রাসার শিক্ষকদের মধ্যে বেতনের কোনও নীতিমালা নেই। রাজধানীর কোনও কোনও কওমি প্রতিষ্ঠানে সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে শুরু করে ৪৩ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন দেওয়া হয় শিক্ষকদের। আর মফস্বল কিংবা গ্রামের মাদ্রাসাগুলোর চিত্র আরও বেশি ভিন্ন। সেখানে সর্বোচ্চ বেতন ১৫ হাজার হলে সর্বনিম্ন সাড়ে ৪ হাজার। এক্ষেত্রে গত ১০-১২ বছরে শিক্ষকদের বেতন দ্বিগুণ হার বেড়েছে। যদিও বাজারমূল্যের দিক থেকে এই বৃদ্ধি খুব নগণ্য বলে মনে করছেন কওমি শিক্ষকরা।

রাজধানীর বড় কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ মাদ্রাসা। এই প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ ৪২ হাজার বেতন দেওয়া হয় হাদিসের শিক্ষককে (মুহাদ্দিস)। আবার সর্বনিম্ন বেতন হিসেবে ১০-১২ হাজার টাকা। বড় মাদ্রাসাগুলোর ক্ষেত্রে নিয়মিত বেতন দেওয়া হলেও ছোট মাদ্রাসা এবং গ্রামাঞ্চলে প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে প্রতিমাসের বেতন অন্যমাসে, কোনও কোনও প্রতিষ্ঠানে দুই মাস অন্তর দেওয়া হয়। ফরিদাবাদ মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আবদুল কুদ্দুছ বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তার মাদ্রাসায় প্রতিমাসের ১০ তারিখের মধ্যে বেতন দেওয়া হয়।

রাজধানীর আজিমপুর গোরস্তানসংলগ্ন ফয়জুল উলুম মাদ্রাসা। প্রয়াত খতিব উবায়দুল হক প্রতিষ্ঠিত এই মাদ্রাসায় সর্বোচ্চ ৩০ হাজার, সর্বনিম্ন ১৩ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক রয়েছেন ২৩ জন । এই মাদ্রাসার একজন হাদিসের শিক্ষক বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ১৩ হাজার টাকার নিচে কোনও শিক্ষককে বেতন দেওয়া হয় না। এই মাদ্রাসায় প্রতি বছর কার্যকমের ওপর নির্ভর করে ইনক্রিমেন্টের ব্যবস্থাও আছে বলে জানান এই আলেম।

সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ মদীনাতুল উলুম মাদ্রাসা

রাজধানীর মোহাম্মদপুর জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ায় শিক্ষকদের বেতনের হার সর্বনিম্ন ৮ হাজার, সর্বোচ্চ ত্রিশ হাজারের নিচে।

রাজধানীতে  ছোট মাদ্রাসাগুলোতে বেতনের হার অনেক কম। মোহাম্মদপুর জামিয়াতুল আজিজ মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা এহসানুল হক জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের গড় বেতন ৮ হাজার থেকে ১৪ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে ৮, ৯, ১০  হাজার টাকা, এমন অংকে বেতন পান শিক্ষকরা। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রায় ৩০ জন শিক্ষক আছেন।’

অন্যদিকে, গ্রামের মাদ্রাসাগুলোর আর্থিক চরিত্র ও বৈশিষ্ট ভিন্ন নিয়মের। কোনও কোনও মাদ্রাসায় নিয়মিত মাসিক বেতন দিতে না পারলেও বার্ষিক ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে যে অনুদান ওঠে, সেখান থেকে মেটানো হয় শিক্ষকদের বেতন।

হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার হরষপুর দারুল উলুম মাদ্রাসা। এই প্রতিষ্ঠানে মুহতামিমের (প্রিন্সিপাল)বেতন ১০ হাজার টাকা। সর্বনিম্ন বেতন হিসেবে শিক্ষকদের কেউ কেউ সাড়ে ৪ হাজার টাকা বেতন পান। এই প্রতিষ্ঠানেও প্রতিমাসে বেতন দেওয়া সম্ভব না হলে মৌসুমভিত্তিক পাওয়া  অনুদানের ধান বিক্রি করে বেতন দেওয়া হয়। একইসঙ্গে বকেয়া বেতন বার্ষিক মাহফিল থেকে প্রাপ্ত অনুদান থেকে দেওয়া হয় বলে ওই প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষক বাংলা ট্রিবিউনকে জানান।

বেতনের বিষয়ে কথা হয় সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মদিনাতুল উলুম হজরত শাহমালুম (র.)পশ্চিম বাজার মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা ফখরুল ইসলামের সঙ্গে। ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে প্রতিষ্ঠানটির প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। মাওলানা ফখরুল ইসলামের মাদ্রাসাটি জামাতে কাফিয়া (দশম শ্রেণি) পর্যন্ত।  তিনি জানান, তার প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ বেতন ৬ হাজার এবং সর্বনিম্ন আড়াই হাজার টাকা। প্রতি মাসে বেতন দেওয়া সম্ভব হয় না তার পক্ষে। এ প্রসঙ্গে মাওলানা ফখরুল ইসলামের ভাষ্য, ‘প্রতি মাসেই বেতন দেওয়া সম্ভব হয় না। দুই মাস অন্তর, তিন মাস দমাইয়া (জমিয়ে) হঠাৎ করে দিয়া দিই। কোনও মাসে দেওয়া যায়। আর ফুরা (পুরো) বেতনই অনুদান থেক্কে আসে।’

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক ড. সৈয়দ শাহ এমরান তার এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, সারাদেশের ৬৪টি জেলার ৫২১টি উপজেলায় কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ৪ হাজার ৫৮৫টি এবং হেফজ মাদ্রাসার সংখ্যা ১২ হাজার ৬৬৭টি। এর মধ্যে রংপুর বিভাগে ২৭৫টি কওমি ও ১৫৫৩টি হেফজ মাদ্রাসা, রাজশাহী বিভাগে ৭৩৮টি কওমি  ও ১৫৪২টি হেফজ মাদ্রাসা রয়েছে। খুলনা বিভাগে ৩৮১টি কওমি ও ১৪৫৪টি হেফজ মাদ্রাসা, সিলেটে ৪৯৮টি কওমি ও হেফজ মাদ্রাসা রয়েছে ৭৮৩টি এবং চট্টগ্রাম বিভাগে ৯০৩টি কওমি ও ২৭৬০টি হেফজ মাদ্রাসা রয়েছে। ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি কওমি মাদ্রাসা রয়েছে, এর সংখ্যা হচ্ছে ১৫১৭টি। আর বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে কম সংখ্যক কওমি মাদ্রাসা আছে, সংখ্যা ২৭৩টি। ঢাকা বিভাগে রয়েছে সর্বোচ্চসংখ্যক হেফজ মাদ্রাসাও। এর সংখ্যা ৩ হাজার ৭১৩টি। বরিশালে হেফজ মাদ্রাসা ৮৭২টি। সংখ্যার দিক থেকে সিলেটে হেফজ মাদ্রাসার সংখ্যা কম। এই বিভাগে হেফজ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৭৮৩টি।

সংখ্যার হিসাবে বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা বোর্ডে যুক্ত আছে ৫৪৫১টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ঢাকায় ২৬৫৩টি, সিলেটে ৯০৪টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৮৪৪টি, খুলনা অঞ্চলে ৪৫৩টি,  রাজশাহী বিভাগে ৩৯৮টি, বরিশাল বিভাগে ১৭৬টি, রংপুর অঞ্চলে ৩টি মাদ্রাসা বেফাকের অধিভুক্ত।

কওমি মাদ্রাসা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর হেফজ বিভাগগুলোর সংশ্লিষ্ট হাফেজ-শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হেফজ বিভাগের ছাত্রদের থেকে বেতন নেওয়া হয়। সাধারণ কওমি মাদ্রাসাগুলোতে ছাত্রদের থেকে বেতন নেওয়ার শর্ত না থাকলেও হেফজ খানায় বেতন নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলের মাদ্রাসাগুলোর সঙ্গে শহরের এলিট প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্র ও শিক্ষকদের বেতনের মধ্যে বিস্তর ফাঁরাক রয়েছে। গ্রামে কোনও কোনও হেফজ বিভাগে ছাত্রদের বেতন মাসে ১৫০ থেকে ৪০০ টাকা হলেও রাজধানীতে সেটি কয়েক হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়।

২০১৩ সালে অধ্যাপক আবুল বারকাত একটি জরিপ করেছিলেন আলিয়া ও কওমি মাদ্রাসার ওপরে। ওই জরিপটি উদ্ধৃত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এম আকাশ তার ‘মাদ্রাসা শিক্ষার রাজনৈতিক অর্থনীতি’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘‘আলিয়া ও কওমি মাদ্রাসার যথাক্রমে ৭৬ শতাংশ এবং ৮৪ শতাংশ শিক্ষকেরই প্রধান অভিযোগ বেতনের নিম্ন হার। ড. বারকাতের মতে, এখানে সর্বনিম্ন বেতন হচ্ছে মাসিক ৪৬০০ এবং সর্বোচ্চ মাসিক ১১ হাজার টাকা। অন্যদিকে, কওমি মাদ্রাসায় যেহেতু কোনও বিধিবিধান নেই, সেখানে বেতনের বিষয়টি খুবই নমনীয়। যখন যেমন সংগ্রহ, তখন তেমন বেতন— এই ভিত্তিতে এই প্রতিষ্ঠানগুলো চলছে। ড. বারকাতের তথ্য অনুযায়ী তাদের সর্বনিম্ন আয় মাসিক ১৪৫০ এবং সর্বোচ্চ ৪৫০০ টাকা। লক্ষ্যণীয় যে, ড. বারকাত কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকদের আয়ের যে হিসাব দিয়েছেন সে অনুযায়ী নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, তারা প্রায় সবাই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন।’’

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দারুল আরকাম আল ইসলামিয়ার শিক্ষা ভবন

গত বছর ১৩ এপ্রিল সরকারিভাবে ‘আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়্যাহ’ গঠন করা হলেও কওমি মাদ্রাসার আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিতে কোনও পরামর্শ বা নির্দেশনা ছিল না। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের নির্দেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সহকারী সচিব আবদুস সাত্তার মিয়া স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে কমিশনের পরিধি কেবলমাত্র সনদ বিষয়ক সর্বোচ্চ সিদ্ধান্তগ্রহণকারী বলা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনের ৩ ধারার ৪টি উপধারায় কমিশনকে দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা গ্রহণ, ফলাফল ঘোষণা, সিলেবাস প্রণয়নসহ  সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো থাকলেও আর্থিক অবকাঠামো নির্মাণের বিষয়ে কোনও নির্দেশনা ছিল না। পরবর্তীতে এই কমিশনের কর্তাব্যক্তিরা গঠনতন্ত্র চূড়ান্ত করলেও শিক্ষকদের বেতনের কাঠামো নিয়ে কোনও আলোচনাই করেননি শীর্ষ আলেমরা।   

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সহ-সভাপতি মুফতি ফয়জুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের কমিশনের ব্যয় পরিপূর্ণভাবে সবগুলো মাদ্রাসা থেকে নির্বাহ করা হবে। এছাড়া, সার্টিফিকেট দেওয়া, পরীক্ষা আয়োজন, শিক্ষার্থীদের ফি হবে শিক্ষার্থীদের থেকে। মাদ্রাসা কিভাবে পরিচালিত হচ্ছে, লেখার পড়ার মান, আর্থিক বিষয় স্বচ্ছতার সঙ্গে হচ্ছে কিনা, সবই দেখার অধিকার আছে কমিশনের।’ তবে শিক্ষকদের বেতনের কোনও নীতিমালা করা হয়নি বলে জানান মুফতি ফয়জুল্লাহ।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুছ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাদ্রাসাগুলোতে আর্থিক ব্যবস্থাপনার কোনও নিয়ম নেই। যার যেরকম প্রতিষ্ঠান, সেভাবেই পরিচালিত হচ্ছে।’

ভবিষ্যতে করা হবে কিনা, এমন প্রশ্নে বেফাকের এই অন্যতম নীতিনির্ধারক বলেন, ‘এগুলো করা যায় কিনা, চিন্তা করা হয়নি।’

রাজধানীর একটি কওমি মাদ্রাসার একজন তরুণ শিক্ষক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ চাইলে বেতন বাড়াতে পারে। কিন্তু তারা তা করে না। যেহেতু কম বেতন দিলেও কেউ মাদ্রাসা ছেড়ে যান না, প্রতিবাদও করেন না, এসব কারণে কওমি শিক্ষকদের বেতন বাড়ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘মাদ্রাসাগুলোর অর্থনৈতিক টানাপড়েন আছে-এটা সত্যি, কিন্তু মুহতামিমদের অন্য প্রয়োজন মেটানোর যে প্রচেষ্টা থাকে, বেতন বাড়ানোর ক্ষেত্রে সে চেষ্টা থাকে না।’

বেতন বৈষম্যে এগিয়ে দেশের প্রথম কওমি মাদ্রাসা

বেতন বৈষম্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে দেশের প্রাচীন কওমি প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা। এই প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক হিসেবে আছেন বেফাকের সভাপতি আল্লামা শাহ আহমদ শফী।

হাটহাজারী মাদ্রাসার হিসাব বিভাগের একাধিক সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষকদের বেতনের কোনও কাঠামো নেই। কার বেতন কত টাকা, সেটা কেউ জানে না। এই প্রতিষ্ঠানে ৫-৬ হাজার টাকা থেকে শুরু হয়ে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন দেওয়া হয়।

হাটহাজারী মাদ্রাসা সূত্রের ভাষ্য, গত কয়েক বছরে বাজার দর বেড়ে যাওয়ায় বছরে বছরে  শিক্ষকদের ইনক্রিমেন্ট হয়েছে। সাধারণত হাটহাজারী মাদ্রাসায় প্রতি দুই বছর পর বেতন বাড়ানো হয়। 

মাদ্রাসার মহাপরিচালক আহমদ শফীর বেতন প্রায় এক লাখ টাকার কাছাকাছি হলেও তার পরের শিক্ষকদের বেতনের অংক অনেক নিচে। সূত্রের দাবি, আহমদ শফী বেতন ও মহাপরিচালক হিসেবে ভাতা মিলিয়ে প্রায় ৯০ হাজার টাকা পান।

যদিও জ্যেষ্ঠতার তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা প্রয়াত আল্লামা শামসুল আলমের বেতন ছিল ৬ হাজার টাকা।

এই মাদ্রাসায় তৃতীয় অবস্থানে আছেন শিক্ষা পরিচালক মুফতি নূর আহমদ। তার মাসিক বেতন ত্রিশ হাজার টাকার ওপরে। শিক্ষা সচিব হিসেবে ৬ হাজার টাকা বেশি ভাতা পান তিনি। 

মাদ্রাসার প্রবীণ শিক্ষক ও হেফাজতের মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীর বেতন প্রায় ২৬ হাজার টাকা। হাটহাজারী মাদ্রাসার সহযোগী পরিচালক হওয়ায় তিনি ভাতা হিসেবে পান আরও  ৬ হাজার টাকা।

শফীপুত্র মাওলানা আনাস মাদানীর বেতন ১৬ হাজার টাকার ওপরে। গত বছর সহকারী শিক্ষা পরিচালক হওয়ায় ৫ হাজার টাকা বেশি ভাতাপ্রাপ্ত হন তিনি।

প্রতিষ্ঠানটির সূত্রের দাবি, হাটহাজারী মাদ্রাসার বাকি শিক্ষকদের বেতন ২০ হাজার টাকার নিচে। গত বছরের শেষ দিকে মারা যান মাওলানা কাতেব সুলায়মান আরমান। বয়সে তিনি ছিলেন আল্লামা শফীর চেয়ে বড়। তার বেতন  অবিশ্বাস্য রকম কম ছিল। তিনি মাদ্রাসার প্রবীণ শিক্ষক হলেও তার বেতন চার হাজার টাকায় সীমাবদ্ধ ছিল।

মাদ্রাসাটির একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতন আহমদ শফীর মর্জির ওপর নির্ভরশীল। হিসাব বিভাগে এ বিষয়ে কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়।

হাটহাজারী মাদ্রাসার হিসাব বিভাগের প্রধান মাস্টার মো. রফিক বলেন, ‘হাটহাজারী মাদ্রাসায় প্রতি মাসের শেষেই মাসের বেতন দেওয়া হয়।’ তবে শিক্ষকরা কত বেতন পান, এমন প্রশ্নের উত্তরে রফিক বলেন, ‘এগুলো ঠিক না। বাইরে বলা মানা আছে। আমি দুঃখিত।’

এ বিষয়ে জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হলে আহমদ শফীর সন্তান ও হাটহাজারী মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষা পরিচালক মাওলানা আনাস মাদানী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের মাদ্রাসায় কারও বেতন অন্য কারও জানার সুযোগ নেই। মাদ্রাসায় নিয়মিত বেতন বাড়ানো হয়।’

আহমদ শফীর বেতন প্রায় ৯০ হাজার টাকার কাছাকাছি, এ বিষয়ে জানতে চাইলে না না বলে উড়িয়ে দেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমার আব্বা তো হাটহাজারী মাদ্রাসায় ৫০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেছিলেন।’

আনাস মাদানী জানান, ‘অনুদানের মাধ্যমেই মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। নামকাওয়াস্তে মাদ্রাসার আর্থিক স্থায়ী আয়ের খাত রয়েছে।’

তার নিজের বেতন কত, সেটা কি এখন ১৬ হাজারের কাছাকাছি,এমন প্রশ্নে হেসে ওঠেন আনাস মাদানী। বলেন. ‘আমানতের খেয়ানত করা ঠিক হবে না।’

 

আরও পড়ুন: 

ভুয়া ১০ মুক্তিযোদ্ধার নাম বলতে পারলে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেবো: মোজাম্মেল হক

 

 

 

/এসটিএস/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক